নীড় পাতা / জাতীয় / বাঙালির মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম

বাঙালির মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম

নিউজ ডেস্ক:

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাঙালি জাতির মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের ভিত রচিত হয়েছিল।’

মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) মহান শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে তিনি এসব কথা বলেন।

বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি মহান শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাসহ বিশ্বের সব ভাষাভাষি ও সংস্কৃতির মানুষের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করছি। বাংলাদেশের সঙ্গে ইউনেসকো ২০০০ সাল থেকে এ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদ্‌যাপন করে আসছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- ‘‘বহু ভাষায় শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা’’- যা আমার বিবেচনায় অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত হয়েছে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৫২ সালের এ দিনে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা’র মর্যাদা রক্ষায় প্রাণোৎসর্গ করেছিলেন আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, রফিক উদ্দিন আহমদ, শফিউর রহমানসহ আরও অনেকে। আমি বাংলাসহ বিশ্বের সব ভাষাশহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। একই সঙ্গে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃত্বদানকারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব ভাষাসৈনিকদের, যাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ এবং সংগ্রামের বিনিময়ে আমাদের মা, মাটি ও মানুষের মর্যাদা সমুন্নত হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত বাঙালির গৌরবময় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস যুগে যুগে আমাদের জাতীয় জীবনে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছে। জাতির পিতা ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বারবার কারাবরণ করেছেন। ১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত হয়। ঢাকায় এ খবর পৌঁছামাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনের সামনে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে। এর কিছুদিন পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র শেখ মুজিব তার সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ঢাকায় ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘একই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে এক সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবটি প্রত্যাখান করে খাজা নাজিমুদ্দিন আইন পরিষদে ঘোষণা দেয়, পূর্ব বাংলার জনগণকে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নাজিমুদ্দিনের এই হঠকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস ও অন্যান্য দলের সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১১ মার্চের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শেখ মুজিবসহ অনেক ভাষাসৈনিক সচিবালয়ের সামনে থেকে গ্রেপ্তার হন এবং ১৫ মার্চ মুক্তি পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলার সভায় সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জিন্নাহ ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে উর্দুর পক্ষে বক্তব্য রাখে এবং ২৪ মার্চ কার্জন হলে আয়োজিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা দিলে ছাত্ররা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে।’

তিনি বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনে রূপদান করতে শেখ মুজিব দেশব্যাপী সফরসূচি তৈরি করে ব্যাপক প্রচারণায় অংশ নেন এবং সভা-সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। তিনি ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর থেকে গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি মুক্তি পান। ১৯ এপ্রিল আবার গ্রেফতার হয়ে জুলাই মাসে মুক্তি পান। এরপর তিনি ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর গ্রেপ্তা্র হলে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান। শেখ মুজিব ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ থেকেও ভাষাসৈনিক ও ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছেন এবং আন্দোলনকে বেগবান করতে নানা পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি ১৯৫২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি তিনজন দূত মারফত খবর পাঠান- ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল ডাকতে হবে। শেখ মুজিব আমরণ অনশন ঘোষণা করলে ১৬ ফেব্রুয়ারি কারা কর্তৃপক্ষ তাকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব-বাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশনের জন্য নির্ধারিত ছিল। শেখ মুজিবের পরামর্শ ও নির্দেশ অনুযায়ী ওইদিন সারাদেশে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে এবং সেখানে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালালে কতগুলো তাজা প্রাণ নিমেষেই ঝরে পড়ে, অনেকে আহত হন, অনেকে গ্রেপ্তার হন। ২২ ফেব্রুয়ারি হরতাল পালিত হয়।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়, প্রথম ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, এই দিনে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে এবং শহীদ মিনার তৈরির প্রকল্প গ্রহণ করে। দুর্ভাগ্য, ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারির ফলে সেই আকাঙ্ক্ষাগুলো আর পূরণ হয়নি।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা সব দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ দেন। তিনি সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেন। বাংলায় জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশনে বক্তৃতা দিয়ে আমাদের মাতৃভাষাকে বিশ্ব সভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে কানাডা প্রবাসী রফিক এবং ছালাম নামে দুজন বাংলাদেশি কয়েকজন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সদস্য মিলে ‘‘মাতৃভাষা সংরক্ষণ কমিটি’’ গঠন করে। ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’’ উদ্‌যাপনের জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব পাঠায়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।’

তিনি বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছি। বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় ভাষা সংরক্ষণ ও তাদের মর্যাদা রক্ষার উদ্যোগ নিয়েছি। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করেছি। ২০১৭ সাল থেকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল বইসহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করছি।’

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘মহান ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শকে ধারণ করে গত ১৪ বছরে বাংলাদেশকে আমরা বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছি। ২০৪১ সালের বাংলাদেশ হবে ‘‘স্মার্ট বাংলাদেশ’’- যা স্মার্ট জনগোষ্ঠী, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার এবং স্মার্ট সমাজব্যবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে অর্জিত হবে। একই সঙ্গে আমরা বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ বাস্তবায়ন করছি। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, জাতির পিতার স্বপ্নের উন্নত, সমৃদ্ধ ও আত্মমর্যাদাশীল ‘‘সোনার বাংলাদেশ’’ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব।’

আরও দেখুন

অবশেষে উচ্চ আদালতের আদেশে প্রতীক পেলেন ফরিদা!

নিজস্ব প্রতিবেদক:উচ্চ আদালতের আদেশে নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীতা ফিরে পেয়ে প্রতীক বরাদ্দ পেলেন …