নীড় পাতা / আইন-আদালত / ধর্ষণের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা উচিত না

ধর্ষণের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা উচিত না

হাবিব ফারাবি রাব্বি

সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে উপরের বাক্যটি নেহাত হাস্যকর বলে কেউ কেউ উড়িয়ে দেবেন কিন্তু আইন কোন হাস্যকর বিষয় নয় যা বিভিন্ন বিষয়ের উপর  ভিত্তি করে গড়ে ওঠে । 

আইনবিদ স্যামন্ড এর মতে- আইন হলো ন্যায় প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট কর্তৃক স্বীকৃত ও প্রয়োগকৃত নীতিমালা। আইন হল কিছু নিয়ম কানুনের সমষ্টি যার মাধ্যমে বাধ্যকর শক্তি রয়েছে এবং যা কোন নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্বারা এর ফলাফল বর্ণনা, স্বীকৃত, এবং প্রয়োগ করা যায়।

প্রথমত আপনাকে আমাদের আইনে ধর্ষণ বলতে কী বোঝোয় সেটি বিশদভাবে জানা উচিত, যেহেতু বাংলাদেশের আইন  ব্রিটিশ ও ভারতীয় আইনকে ফলো করে  তাই সেই অনুযায়ী বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন -২০০০ এর ধারা ৯ অনুযায়ী ধর্ষণ বলতে বোঝায়, ‘যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা ষোল বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।

তাহলে ষোল বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সহীত সম্মতিতে সহবাস করলে সেটা ধর্ষণ হবে না। এই আইন অনুযায়ী দাঁড়ালো যে, কোন নারী সম্মতি না দিলে সেটা ধর্ষণ হবে।

অন্যদিকে, দণ্ডবিধি -১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারাতে বলা হয়েছে, ‘ কোন পুরুষ নিম্নোক্ত পাঁচটির যেকোনো অবস্থায় কোন নারীর সাথে যৌনসঙ্গম করলে সে ধর্ষণ করেছে বলে গণ্য হবে ‘।

প্রথমত, স্ত্রীলোকটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে ।

দ্বিতীয়ত, স্ত্রীলোকটির সম্মতি ব্যতিরেকে।

তৃতীয়ত, স্ত্রীলোকটির সম্মতিক্রমেই, যেক্ষেত্রে মৃত্যু বা জখমের ভয় প্রদর্শন করে স্ত্রীলোকটির সম্মতি আদায় করা হলে।

চতুর্থত, স্ত্রীলোকটির সম্মতিক্রমেই, যেক্ষেত্রে পুরুষটি জানে যে, সে স্ত্রীলোকটি স্বামী নয় এবং পুরুষটি ইহার জানে যে, স্ত্রীলোকটি তাকে এমন অপর একজন পুরুষ বলে ভুল করেছে, যে পুরুষটির সাথে সে আইন সম্মতভাবে বিবাহিত হয়েছে বা বিবাহিত বলে বিশ্বাস করে ।

পঞ্চমত, স্ত্রীলোকটির সম্মতিক্রমে অথবা সম্মতি ব্যতিরেকে, যতি স্ত্রীলোকটির বয়স চৌদ্দ বৎসরের কম হয়।

তাহলে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের সকল আইনেই সম্মতির বিষয়টি স্পষ্ট করেছে যে সম্মতি ছাড়া সহবাস করলে সেটা ধর্ষণ হবে কিন্তু সম্মতিতে সহবাস করলে ধর্ষণ হবে না!

আবার অনেকে জানেই না যে অনেক সময় নিজের স্ত্রীর সাথে সহবাস করলেও ধর্ষণ বলে গণ্য হবে যদি স্ত্রীলোকটির বয়স ১৪ বছরের কম হয়৷ এখনও আমাদের দেশে ১৪ বছরের কম বয়সে অনেক মেয়ের বিয়ে হয়৷ তাহলে তারা প্রতিনিয়ত তাঁর স্বামীর নিকট হতে ধর্ষণের স্বীকার হয়!

তাহলে উপরোক্ত আইনানুযায়ী ১৪ বছরের কম কোন মেয়ের সাথে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত কোন স্বামী বা যেকোনো পুরুষ মেয়ের সম্মতি থাকা সত্বেও ধর্ষণ বলে গণ্য হবে, আর ধর্ষণ বলে গণ্য হলে ধর্ষণের একমাত্র শাস্তি যদি মৃত্যুদণ্ড হয় তাহলে এসব স্বামী বা পুরুষের আইনের যথাযথ প্রয়োগ মৃত্যুদণ্ডই হবে।

তাহলে আমাদেরকে একটি বিষয় বিবেচনা করতে হবে সেটি হল ধর্ষণের মাত্রা। ধর্ষণের মাত্রা বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি, যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে সে ধর্ষণ টাকে কতটা কঠিন ভাবে দেখছে এবং সেটি বিচারক কতটা প্রমাণ পাচ্ছে। বলা বাহুল্য, ব্রিটিশ আইনের মতো বাংলাদেশের আইন ধর্ষণের নিম্নলিখিত প্রমাণগুলো দেখতে চায় যেমন: ধর্ষণের ঘটনায় বাদীর সম্মতি ছিল কি না, তা বাদীর ‘চরিত্র’, শরীরে জখমের চিহ্ন, বয়স, আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি বাধাধরা বিষয়। এ ছাড়া অন্য প্রমাণাদি, যেমন দ্রুত এফআইআর দায়ের করা, ধর্ষণের শিকার নারীর ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট, নিরপেক্ষ সাক্ষী, পরিহিত কাপড়ের রাসায়নিক পরীক্ষা ইত্যাদি বিষয়কেও প্রাধান্য দেওয়া হয় একজন বাদীর সাক্ষ্যকে সত্য প্রমাণ করার জন্য।

এখন একটি প্রশ্ন থাকে যদি কেউ সম্পূর্ণ প্রমাণাদি আদালতকে প্রদান করতে সক্ষম হন তাহলে কি ওই বিবাদীর (অপরাধীর যে  ধর্ষণ করেছে /ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি ) একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত? সাময়িকভাবে ধরে নিলাম উচিত কিন্তু এত সহজে না, কারন বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞা এত সহজভাবে প্রদান করা হয়নি, সেখানে জোরপূর্বক যৌনসঙ্গমই ধর্ষণ নয়। নির্দিষ্ট কিছু জোরপূর্বক যৌনসঙ্গমকে ধর্ষণ বলা হয়েছে যা আমি উপরে সামান্য আলোচনা করে এসেছি তার মধ্যে অন্যতম একটি স্ত্রীলোকের সম্মতিক্রমে অথবা সম্মতি ব্যতিরেকে, যতি স্ত্রীলোকটির বয়স চৌদ্দ বৎসরের কম হয়। আরেকটি স্ত্রীর সাথে সহবাস করলেও ধর্ষণ বলে গণ্য হবে যদি স্ত্রীলোকটির বয়স ১৪ বছরের কম হয়৷ ফলে একটি বিষয় স্পষ্ট করে বলা যায় যে ধর্ষণের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চাওয়া উচিত নয় কারণ একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলে আইনের দৃষ্টিতে স্ত্রীলোকটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে থাকা স্বামী, স্ত্রীলোকটির সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সম্পর্ক করা স্বামী, স্ত্রীলোকটির সম্মতিক্রমেই, যেক্ষেত্রে মৃত্যু বা জখমের ভয় প্রদর্শন করে স্ত্রীলোকটির সম্মতি আদায় করা স্বামীর একমাত্র শাস্তিও মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত।

এখন সর্বশেষ আরেকটি সাধারন প্রশ্ন  আমাদের মনে  খচখচ করতে থাকে সেটি হল ভালো ও মন্দ। আমি বোঝাতে চাচ্ছি যে বিষয়টি অপরাধ হিসেবে কতটুকু ভালো আর কতটুকু মন্দ (অপরাধের মানদন্ডে) নৈতিক বা আদর্শিক মানদণ্ড নিয়ে আমাদের মনে প্রশ্ন থাকেই। এই পর্যায়ে এসে বিচারক আইনানুযায়ী নৈতিক মানদন্ড দ্বারা অপরাধটি বিচার করে থাকে ( বলাবাহুল্য সাধারণত বিভিন্ন অঞ্চলের সামাজিকতা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম প্রভৃতির মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে নৈতিক মানদন্ড গড়ে ওঠে। আবার অনেক ক্ষেত্রে, সামগ্রিকভাবে সমগ্র পৃথিবীর জন্য কল্যাণকর বিষয়সমূহকেও নৈতিকতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়) তাই আমাদের অঞ্চলের সামাজিকতা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম বা সামগ্রিক কল্যাণে অপরাধটির যদি নৈতিকতা পর্যালোচনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে আমাদের দেশের কিছু ধর্মে, সামাজিকতায়, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বা সামগ্রিক কল্যাণে স্ত্রীলোকটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে থাকা স্বামী, স্ত্রীলোকটির সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সম্পর্ক করা স্বামী, স্ত্রীলোকটির সম্মতিক্রমেই, যেক্ষেত্রে মৃত্যু বা জখমের ভয় প্রদর্শন করে স্ত্রীলোকটির সম্মতি আদায় করা স্বামীর অপরাধ হিসেবে শাস্তি একমাত্র মৃত্যুদণ্ড যা অধিকাংশ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি অগ্রাধিকার দেন না আবার অনেক ক্ষেত্রে নৈতিক বিবেচনায় মৃত্যুদণ্ড ব্যতীত অন্যান্য শাস্তি সামগ্রিক কল্যাণেও বাধাগ্রস্ত করেনা।

তাই বলা যায় ধর্ষণ অপরাধের যথাযথ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সঠিক নৈতিক মানদণ্ড বিচারের মাধ্যমে ব্রিটিশ ও ভারতীয় আইনের মতো বাংলাদেশের  আইনে ধর্ষণের বিভিন্ন ধরনের শাস্তি প্রদান করা হয়। তবে ধর্ষণের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলে নীতি বহির্ভূত বা অযৌক্তিক শাস্তি বলে গণ্য হবে আবার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়াতে কোন ধরণের বাধা নেই।

লেখক: হাবিব ফারাবি রাব্বি, জার্নাল লেখক, উইকিমিডিয়া, উইকিপিডিয়া

আরও দেখুন

বড়াইগ্রামে সবজি ক্ষেত নষ্ট করার অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক: এক বিঘা জমিতে চাল কুমড়া, খিড়া ও তরমুজ চাষ করেছিলেন নাটোরের বড়াইগ্রামে কৃষক …