নীড় পাতা / সাহিত্য ও সংস্কৃতি / ইতিহাস ও ঐতিহ্য / ‘সাকাম’ ও নায়করাজ রাজ্জাক- একটি বিস্মৃতপ্রায় প্রসঙ্গ

‘সাকাম’ ও নায়করাজ রাজ্জাক- একটি বিস্মৃতপ্রায় প্রসঙ্গ

অধ্যাপক শেখর কুমার সান্যাল

‘সাকাম’ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বেশ কয়েকজন পেশাদার অভিনেত্রী এবং ড্রেসার, মেকআপম্যান ও কনসার্ট বাজিয়ে সংশ্লিষ্ট ছিলেন ‘সাকাম’-এর সাথে। সদস্য হিসেবে এসব শিল্পীরা ‘সাকাম’-এর নাটকে অংশ নিতেন। তবে নাটোরের বাইরে প্রায় সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়েই বিভিন্ন সৌখিন নাট্যগ্রুপে নির্ধারিত সম্মানীর বিনিময়ে তাঁরা কাজ করতে যেতেন। ঐসব গোষ্ঠীর সঙ্গে শিল্পীদের চুক্তির বিষয়টি সম্পাদিত হতো ‘সাকাম’-এর অফিসের মাধ্যমে। ফলে তাঁদের শিল্পীদের বাড়িতে বাড়িতে যেতে হতো না। আজিজ নামে একজন এগুলো দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। এভাবে ‘সাকাম’ এসব শিল্পীদের পেশার বিষয়ে সহযোগিতা করত।

১৯৭৮ সালের ২৫শে জুন সকাল এগারোটা। ‘সাকাম’ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের অফিস কক্ষ। সাধারণ সম্পাদক তথা প্রতিষ্ঠানের প্রাণপুরুষ গেদুভাই (আমিনুল হক গেদু) এবং আমি বসে প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠান এবং উন্নয়নমূলক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করছি। একটু পরেই আবদুল হামিদ (সোনা)ও এসে পড়ল। আমাদের নিজস্ব রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠার পর দুটি বছর পেরিয়ে গিয়েছে। শিল্পী ও কলাকুশলীদের উৎসাহে প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর নাটকের মহড়া চলছে, নাটক মঞ্চায়িত হচ্ছে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই। কিন্তু মিলনায়তনের উপরে এখনও চটের শামিয়ানার অস্থায়ী আচ্ছাদন এবং দর্শক আসনও ধার করে আনা চেয়ার-বেঞ্চ।

টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। কয়েকটি পদশব্দ, মনে হলো দু’তিনজন মানুষ আসছেন অফিসের দিকে। হয়ত শিল্পী যোগাযোগের প্রয়োজনেই। আমরা আমাদের আলোচনা চালাতেই থাকলাম। একটু পরে অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখতে পেলাম সাড়াজাগানো চিত্রাভিনেতা ‘নায়করাজ’ নামে পরিচিত রাজ্জাক অফিসে প্রবেশ করলেন তাঁর রাজশাহীর বন্ধু আবদুর রশিদ সাহেব সহ। রশিদ সাহেব গেদুভাইয়েরও পূর্বপরিচিত। অবাক বিস্ময়ে তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানালাম।

রাজ্জাক রাজশাহীতে এসেছিলেন তাঁর প্রযোজিত পরবর্তী ছবির লোকেশান খুঁজতে। কলকাতার নাকতলার ছেলে রাজ্জাক কলকাতায় প্রখ্যাত অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের ‘রঙ্গসভা’ নাট্যদলে অভিনয় করতেন। তিনি ১৯৬১ সালে বোম্বেতে ‘ফিল্‌মালয় ফিল্‌ম ইন্সটিটিউট’ থেকে ডিপ্লোমা করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। পরবর্তীকালে সিনেমাজগতের ব্যস্ত নায়ক হলেও নাটকের প্রতি তাঁর আকর্ষণ থেকেই যায়।

রাজশাহীতে তিনি একটি নাটক দেখার অভিলাষ ব্যক্ত করেন তাঁর স্থানীয় বন্ধু রশিদ সাহেবের কাছে। রশিদ সাহেব বলেন ভালো নাটক দেখতে হলে নাটোরের ‘সাকাম’ যেতে হবে। তাই তিনি ঢাকা ফেরার পথে নাটোরে থেমেছেন ‘সাকাম’ সম্বন্ধে তাঁর কৌতুহল মেটাতে। আমাদের কাছে ‘সাকামে’র গড়ে ওঠার কাহিনি শুনলেন। ঘুরে ঘুরে সাকামের অফিস, মঞ্চ, মিলনায়তন দেখলেন। দেড়শ’ আসনের মিলনায়তনের স্থায়ী আচ্ছাদন নির্মাণ ব্যয়সাপেক্ষ বলে এখনও অনাবৃত। তিনি জানতে চাইলেন দু’বছরে ‘সাকাম’ কি কি নাটক মঞ্চায়ন করেছে। আমরা একটা প্রোগ্রাম ডায়েরিতে প্রতিটি মঞ্চায়নের তারিখ সহ বিস্তারিত রেকর্ড রাখতাম। সেখান থেকে ওঁকে জানানো হলো আমরা এ পর্যন্ত মঞ্চায়ন করেছি চারটি নৃত্যনাট্য রবীন্দ্রনাথের ‘শাপমোচন’, ‘চণ্ডালিকা’ ও ‘অভিসার’ এবং নজরুলের প্রেমগীতি অবলম্বনে আমার গ্রন্থনায় ‘মানসী’ এবং নাটক ‘বৌদির বিয়ে’, ‘ফাঁস’, ‘তাইতো’, ‘কিন্তু নাটক নয়’, ‘অন্ধকারের নিচে সূর্য’, ‘সুবচন নির্বাসনে’, ‘অবৈধ অরণ্য’, ‘চোর’, ‘অংশীদার’, ‘দোহাই হাঁসবেন না’, ‘জীবন রঙ্গ’, ‘পথের শেষে’, ‘শেষ থেকে শুরু’, ‘মহাকালের নায়ক’, ‘ক্রশরোডে ক্রশফায়ার’, ‘চারদিকে যুদ্ধ’, ‘লৌহ প্রাচীর’, ‘গরুরগাড়ির হেডলাইট’, ‘ফিংগারপ্রিন্ট’, ‘প্রত্যাবর্তন’, ‘চোর চোর’ ও ‘দুই মহল’। রাজ্জাক বললেন, তিনি কলকাতায় ‘ফিংগারপ্রিন্ট’ ও ‘দুই মহল’ নাটক দু’টিতে অভিনয় করেছেন।

অভাবিত ভাবে তিনি প্রস্তাব দিয়ে বসলেন- “আপনারা ‘দুই মহল’ নাটকটি মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করুন উচ্চ মূল্যের টিকিটে, আমি নাটকের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করব। আর সবাই যিনি যে ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তাঁরা তাই করবেন। আপনাদের মিলনায়তনের ওপরের টিনের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তবে এই ছোটো মিলনায়তনে তো হবে না, বুঝতেই পারেন আমাকে দেখতেই অনেক ভিড় হবে। আমি ‘ছায়াবাণী সিনেমা’র মালিক জুলিমিয়াকে (জয়নাল আবেদীন) বলে দেব, ভাড়া লাগবে না। তবে মঞ্চ বেঁধে নিতে হবে। আমার সংলাপগুলো টাইপ করে ঢাকায় পাঠিয়ে দেবেন। আমি আমার স্যুটিং সিডিউল দেখে একটা সুবিধে মতো তারিখ দেব। আগের দিন এসে একটা রিহার্সেলে অংশ নেব, তবে সেদিনও ভিড় এড়ানোর জন্য সিকিউরিটির ব্যবস্থা করতে হবে”।

আমরা জোরেশোরে ‘দুই মহল’ নাটকের মহড়া শুরু করে দিলাম। নাটোরের মহকুমা প্রশাসক এ এইচ এম সাদিকুল হক, অতিরিক্ত মহকুমা প্রশাসক শহীদুল্লাহ্‌ মিয়া, মহকুমা পুলিশ প্রশাসক মীর্জা মনসুর-আল-হক এবং মুনসেফ কামালউদ্দিন মিয়া নিয়মিত সপরিবারে ‘সাকামে’র নাটক দেখতেন এবং প্রতিষ্ঠানের আন্তরিক শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তাঁরা সব বিষয়ে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। তাঁদের কাছে ‘সাকাম’ চিরকৃতজ্ঞ হয়ে রইল। তাঁদের আন্তরিক সক্রিয় সার্বক্ষণিক সহযোগিতা ছাড়া এই আজোজন করা অসম্ভব ছিল। গেদুভাই ঢাকায় রাজ্জাকের সাথে দেখা করে তারিখ নিয়ে টাইপ করা সংলাপ দিয়ে এলেন।

এইসব করতে প্রায় বছর ঘুরে এলেও রাজ্জাক তাঁর প্রতিশ্রুতি বিস্মৃত হন নাই। মঞ্চায়নের তারিখ স্থির হলো ১৫ই জুন ১৯৭৯ শুক্রবার ‘ছায়াবাণী সিনেমা’ মঞ্চে সন্ধ্যা ৮টা। দর্শনী ১০০ টাকা ও ৫০ টাকা। অগ্রিম টিকিট বিক্রি হতে শুরু হলো।

রাজ্জাকের সঙ্গী সহ থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল সি এ্যান্ড বি (বিল্ডিং) ডাকবাংলোতে। ১৪ তারিখ দুপুরের মধ্যে রাজ্জাক নিজস্ব মেকআপম্যান এবং দু’জন সঙ্গী সহ নাটোরে চলে এলেন। সন্ধ্যায় রিহার্সেলের সময় ‘সাকামে’ সব রকমের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন এসডিপিও মীর্জা মনসুর-আল-হক সাহেব। সব কিছু সত্বেও ভিড় সামাল দিতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়েছিল। নাম উল্লেখ করব না, কিন্তু এমন অদ্ভুত অদ্ভুত ভদ্রলোক রিহার্সেল দেখার সুযোগ করে দিতে অনুনয় বিনয় করছিল দেখে অবাক হয়েছিলাম। নাটকটির পরিচালক ছিলেন নাজমুল হক লালা। রাজ্জাকের মত শক্তিমান অভিনেতা যখন লালাভাইকে যথোচিত সম্মান দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করছিলেন তাঁর অভিনয় ঠিক হচ্ছে কিনা, লালাভাই বিব্রত বোধ করছিলেন।

‘সাকাম’ মঞ্চে ‘দুই মহল’ নাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আমিনুল হক গেদুভাই। ‘ছায়াবাণী সিনেমা’ মঞ্চে সেই চরিত্রটি রূপায়ন করলেন রাজ্জাক। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রমজান আলী(প্রয়াত), মোহিত দাস(প্রয়াত), নারায়ণ মানী(প্রয়াত), অচিন্ত্য ঠাকুর(প্রয়াত), বিজন নিয়োগী(প্রয়াত), গুরুদাস সরকার(প্রয়াত), স্বপন রায়(প্রয়াত), আব্দুল ওদুদ(দুদুভাই), হাবিব আহমেদ, নাজমুল হক লালা, নিমাইচাঁদ বসাক(সুনু), নৃপেন সাহা, অমল ব্যানার্জী, কালাচাঁদ, প্রফুল্ল সাহা, অলক মৈত্র(প্রফেসর), কিশোর বসাক, আশরাফ আলী, প্রতিমা রায় ও অনিতা পাল(মৈত্র)।

পরিচালনাঃ নাজমুল হক লালা। আবহ সংগীতঃ শ্যামাপদ বসাক(প্রয়াত) ও অধ্যাপক মিহির কুমার সান্যাল(প্রয়াত)। আলোক সম্পাতঃ শিশির কুমার সান্যাল। রূপসজ্জাঃ তারাপদ পাল(প্রয়াত) ও ষষ্ঠীপদ পাল। উপস্থাপনাঃ অধ্যাপক শেখর কুমার সান্যাল (সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক)।

নাটক শেষে সাকাম সম্পাদক আমিনুল হক গেদু রাজ্জাককে ‘সাকাম’-র মনোগ্রাম অংকিত একটি সোনার ল্যাপেল পিন উপহার দিয়েছিলেন দর্শকদের সামনে এবং রাজ্জাক দর্শকদের উদ্দেশ্যে কয়েকটি কথা বলেছিলেন।

রাজশাহীর ডিসি এবং এসপি’ও এসেছিলেন নাটক দেখতে। রাজ্জাক গেদুভাইকে অনুরোধ করছিলেন উইংসের পাশ থেকে তাঁর সংলাপ ধরিয়ে দিতে। ফলে মিলনায়তন সামলানোর দায়িত্ব এসে পড়ে আমার উপর। অনেক ঝামেলা এমনকি অপমানও সহ্য করতে হয়েছিল আমাকে কাজটি করতে গিয়ে। যেমন একজন ম্যাজিস্ট্রেটের স্ত্রী রেগে বলে বসলেন তাঁকে আরো সামনে আসন দেয়া উচিত ছিল। অতিরিক্ত মহকুমা প্রশাসক শহীদুল্লাহ্‌ মিয়া বিষয়টি সামলে নিলেন। একজন টাউন দারোগা এসে বললেন তাঁর স্ত্রীর বসার ব্যবস্থা কোথায়। মীর্জা মনসুর-আল-হক সাহেব বলেছিলেন পুলিশের কেউ এলে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। সে কথা বলায় দারোগাসাহেব ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন টাউন দারোগার গুরুত্বও নাকি যথেষ্ট। এরকম আরও দু’একটা ঘটনার সাক্ষী হতে হয়েছিল। একসময় এসব লক্ষ্য করে মুনসেফ কামালউদ্দিন মিয়া, যিনি আমার টেনিস পার্টানারও ছিলেন, আমাকে ডেকে বললেন এ পোড়া দেশে আমার মতো সম্মানীয় মানুষের সংস্কৃতি সেবা করতে না আসাই ভালো।

পরদিন সকালে রাজশাহীতে চলে যাওয়ার আগে রাজ্জাক বলেন তিনি ১৮ তারিখে সড়কপথে ঢাকা ফেরার সময় সাকামে এক ঘন্টা বিরতি নিয়ে সাকামের সব শিল্পী ও কলাকুশলীর সাথে দেখা করে যেতে চান। সেইমতই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তিনি ‘সাকাম’-এর শিল্পীদের অভিনয় শৈলী ও টিম-ওয়ার্কের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য তিনি একটি পয়সাও সাকামের কাছ থেকে নেন নি। বরং ডাকবাংলোর বিলও তিনি মিটাতে চেয়েছিলেন।

পরবর্তীকালে গেদুভাইয়ের সাথে রাজ্জাকে সৌহার্দের সম্পর্ক হয়েছিল এবং রাজ্জাকের আমন্ত্রণে তাঁর একটি সিনেমাতে গেদুভাই অভিনয়ও করেছিলেন।

এখন যাঁরা ‘সাকাম’-এর সাথে জড়িত তাঁরা হয়ত জানেনও না প্রতিষ্ঠানের ‘আমিনুল হক গেদু মিলনায়তনে’র ওপরের টিনের আচ্ছাদনের জন্য নায়করাজের অবদানের কথা।

নায়করাজ রাজ্জাকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ‘সাকাম’ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাঁকে স্মরণ করি গভীর কৃতজ্ঞতায় এবং শ্রদ্ধায়।

আরও দেখুন

কবি নাজনীন নাহার এর কবিতা “আমি মানুষ’’

আমি মানুষ! নাজনীন নাহারআমি মানুষ!হ্যাঁ আমি মানুষ।আমি অমানুষের করি নাশ,মানচিত্র থেকে মুছে দেবো আমি অমানুষদের …