নীড় পাতা / সাহিত্য ও সংস্কৃতি / লেখক সন্দীপন সান্যালের লেখা ‘শিক্ষকতা-আশীর্বাদ না অভিশাপ!’

লেখক সন্দীপন সান্যালের লেখা ‘শিক্ষকতা-আশীর্বাদ না অভিশাপ!’

শিক্ষক এই শব্দটা শুনলেই আমার কাছে বটু স্যারের মুখ ভেসে আসে। নাটোরের বটু স্যার। আমার ছেলেবেলায় বেড়ে ওঠা জনপদে যিনি অজস্র কচি মনে সহস্র স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছেন। আমার স্যার। আমার বাবারও স্যার। চাঁদ মামার মতো সবারই তিনি মাষ্টার মশাই। মাস্টারদা সূর্য সেনের মতো সবাইকে আলোকিত করতে যার আবির্ভাব। বিজয়া দশমীর অথবা ঈদের সকালে স্যারের বাসার দরজাটা হাট খোলা থাকত। দরজার একদিকে একদল মানুষ পিঁপড়ের মতো লাইন করে ঢুকত। আরেক পাশে আরেকটা লাইনে একদল স্যারের আশীর্বাদ নিয়ে বের হতো। বটু স্যার উনার ছাত্র পড়ানোর চেয়ারের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এক এক জন এসে প্রণাম অথবা সালাম করে উঠে দাড়াচ্ছে। স্যার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করছেন। স্যারের বৌদি বিশাল পাত্রে নারিকেলের নারু নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। স্যার দুটো করে নারু দিয়ে দিচ্ছেন হাতে। চরম শ্রদ্ধা ভরে দুহাত জড়ো করে এক একজন সেই প্রসাদ অমৃত মাথায় ঠেকিয়ে চলে যাচ্ছে পরের জনকে জায়গা করে দিতে।
.
বটু স্যার আকারে ছোট ছিলেন। এই ক্ষুদ্রাকৃতির মানুষটিই ছিলেন শহরের অনেক বিশাল মহীরুহের পেছনে বিশাল ছায়া। কি রোদে কি বৃস্টিতে যখন ছাতা নিয়ে হাটতেন পেছনে সবাই দেখত শুধু একটা ছাতা চলছে। অনেকটা ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো। ছেলেবেলায় আমাদের কাছে তিনিও ছিলেন বিদ্যার মহাসাগর। শহরের এককালীন খ্যাতিমান ফুটবল খেলোয়ার উনার দাদা অসময়ে শারীরিক অসুস্থতায় অনেকটা অচল হয়ে পড়েছিলেন। দাদার পরিবারের দায়িত্ত্ব নিতে তিনি আজীবন অকৃতদার ছিলেন। বড় ভাস্তে যখন বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবেন প্রায় ঠিক তখনই এল ৭১। উদীয়মান তরুন সংসার ফেলে দেশের হাল ধরতে নিজেকে আত্মাহুতি দিয়ে শহীদ হলেন। অগত্যা স্যার আবার টেনে চললেন সংসারের চাকা। সংসারের খরচ বাঁচাতে স্যারকে এমনকি রিক্সাতে চড়েও বাড়তি খরচ করতে দেখা যেত না। অথচ বাসাতে অনেক ছেলেই বিনে পয়সায় পড়ত।
.
বুয়েটে আমার রেজাল্ট বেরনোর পরে যেদিন প্রথম নাটোরে এলাম সে দিনটির কথা বড্ড মনে পড়ে। বটু স্যার একটা সোনার মেডেল বানিয়ে আমার গলায় পড়িয়ে দিয়েছিলেন। আরেকটা সোনার মেডেল মায়ের গলায়। সেই ছিল আমার পাওয়া সবচেয়ে বড় পুরস্কার। আজিও সেই মেডেল দেখি – আর মনে পড়ে যায় স্যারের কথা।
.
শ্যামল কান্তি মাষ্টার মশাইয়ের ভিডিও দেখে আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছিল। রাতে বালিশে মাথা দিয়ে দেখেছি বটু স্যার কান ধরে ক্লান্ত অপমানিত শরীরে একবার উঠছেন একবার বসছেন। ওঠ — বোস — ওঠ — বোস —। আমি আমার শিক্ষক বাবার কথা ভেবেছি যিনি একদা মিথ্যা অপবাদে হৃদয়ে অসুখ বাঁধিয়ে ফেলেছিলেন। আমি আমার পূর্ব পুরুষদেরকে লাইন ধরে উঠ বোস করতে দেখেছি।
.
বংশ পরম্পরায় আমার পূর্ব পুরুষ কেন যেন এই শ্যামল কান্তির মতো রোদ্দুর হয়ে শিক্ষার আলো ছড়াতে চেয়েছিলেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে নেপাল থেকে পাঁচ জন টোল পন্ডিতকে বারেন্দ্র ভূমিতে আনা হয়েছিল। তারই এক পন্ডিতের বংশ পরম্পরায় আমার সৃষ্টি – শিক্ষকতার একই রক্ত বয়ে চলেছে সেই তখন থেকে। আমাদের বংশে এক এক সময় এক একজন এই বংশ তালিকা রক্ষণের চেষ্টা করেছেন। সর্ব শেষ আমার এক কাকা এটাকে আরো পরিবর্ধিত করেছেন একেবারে আমার পরের প্রজন্ম পর্যন্ত। ফলাফল সেই ১৬০০ সাল থেকে বংশ তালিকাটি আমাদের সংরক্ষণে। অদ্ভুত হলেও সত্য এই একটা পেশা শিক্ষকতাই সবাই বেছে নিয়েছিলেন। ছেলেবেলা থেকে নানা সময়ে পূর্ব পুরুষদের অনেক গল্প শুনেছি। সেই গল্প গুলো সব ভিড় করে এসেছে রাতে আমার মাথায়। আজকের সময় হলে নমস্য আদি পুরুষেরা নির্ঘাত শ্যামল কান্তি বাবুর মতো স্ব স্ব পবিত্র কর্ণ যুগল কুঞ্চিত করে উত্থান পতনে অংশ নিতেন।
.
আমার প্রপিতামহের একটা গল্প বলি। উনি ছিলেন নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রথম প্রধান শিক্ষক। এককালের বিখ্যাত বিদ্যালয় যেখান থেকে আমার বাবাও একদা পুরো দেশে মেধা তালিকায় প্রথম হয়েছিলেন। সেই মহারাজ জগদীন্দ্রনাথ, যিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নিখিল ভারত কংগ্রেসের ২য় অধিবেশনের সভাপতি এই মহারাজা নাটোর থেকে ক্রিকেট দল নিয়ে ইংল্যান্ডে খেলতে যেতেন আর নিজে নামতেন তিন নম্বরে ব্যাট করতে। গল্পে আসি। রাজপুত্র ভর্তি হলেন বিদ্যালয়ে। তার পিছে পিছে এলো রাজপুত্রের সিংহাসন। খবর গেল প্রধান শিক্ষকের কানে। তিনি ঘোষণা দিলেন রাজপুত্রকে সিংহাসনে বসতে হলে প্রত্যেকটা ছাত্রকে একটা সিংহাসন দিতে হবে। নতুবা রাজপুত্রকে সবার মতো কাঠের বেঞ্চে বসতে হবে। আর সবাইকে একই পোশাকে থাকতে হবে – কোন রাজ পোশাক চলবে না। না – আমার প্রপিতামহকে শুলে চড়তে হয় নি। এমনকি কান ধরে উঠ বোস ও করতে হয় নি। বরং সেই সম্রাট আলেকজান্ডার আর পুরুর গল্পের মতোই মহারাজ প্রধান শিক্ষকের পিঠ চাপড়িয়ে সব কিছু মেনে নিয়েছিলেন। আর এ গল্প স্থান পেয়েছিল মানুষের মুখে মুখে।
.
সময়ের কাঁটাকে টান দিয়ে নিয়ে যাই নব্বই এর দশকে। যখন আমার মা স্থানীয় সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল সবে বেড়িয়েছে। এলাকার নেতা এসে হাজির হলেন প্রধান শিক্ষিকার ঘরে। তিনি আবার সরকারের পাতি মন্ত্রীর ডান হাতের ডান হাত। নেতার মেয়েকে ভর্তি করতে হবে। শিক্ষিকা পিয়নকে দিয়ে পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে এলেন। নেতার সামনে টেবিলের উপরে রাখলেন। এই মেয়ে নম্বরে একেবারে তলার দিকে আছে। শিক্ষিকা নেতার চোখে চোখ রেখে বললেন,
.
“আমার কোন অসুবিধা নেই এই মেয়েকে ভর্তি করতে। তবে এর চেয়ে যারা বেশী নম্বর পেয়েছে তাদেরকেও ভর্তি করতে হবে। তার অর্থ বর্তমান ছাত্রী সংখ্যার তিন গুণ হবে। আপনাদের প্রয়োজনীয় অর্থ দিতে হবে তার জন্য।”

সময় বদলেছে। আলেকজান্ডার কবেই গত হয়েছেন। কাজেই পুরুর গল্পও নেই। নেতা উঠে দাঁড়ালেন,
“সোজা আঙ্গুলে না চললে আঙ্গুল বাঁকা করতে হবে। এক্কেবারে সব কিছু বোমা মেরে উড়িয়ে দেব”

প্রধান শিক্ষিকা ঠায় বসে থাকলেন উনার চেয়ারে,
“এই আমি বসে রইলাম। আপনি আপনার লোক দিয়ে বোমা মারুন। কোন অসুবিধা নেই। আমার যা বলার বলে দিয়েছি”

গল্পটা কিন্তু এখানেই শেষ হয়েছিল। ভয় দেখানো পর্যন্ত। সেই মেয়ে ভর্তি হতে পারেনি। আজকের সময় হলে প্রধান শিক্ষিকা ফৈয়জিয়া ইয়াছমিন হয়ে টয়লেটে ঢুকতেন যেখান থেকে উনাকে টেনে হিঁচড়ে বের করা হতো। সভ্যতা(!) তো সময়ের সাথে সাথে অনেক এগিয়ে গেছে তাই না!
.
শ্যামল কান্তি স্যারের ভিডিও দেখে আমার বাবার কথা মনে হয়েছে। মনে পরেছে সেই দিনটির কথা। যেদিন বাবা চুপ চাপ বাসায় বসে শীতের মধ্যে দর দর করে ঘামছেন। মা চেয়ার দিয়ে দরজা ঠেকিয়ে রেখেছে। বাইরে এক দঙ্গল মানুষ চীৎকার করে বলছে, “ভারতের দালাল ভারতে ভাগ”। যে দেশে এক পরিবার শত শত বছর ধরে সেবা দিয়ে চলেছে বংশ থেকে বংশে – সহসা একদল মানুষ নামের প্রাণী এসে ঘোষণা দিয়ে দিল এ দেশ তোমার না, এখানে তোমার স্থান নেই। জনৈক শিক্ষকের হৃদয় ভেঙ্গে গিয়ে একটা বড় অসুখ দানা বেঁধে গেল। একবিংশ শতাব্দীর সভ্য বাংলাদেশের কথা ভাবলে মনে হয় বাবা সৌভাগ্যবান ছিলেন। কিছু অসভ্য শব্দ শুধু কর্ণ কুহরে প্রবেশই করেছিল, কর্ণের অন্য ব্যবহারের প্রয়োজন হয় নি

আমার বুয়েটের ফলাফল বেরনোর পরে আমার কাছেও শিক্ষকতার সুযোগ এসে দেখা দিল। সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমি বাবার মুখোমুখি হই। জানতে চাই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেবার ভালো আর খারাপ দিকগুলো। মনে কেমন আশঙ্কা।
সেদিন আমি প্রথম যে প্রশ্ন করেছিলাম তা আজো মনে আছে।
“শিক্ষক হতে চাই সম্মান পেতে। আমি যা শিখেছি তা ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দেবার আনন্দ পেতে। তবে সেই সাথে ভয় এতো অল্প বয়সে শিক্ষক হিসেবে একটা ব্যক্তিত্ত্ব অথবা অনেক বাধ্য বাধ্যকতা ধরে রাখতে শেষে তারুন্যকে হারিয়ে ফেলি”

বাবা উনার স্বভাবসুলভ ধীরে ধীরে বলেছিলেন,
“এই তারুণ্য আর শিক্ষক হিসেবে অতিরিক্ত ব্যক্তিত্ত্ব প্রকাশের সংঘাত হয়তো তোমাকে প্রাথমিক পর্যায়ে একটু সমস্যায় ফেলবে। কিন্তু খুব শীঘ্রিই তুমি সেইটা কাটিয়ে উঠবে। এই যে সম্মানের কথা বললে, যত সময় যাবে তুমি যদি ভালো শিক্ষক হও এই সম্মান আরো বাড়তে থাকবে। কিন্তু সেই সাথে একটা মহা ব্যাধি তোমার মাঝে দানা বাঁধবে। তা হলো ছাত্র বা ছাত্র স্থানীয়দের কাছ থেকে একটু শ্রদ্ধা বা সম্মানের প্রত্যাশা। ছাত্রের সাফল্যে তুমি গর্বিত হবে, শ্রদ্ধায় হবে আপ্লুত – যা স্বর্গীয়। আবার এদের সামান্য অবহেলা তোমাকে যে আঘাত দেবে তাতে এক পলকে তোমার মনে হবে সমস্ত গর্ব সমস্ত প্রাপ্তি ধুলায় মিশে গেছে।”
.
বাবা আমাকে বলেছেন ৭১ এর গল্প। এক যাযাবর পরিবার সেদিন বেঁচে গিয়েছিল শুধু শিক্ষক বলে। বিপদ কাঁধে নিয়ে ছাত্ররা পার করে দিয়েছিল শত্রু মুক্ত এলাকায়। আবার সেই বাবাই আমাকে গল্প করেছেন অনেক আঘাতের। আর ছাত্রের কাছে অন্য দেশের দালাল হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার গল্প তো আমার চোখে দেখা।

সভ্যতা পাখা মেলে মঙ্গল গ্রহে আবাস খুঁজছে। আর সেই সাথে সাথে আমার প্রিয় জন্মভূমিতেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। সেদিন আর দূরে নয় যখন বলা হবে,

“আপনি কি পড়ালেন – এতো জটিল বিষয় কেন? কান ধরেন —” অথবা “এত্তগুলো হোম ওয়ার্ক দিলেন কেন – কান ধরেন”। শিক্ষক হিসেবে আপনার কাজ সেবা দেয়া – মুখ বুজে সেবা দিন। একটু এদিক ওদিক হলে টের পাবেন কত কানে কত টান। মান? শিকেয় তুলে রাখুন।
.
শিক্ষা বিভাগ ক্রমশঃ বিদ্যা দেবী সরস্বতীর হাত থেকে অর্থ দেবী লক্ষীর হাতে চলে যাচ্ছে। হে ভবিষ্যতের দিশারীরা তোমাদের জন্য সুখবর আছে। তোমরা কি টের পাচ্ছো? শিক্ষকদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। যে অতিরিক্ত অনুভূতিপ্রবন গোষ্ঠী তোমাদের এতোদিন অনর্থক উঠতে বসতে শাসন করেছেন তাঁদের আজ উঠ বোস করবার পালা। এর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তোমাদের কাছে পরীক্ষার অনেক আগে সাফল্যের চাবি কাঠি প্রশ্ন পত্র পৌছিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিছু দুর্মুখেরা বলবে শিক্ষাকে পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে — মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়া হচ্ছে — এমনি আবোল তাবোল প্রলাপ। চারপাশের হিংশুকদের ঈর্ষাপরায়ণতাকে পাত্তা না দিয়ে তোমরা মহান নেতাদের পথ ধরে এগিয়ে চল। তেনারাই চলার পথের নতুন ধ্রুবতারা।

“মহাজ্ঞানী নেতাগণ
যে পথে করে গমন
সেই পথ লক্ষ্য করে
স্বীয় স্বীয় লেজ ধরে
তোমরাও হও বরণীয়।”
.
পৃথিবীর আদিমতম প্রাণী এমিবা মেরুদণ্ড ছাড়াই শতাব্দীর পর শতাব্দী টিকে রয়েছে। শক্ত মেরুদণ্ড নিয়ে ডাইনোসর আজ কোথায়?

আরও দেখুন

কবি নাজনীন নাহার এর কবিতা “আমি মানুষ’’

আমি মানুষ! নাজনীন নাহারআমি মানুষ!হ্যাঁ আমি মানুষ।আমি অমানুষের করি নাশ,মানচিত্র থেকে মুছে দেবো আমি অমানুষদের …