নীড় পাতা / আইন-আদালত / পুকুর খননে পুকুর চুরি ! জড়িত কে ?

পুকুর খননে পুকুর চুরি ! জড়িত কে ?

বিশেষ প্রতিবেদক:

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং হাই কোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলা জুড়ে ফসলি জমিতে চলে আসা অবৈধ পুকুর খননের সঙ্গে জড়িত খোদ উপজেলা প্রশাসন !
এমন অভিযোগ নিয়ে নারদ বার্তার বিশেষ প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব।

নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে অবৈধ পুকুর খনন। একটি বিশেষ কালো মহলের কারণে বারবার চেষ্টা করেও থামানো যায়নি পুকুর খনন। পুরো উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায় তিন ফসলী জমিতে শুধু পুকুর আর পুকুর। পুকুর খননকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মাটি বিক্রির রমরমা ব্যবসা। পাশাপাশি চলছে বিভিন্ন মহলে তদবির।

উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারংবার অভিযান চালিয়ে পুকুর খনন বন্ধ করা হলেও কোন এক অজানা কারণে পুকুর খনন সম্পন্ন হয়ে যায় সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই। প্রশাসনের তরফ থেকে মাটি কাটার যন্ত্র (ভেকু মেশিন) এর ব্যাটারী জব্দ করে নিয়ে আসার পর কিভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিভাবে সম্ভব হচ্ছে এই কর্মকাণ্ড সম্পাদন। সে বিষয় নিয়ে মুখ খুলতে সাহস পান না সাধারণ ভুক্তভোগীরা। এদিকে নলডাঙ্গা থানা ও উপজেলার কর্মকর্তারাও বিষয়টি অস্বীকার করেন। তবে নারদ বার্তার বিশেষ অনুসন্ধানে এবার বেরিয়ে এসেছে একজন ভুক্তভোগীর তথ্য।

নলডাঙ্গা উপজেলা অফিসের একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর নামে অভিযোগ উঠেছে একটা পুকুর খননের জন্য বিভিন্ন কৌশলে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা নেয়ার। অভিযুক্ত এই কর্মচারীর নাম দিদারুল ইসলাম ওরফে লিটন। বাড়ি নাটোর সদর উপজেলার মাঝদিঘা গ্রামে। মাঝদিঘা গ্রামের হোসেন মন্ডল একমাস আগে মির্জাপুর বাজারের পাশে একটি পুকুর খনন করতে গেলে পরামর্শ করেন দিদারুলের সঙ্গে। প্রসঙ্গতঃ হোসেন মন্ডল এবং দিদারুল সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা। যেহেতু দিদারুল উপজেলা নির্বাহী অফিসে চাকরি করেন সেই করণে হোসেন মন্ডলকে পুকুর কেটে দেয়ার জন্য সব রকম ব্যবস্থা করে দেয়ার আশ্বাস দেন। সেই প্রেক্ষিতে দিদারুল তার চাচাকে বলেন ইউএনও অফিস এবং থানায় টাকা দিতে হবে। দিদারুল তার চাচাকে সঙ্গে নিয়ে নলডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ হুমায়ূন কবিরের (হুমায়ূন কবির গত মাসের চার তারিখে বদলি হয়ে যান) সঙ্গে সাক্ষাত করেন। হোসেন মন্ডলের সাক্ষ্যমতে সেখানে তিন ধাপে সত্তর হাজার টাকা প্রদান করেন এবং রাতের অন্ধকারে পুকুর খনন শুরু করেন। তিন রাত পুকুর খনন করার পর নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অভিযান পরিচালনা করে ভেকু মেশিনের ব্যাটারী জব্দ করেন। 

এদিকে দিদারুলের সঙ্গে আবারও যোগাযোগ করেন হোসেন মন্ডল। দিদারুল হোসেন মন্ডল কে জানান, ইউএনও অফিসে সত্তর হাজার টাকা দিতে হবে। হোসেন মন্ডল তার ভাগ্নে সাইফুলের মাধ্যমে সত্তর হাজার টাকা ইউএনও অফিসে দিদারুলের কাছে পৌঁছান। এরপর দিদারুল বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে হোসেন মন্ডলের কাছে থেকে টাকা নেন। কখনও উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জানের ব্যক্তিগত কর্মকর্তার কথা বলে, কখনোবা নাটোরের ম্যাজিস্ট্রেটের কথা বলে। এক পর্যায়ে হোসেন মন্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন দিদারুল। উপায় না দেখে বিভিন্ন মারফতে চেষ্টা তদবির শুরু করেন হোসেন মন্ডল। এক পর্যায়ে ইউএনও অফিসে আবারও সত্তর হাজার টাকা দিয়ে ভেকু মেশিনের ব্যাটারী নিয়ে পুকুর কাটা শুরু করেন রাতের আঁধারে। 

এদিকে গত এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে নলডাঙ্গা থানায় যোগদান করেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম। দায়িত্ব গ্রহণ করেই সবধরণের পুকুর খনন বন্ধ করেন তিনি। হোসেন মন্ডলের পুকুর খনন আবারও বন্ধ হয়ে যায়। পুকুর খননের জন্য হোসেন মন্ডল প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ করেও পুকুর খনন সম্পন্ন করতে পারেননি। অন্যদিকে বিভিন্ন চেষ্টার মাধ্যমে অন্যরা পুকুর খনন শেষ করে ফেলেছে বলে দাবি করেন হোসেন। পুকুরের জন্য টাকা দিয়ে পুকুর খনন করতে না পারায় দিদারুলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন হোসেন অথচ দিদারুল অস্বীকার করেন পুরো বিষয়টা। হোসেন মন্ডলের অভিযোগের প্রেক্ষিতে দিদারুলের মুখোমুখি হলে প্রথমে অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে স্বীকার করেন টাকা নেয়ার কথা। তবে টাকা ফেরত দেয়ার জন্য সময় চেয়ে নিয়ে চাচা হোসেন মন্ডলের সঙ্গে সমঝোতা করে নেন।

এ ব্যাপারে প্রথমে বদলি হওয়া নলডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হুমায়ূন কবিরের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি নারদ বার্তাকে জানান, “আমি কোন টাকা নিই নি।  আমি তো পুকুর কাটতে দেবো না, সেক্ষেত্রে কেন টাকা নেবো ! আমার নামে দিদারুল বানোয়াট গল্প বলেছে আমি তাকে চিনিও না।” কিন্তু নারদ বার্তার অনুসন্ধানে কেটে গেছে সেই রহস্যের ধুম্রজাল। হুমায়ন কবির নলডাঙ্গা থেকে বিদায় নেওয়ার প্রাক্কালে অর্থাৎ আগের রাতে মাঝদিঘায় গিয়ে মাটি বিক্রি করার অপরাধে হোসেন মন্ডলের কাছে থেকে নয় হাজার টাকা নিয়ে আসেন।

নলডাঙ্গা উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামেই পুকুর খননের উৎসব চলছে। প্রতিটি পুকুর খননের সঙ্গে জড়িত আছেন এলাকার প্রভাবশালীরা। মাঠে গিয়ে দেখা যায় ফসলি জমি কমছে পাল্লা দিয়ে। এভাবে চলতে থাকলে দুই এক বছরের মধ্যে ফসলি জমি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে।

পুকুর খনন নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসের একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর অনিয়মের ব্যাপারে নির্বাহী কর্মকর্তা সাকিব আল রাব্বির কাছে জানতে চাইলে তিনি নারদ বার্তাকে জানান, “দিদারুল ইসলামের নামে আগে থেকেই অনেক অভিযোগ রয়েছে। নলডাঙ্গা বাজারে তাকে বাকিতে কোন পণ্য দিতে না করা হয়েছে। এর আগেও তাকে বিভিন্ন সময় বিচার করতে হয়েছে এমনকি তার বেতনের টাকা দিয়ে তার বাকি পরিশোধ করা হয়েছে।” পুকুর খননের জন্য সত্তর হাজার টাকা উৎকোচ গ্রহণের বিষয় অস্বীকার করে নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, “আমি কেন টাকা নিবো। আমি কোন টাকা নিই নি।” জব্দ করা ভেকু মেশিনের ব্যাটারি ফেরত এবং পুকুর খনন সম্পন্ন হচ্ছে কিভাবে- এমন প্রশ্ন করা হলে সাকিব আল রাব্বি প্রসঙ্গ পাল্টে বলেন, “দিদারুলের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট পাঠানো হবে জেলা প্রশাসকের কাছে। তাকে শোকজ করা হবে। একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মকর্তা কিভাবে এত বড় অনিয়ম করতে পারে।”

এসব বিষয়ে নলডাঙ্গার সচেতন মহলের মনে ঘুরছে নানান প্রশ্ন- “এ বিষয়ে কি অফিসের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা কিছু জানেন না কিংবা তারা কি দায় এড়াতে পারেন? কার ইশারায় চলে আসছে এমন তুঘলকি কান্ড আর এ বিষয়গুলোর সঙ্গে জড়িত কে বা কারা!” বিগত দিনগুলোতে প্রশ্নগুলো শুধু মুখে মুখেই ফিরছে, উত্তর মিলছে না।

নলডাঙ্গা উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জান আসাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি নারদ বার্তাকে জানান, “প্রথম থেকেই আমি তিন ফসলি জমি ধ্বংস করে পুকুর খননের বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছি। বারবার তথ্য দেয়ার পরও কোন রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি, উল্টো কোন না কোনভাবে দুষ্ট চক্রের মাধ্যমে পুকুর খনন সম্পন্ন হয়েছে। এক পর্যায়ে পুকুর খননে বাধা দেয়ায় আমাকে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। থানায় অভিযোগ দায়ের করতে হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা প্রয়োজন।”

পুকুর খননকে কেন্দ্র করে নলডাঙ্গা উপজেলা জুড়ে যে অনিয়ম চলে আসছে তা নতুন কোন ঘটনা না। উপজেলা পনিষদের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দিদারুল প্রথমে তাকে প্রস্তাব দেয় পুকুর খনন করে দেয়ার ব্যবস্থা করে দিতে। এও জানান যে তিনি থানা ম্যানেজ করে নিয়েছেন। কিন্তু ওই কর্মকর্তা দিদারুলকে এ বিষয়ে কোন রকম সাহায্য করতে পারবেন না বলে সতর্ক করে দেন। 

জনমনে আশঙ্কা রয়েছে, একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী যদি একটি পুকুর খননের জন্য দুই লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিতে পারে, তাহলে অবস্থা কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে!

ভুক্তভোগী হোসেন মন্ডল জানান, “আমি মাছের ব্যবসা করি, এজন্য আমার অনেকদিনের শখ একটি নিজের পুকুর থাকবে। এই ইচ্ছা থেকেই পুকুর খনন করতে চেয়েছিলাম। আর লিটন (দিদারুলের ডাক নাম) যেহেতু উপজেলায় চাকরি করে সেহেতু ভেবেছিলাম তার সাহায্য নিয়ে করে ফেলবো। কিন্তু সে আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা রকম কথা বলে আমার কাছে থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়। আমার কষ্ট করে উর্পাজনের টাকাগুলোও গেল আবার পুকুরও কাটাতে পারলাম না। অথচ অন্যরা কিভাবে যেন পুকুর তৈরী করে ফেলছে।”

চাচার সঙ্গে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেয়ার ব্যাপারে দিদারুল প্রথমে অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে স্বীকার করে বলেন, “আমার ভুল হয়ে গেছে। বিষয়টা নিয়ে আমি চাচার সঙ্গে কথা বলেছি। একমাস সময় নিয়েছি। চাচার টাকাগুলো আমি ফেরত দিয়ে দিব।”

এতো গেল একটি পুকুরকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া কাণ্ড। প্রশ্ন হলো একটা পুকুর নিয়েই যেখানে এত কাণ্ড, সেখানে পুরো উপজেলা জুড়ে ফসলি জমি ধ্বংসের যে খেলা শুরু হয়েছে সেখানে কি পরিমাণ টাকার হাত বদল হয়েছে সেটা অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষ বলে নলডাঙ্গাবাসী মনে করে। আর এই বিষয়টি কিভাবে নলডাঙ্গা উপজেলা প্রশাসন অস্বীকার করবে বা এড়িয়ে যাবে। উপজেলার কৃষকদের আশঙ্কা -কৃষি জমি যেভাবে কমছে, তাতে এক সময় হয়ত ভাতের বদলে শুধু মাছ খেতে হবে।

সম্প্রতি নলডাঙ্গা উপজেলায় একটি কথা সকলের মুখে মুখে শোনা যায়, “যেই জমিতে একবার ভেকু মেশিন নামে, সেটা পুকুর হবেই।” সেক্ষেত্রে এতটুকু হলেও কি দায় এড়ানো সম্ভব কর্তৃপক্ষের !

আরও দেখুন

পুঠিয়ায় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে রাতের আঁধারে চলছে পুকুর খনন

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহীর পুঠিয়ায় রাতের আঁধারে ফসলি জমিতে পুকুর খননের হিড়িক পড়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, পুকুর …