নীড় পাতা / ই-লার্নিং / নাটোরের গর্ব স্বপ্নজয়ী মৌমিতা ঘোষ

নাটোরের গর্ব স্বপ্নজয়ী মৌমিতা ঘোষ

নাটোরের গর্ব স্বপ্নজয়ী মৌমিতা ঘোষ -জুয়েল রানা

যে শিশুরা কথা বলতে পারে না, শুনতে পায় না, শারিরিকভাবে চলাফেরা করতে পর্যন্ত অক্ষম, তারাও কম্পিউটার শিখে ডাটাএন্ট্রি করবে, প্রোগ্রামিং শিখে গেইম তৈরি করবে, গ্রাফিক্স শিখে ভবিষ্যতে স্বাবলম্বী ও ফ্রিল্যান্সার হওয়ার স্বপ্ন দেখবে। অনেকেই কখনো কল্পনাও করতে পারবেন এমনটা। কিন্তু সকল জল্পপনা-কল্পনাকে বাস্তবে প্রতিফলন ঘটালেন নাটোরে ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত ‘উই এ্যাবল’ নামক একটি প্রজেক্টের নির্বাহী পরিচালক মৌমিতা ঘোষ।

নাটোরের কানাইখালীতে অবস্থিত মৌ ভিডিও এন্ড এডিটিং সেন্টারের প্রোপ্রাইটর ধীরাজ চন্দ্র ঘোষ ও স্বপ্না রানী ঘোষের একমাত্র সন্তান। ২০১৬  সালে অসুস্থ জনিত করণে ধীরাজ চন্দ্র ঘোষ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সে সময় মৌমিতার একদিকে পড়ালেখা অন্যদিকে সংসার চালানোর দায়িত্ব পড়ে। তখন সে নাটোর সিরাজ-উদ্-দৌল্লা সরকারি কলেজের অর্নাস তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। সে সময় বাবাকে হারিয়ে মৌমিতা নিরুপায় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া অবস্থায় কর্মজীবনে পা রাখেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি নাটোর আইটি ইন্সটিটিউট নামক একটি আইটি কোম্পানিতে গ্রাফিক্স ডিজাইন কোর্সের প্রশিক্ষক হিসেবে চাকুরী শুরু করেন। একই সময়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ কর্তৃক স্থাপিত নাটোর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ল্যাব কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কাজের প্রতি তাঁর অগাধ ভালবাসা, দক্ষতা ও নিষ্ঠার ফলে মাত্র ১ বছরের মধ্যেই নাটোর আইটি ইন্সটিটিউটের পরিচালক (এডমিন) এবং শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবের সহকারি জেলা সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন।

নাটোর আইটি ইন্সটিটিউটে কাজ করার সময় প্রায়ই মৌমিতা লক্ষ্য করতেন, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু, তরুণ-তরুণীরা কম্পিউটার শিখতে আসতো যাদের জন্য স্পেশাল কোনো কোর্সের ব্যবস্থা না থাকায় ভালমতো প্রশিক্ষণ পেতো না। এছাড়াও বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের ইশারা ভাষা বোঝার মত ভালো কোনো প্রশিক্ষক ছিল না। ফলে তারা প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তো। এছাড়াও আদিবাসী ছেলে-মেয়েরা অর্থের অভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণে পিছিয়ে রয়েছে। এই সকল বিভিন্ন বিষয় মৌমিতাকে ভাবিয়ে তোলে। শুরু হয় ইশারা ভাষা জানা ও বোঝার প্রচেষ্টা। এ বিষয়ে নাটোরের বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী স্কুলের শিক্ষকদের সহযোগিতা চাইলে, তারাও এগিয়ে আসেন। প্রায় ১ মাস কঠোর পরিশ্রম ও প্রচেষ্টার ফলে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের ভাষা আয়ত্ত করেন। সমাজের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু ও আদিবাসী ছেলে-মেয়েরা যে পরিবার ও সমাজের বোঝা নয় বরং তারাও তথ্যপ্রযুত্তির মাধ্যমে স্বাবলম্বী ও আত্নকর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে। আমরা অক্ষম না বরং সক্ষম চিন্তা-ভাবনা থেকেই ‘উই এ্যাবল’ নামক একটি প্রজেক্ট গ্রহণ করেন। প্রজেক্টের আওতায় বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু-তরুণ-তরুণী ও আদিবাসী ছেলে-মেয়েদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেন। তার এই বিশেষ উদ্যোগের পাশে টেকনিক্যাল ও ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে পাশে দাঁড়ায় নাটোর আইটি ইন্সটিটিউট কর্তৃপক্ষ।

তথ্যপ্রযুক্তিতে তার এই বিশেষ উদ্যোগের কথা জানার পরে পাশে দাঁড়ান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এমপি, নাটোর-২ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল এমপি, নাটোর পৌরসভার মেয়র উমা চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক সৈয়দ মোর্ত্তজা আলী বাবলু, দপ্তর সম্পাদক দিলীপ কুমার দাস ও গণমাধ্যম কর্মী সহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আরও অনেকে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ কর্তৃক নাটোরে স্থাপিত শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টারের ‘উই এ্যাবল’ প্রজেক্টের জন্য বরাদ্দকৃত ১০ নং সেলে এই সকল প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু-ছেলে-মেয়েরা ও আদিবাসী ছেলে-মেয়েরা মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে তারা বেসিক কম্পিউটার শেষ করে প্রোগ্রামিং ও গ্রাফিক্স ডিজাইন শিখছে। এখন অনেকেই প্রোগ্রামিং শিখে গেইম তৈরি করার মত দুঃসাহসিকতায় সফলতা অর্জন করেছে। এখন অনেকেই গ্রাফিক্স শিখে স্বাবলম্বী ও আত্নকর্মসংস্থান সৃষ্টির করে পরিবারের অর্থের আয়ের কথা ভাবছেন। আবার অনেকে এই প্রশিক্ষণ শেষে তার মত অন্যদেরকেও এমন প্রশিক্ষণ প্রদানের চিন্তা-ভাবনা করছে।

ইতিমধ্যে গত ২২শে নভেম্বর ২০১৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয় এর সাথে ‘উই এ্যাবল’ প্রজেক্টের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম নিয়ে মৌমিতা দেখা করেন এবং কথা বলেন। তাঁর এমন উদ্যোগকে স্বাগতম জানিয়ে তিনি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের কথা জানান। এ বিষয়ে উই এ্যাবল প্রজেক্টের নির্বাহী পরিচালক মৌমিতা ঘোষ বলেন, বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কেউ পরিবারের বোঝা হবে না বরং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজে স্বাবলম্বী হবে এবং পরিবারের আয়ের উৎস হবে। ভবিষ্যতে সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেলে প্রান্তিক পর্যায়ে এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বিস্তার ঘটবে বলেও জানা যায়।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে মৌমিতা ঘোষ নাটোর আইটি ইন্সটিটিউটের প্রশিক্ষক ও শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবের ল্যাব কোর্ডিনেটর হিসেবে কর্মজীবনের যাত্রা শুরু করেন। একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকেই দেশ ও সমাজের জন্য কিছু করার নতুন চিন্তা-ভাবনা করেন। তারই প্রতিফলন হিসেবে মৌমিতা ঘোষ তার ব্যতিক্রমি চিন্তা-ভাবনা ও স্বপ্ন থেকেই উই এ্যাবল প্রজেক্ট হাতে নেয়। এর আওতায় সমাজের পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠী বিশেষ করে আদিবাসী ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু-ছেলে-মেয়েদের তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার বিশেষ উদ্যোগ। ২০১৯ সালে চাকুরীর পাশিপাশি  নাটোর আইটি ইন্সটিটিউটের সার্বিক সহযোগিতায় ‘উই এ্যাবল’ প্রজেক্টের মাধ্যমে সমাজের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু-তরুণ-তরুণী ও আদিবাসী ছেলে-মেয়েদের বিনামূল্যে কম্পিউটার ও আউটসোর্সিং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেন। প্রকল্পের আওতায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫৭ জন শিশু-তরুণ-তরুণীকে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে।

লেখক:
জুয়েল রানা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, নাটোর আইটি ইন্সটিটিউট

আরও দেখুন

বাউয়েটে অনুষ্ঠিত হলো প্রযুক্তি ভিত্তিক প্রতিযোগিতা মাইন্ড স্টর্ম ৫.০

নিজস্ব প্রতিবেদক: নাটোরে বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি তে অনুষ্ঠিত হলো প্রযুক্তি ভিত্তিক …