নীড় পাতা / ফিচার / ছেলেবেলার ঈদ ও নজরুল

ছেলেবেলার ঈদ ও নজরুল

সুরজিত সরকার

আজ ঈদ। কাজী নজরুল ইসলামের আজ জম্মদিন ইংরেজি তারিখ অনুসারে। বিদ্রোহী কবি নামে সমাধিক পরিচিত কবির সাহিত্য সংসারে শুধু বিদ্রোহ ছিল না। বরং ছিল প্রেম ভালোবাসা, সৃষ্টিকর্তার প্রতি পরম প্রেম। নজরুলের অমর সৃষ্টি ছাড়া বাঙ্গালীর ঈদ উদযাপন ফিকে হয়ে যায়। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। একমাস রোজা শেষে যেদিন সন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশে কোটি কোটি জোড়া চোখ পলকহীন চাতক হয়ে থাকে চিকন বাঁকা চাঁদের হাসি দেখার জন্য। একবার নজরে আসতেই দূর আকাশ থেকে চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বে।

ওই যে…ওই যে… ওই…. গাছের ডান কোণে উপরে এরকম কত স্মৃতি নিয়ে আসে ঈদ। ভাসা মেঘের মধ্যে আবছা চাঁদ। কানে সাইরেন, মনের ভেতরে বেজে উঠা গানটি ঠোঁটে ঠোঁটে বেজে উঠে, “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।” এবার ঋতুচক্রে কবির জম্মদিন ঈদের দিনে। নজরুল জম্মজয়ন্তীতে নজরুলের পক্ষ থেকে বাঙ্গালীকে দেয়া শ্রেষ্ঠ উপহার বাজছে এবার। এ এক মহামিলন বাঙ্গালীর উদযাপনের আবেগের। কবির শিষ্য শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদের অনুরোধে ১৯৩১ সালে কবি রচনা করেন গানটি এবং নিজেই সুর দেন। লেখার চার দিন পর শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের গলায় গানটি রেকর্ড করা হয়। রেকর্ড করার দুই মাস পরে ঈদের ঠিক আগে আগে এই রেকর্ড প্রকাশ করা হয়। গ্রামোফোন কোম্পানি গানটি রেকর্ড ও প্রকাশ করে। রেকর্ডের অপর গান ছিল ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর, বদনসীন আয়, আয় গুনাহগার নতুন করে সওদা কর। ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ করা হয় গানগুলো।

ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া ঈদ সারা জীবন ধরে খুঁজে বেড়াতে হয় তারপরও পাওয়া যায়না। সে সময় এত প্রযুক্তি ছিলনা। চিরায়ত নিয়মের দিকে চেয়ে সকলে পালন করত। ধীরে ধীরে আধুনিকায়ন হতে লাগল উদযাপন গুলো, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হওয়া। যান্ত্রিকতার মিশেলে খেই হারিয়ে বসল ছোটবেলার আবেগ। সাধারণত রমজান মাস শুরু হত শীতকালে। ভোর রাতে লেপের মধ্যে শুয়ে মসজিদের মাইকে শোনা, “উঠুন সেহেরি খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তারপরও লেপের উষ্ণ আদর ছেড়ে উঠতে যে বড্ড কষ্ট। বাড়ি বাড়ি রান্নার গন্ধ শীতের কুয়াশাকে ভেদ করত। মায়েদের তবুও উঠতে হয়। শীতকালের রমজান, ঈদ হয়ত আমৃত্যু সেরা হয়ে থাকবে ছোটবেলার জন্য।

মেয়েদের জন্য পরম আনন্দের বিষয় ছিল সাতাশ রোজা থেকে এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে মেহেদির খোঁজ করা। মেহেদি পাওয়ার পরে আরেক ঝক্কি, সেটাকে খয়েরের সঙ্গে মিশিয়ে পাটায় মিহি করে বাটতে হতো। এখন আর সে চল নেই সে জায়গা নিয়েছে বিভিন্ন কোম্পানীর টিউব মেহেদি। এখনকার মত ছুঁচালো ছিল না টিউব বেশির ভাগ সময় ব্যবহার হতো মাচের কাঠি ডিজাইনের জন্য।

ঈদ বাজারে বাবা-মায়ের পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে নিয়ে আসা জামা জুতা যেন সাত রাজার মণি মাণিক্য। ঈদের দিন সকাল হবার আগ পর্যন্ত রাতেই ঘুমানোর আগে মাথার কাছে থাকত। বারবার খুলে দেখা ঠিক আছে কিনা। নতুন কাপড়ের গন্ধ। সে এক বিশাল আনন্দ। এরপর আসে শেষ রোজার ইফতারির পর সকলের দৃষ্টি পশ্চিম আকাশে। একবার কোন রকম দেখতে পেলেই হলো শুরু হয়ে যায় ঈদ। আর যদি দেখা না যায় তাহলে, শীতের রাতে বিটিভির রাত আটটার বাংলা সংবাদ বা সাড়ে দশটার ইংরেজি সংবাদ সেখানে পঞ্চ ইন্দ্রিয় এক সঙ্গে যদি বলে সকালে ঈদ। সবার বাড়িতে টিভি থাকত নানা। তবুও জানতে হবে সকালে ঈদ হচ্ছে তো! তারপর গ্রামের মসজিদের মাইকে ঘোষণা, ঈদ মোবারক… ঈদ মোবারক… উত্তেজনায় যেন ঘুম আসেনা। এদিকে সকালে ঘুম থেকে উঠার তাড়া। আজ আর লেপের আদর আটকে রাখতে পারে না। ঠান্ডার মধ্য গোসলের কষ্ট মজাই যেন আলাদা। গোসল শেষে ঈদ জাামত। তারপর দিনভর ঘুরে বেড়ানো বাঁধন হারা হয়ে।

কোথায় হারিয়ে গেল সেই অল্পতে হাজার গুণ খুশি। এখন যে হাজার গুণেও অল্প হাসি পায়না। ঈদের আনন্দকে ছাপিয়ে যায় ছেলেবেলার হারিয়ে ফেলা ঈদের আনন্দকে ফিরে পাবার হাহাকার। তারপরও যেন ঈদ আসে। একটু বারের জন্য চোখের সামনে ভেসে উঠে ভাসা মেঘের মত ছেলেবেলা। এবারের ঈদ একেবারে অন্যরকম। এবারের ঈদ কষ্টের, এবারের ঈদ বেদনার। এবারের ঈদ স্বজন হারানোর এবং বন্দী দশার। তবুও, তবুও নতুন সকাল আসবেই। ছোট বেলায় পড়া পাঠ্য বইয়ে, আজ ঈদ মদিনার ঘরে ঘরে আনন্দ। সেই আনন্দ আসবেই ফিরে সকলের ঘরে সকলের মনে। বলতে ইচ্ছা করে কবির সুরে কণ্ঠ মিলিয়ে, ‘তোরে মারল ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইঁট পাথর যারা, সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ। ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।’

কবি আজ জম্মদিনে তোমাকে ঈদ মোবারক। তুমি ছাড়া হয়ত বাঙ্গালীর ঈদ কিছুটা হলেও অপূর্ণ থেকে যেত। প্রায় নব্বই বছর ধরে সে পূর্ণতার স্বাদ পেয়ে আসছে বাঙ্গালী। ঈদ মোবারক। সকলে ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, নিরাপদে থাকুন। পৃথিবীর বুকে মানুষের হাতে করোনা পরাজিত হবে। আবার সবাই মিলে গেয়ে উঠব, ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ…

আরও দেখুন

কবি নাজনীন নাহার এর কবিতা “আমি মানুষ’’

আমি মানুষ! নাজনীন নাহারআমি মানুষ!হ্যাঁ আমি মানুষ।আমি অমানুষের করি নাশ,মানচিত্র থেকে মুছে দেবো আমি অমানুষদের …