নীড় পাতা / সাহিত্য ও সংস্কৃতি / কবি সৌভিক দে রায়ে’র গল্প ‘ ত্যাগব্রতী’

কবি সৌভিক দে রায়ে’র গল্প ‘ ত্যাগব্রতী’

গল্প : ত্যাগব্রতী
(একটি অতি নাটকিয় প্রেক্ষাপটে)

সকাল থেকেই অবিরাম বৃষ্টিতে ভিজে চলেছে তিলোত্তমা কলকাতা। শেক্সপিয়ারের Hamlet টা টেবিলে রেখে জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো রিচার্ড। তারপর স্মোকিং পাইপ থেকে খানিক ধোঁয়া নিঃসরণ করে বললো – Oh! What a splendid weather it is. অগোছালো কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে স্মৃতির সংগ্রহশালা থেকে তখন রিচার্ড খুঁজে পেতে চাইছিল তার শৈশবের স্মৃতি জড়ানো ইংল্যান্ডের নটিংহ্যাম শহরকে। সেখানে ক্যারিংটন, আরবোরটাম পার্ক, হাইফিল্ডস পার্কে বসে কতো দিনই না এমন বারিদৃশ্য উপভোগ করেছে সে। তবে আজ সে সব স্মৃতির
প্রদর্শশালায় সুসজ্জিত। মনে মনে ভাবলো, এমন নান্দনিক পরিবেশকে অমরত্ব করে রাখার জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীতের
বিকল্প নেই।

ভাবলেও অবাক লাগে, একজন খাঁটি বিলেতির চিত্তে এতোখানি বাংলা সংস্কৃতির ছাপ! আসলে কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ারস কলেজে পড়ার সময় বাংলা সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার উপর গভীর ভাবে প্রভাবিত হয় রিচার্ড।শেক্সপিয়ার, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলি, কিটস এদের পাশাপাশি রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম সমান ভাবে গুরুত্ব পেতে থাকেন তার জ্ঞানের পাঠাগারে।

রিচার্ডের প্রিয় গ্র্যান্ড ওল্ড ব্ল্যাক পিয়ানোটা কদিন ধরে বেশ নিঃসঙ্গার মধ্যে দিন যাপন করছিল, দেখে মনে হচ্ছিলো, তার সান্নিধ্য না পেয়ে সে যেনো একেবারে মুছরে পড়েছে। ঠিক যেমন জলের অভাবে গাছ ঝিমিয়ে পড়ে। স্ট্যান্ড তুলে স্মোকিং পাইপে হালকা টান দিয়ে রিচার্ড শুরু করলো রবি ঠাকুরের ‘পুরোনো সেই দিনের কথা…..’ বেশ ভালই চলছিলো। সুরের ছন্দপতন হল টেলিফোনের ডাকে। রিসিভার তুলতেই ও প্রান্ত থেকে ভেসে এলো এক মাঝ বয়সি নারীর দুর্বল স্নায়বিক কন্ঠস্বর।

মহিলা : Hello, May I speak to Mr. Thomson? I mean Mr. Richard
Thomson?

রিচার্ড : Yes, Richard speaking. Who are you?
ভদ্রমহিলা কয়েক সেকেন্ড নিরব রইলো। তারপর বলল Hello I am…………

রিচার্ড : Hello, myself Richard. Please tell.

ভদ্রমহিলা আবার নীরব। কন্ঠ আরষ্ট হয়ে আসছে। আর হবেই বা না কেনো? সময়ের ব্যবধানটা
যে প্রায় তিন যুগেরো বেশি। চূড়ান্ত উদ্দীপনার বশে না হয় ফোনটা করেই বসেছেন। কিন্তু
এবার? শুরু করবেন কি করে?
মনে সাহস সঞ্চার করে বললেন…

ভদ্রমহিলা : Do you know me Richard? I am….
I am Rina. Rina Ganguly.

রিচার্ড : What? Rina? I can’t believe myself. I can’t believe my ear. কি
বলছো তুমি? তুমি রিনা?

রিনা : একি রিচার্ড? তুমি বাংলা বলতে পারো? It’s amazing…

রিচার্ড : তোমাদের শহরে আশ্রয় দিয়েছ, অথচ তোমাদের পবিত্র ভাষা শিখব না? তাই কখনো
হয়? কিন্তু How is it possible Rina? Still I can’t believe darling. But তুমি
আমার সন্ধান পেলে কোথায়? I mean how do you get my number?

রিনা : বলবো বলবো ডিয়ার। সব বলবো। ওইজন্যই তো ফোন করলাম। তোমার হাতে সময় আছে
তো? তারপর বলো কেমন আছো?

রিচার্ড : আর, কেমন আছি? এটা তো তোমার থেকে ভালো কেউ জানবে না রিনা। তুমি কেমন
আছো রিনা?

রিনা মুচকি হাসল। বললো..
রিনা : ওই, তোমাদের প্রভু যীশুর আশীর্বাদে মন্দ নেই, তবে তোমার মতো নয়।

রিচার্ড : আমার মতো নয় মানে?

রিনা : কিছু না। আচ্ছা তোমার দেশের খবর কি বলো?

রিচার্ড : তুমি দার্জিলিং থেকে চলে আসার দু বছর পর পাহাড়ের পাঠ চুকিয়ে সমতলে ফিরলাম।
ফিরেই দেশ থেকে চিঠি পেলাম। জরুরি তলব। সেখানে গিয়ে শুনলাম, স্কটল্যান্ডের এক ধনী
ব্যবসায়ী কন্যার সঙ্গে আমার বিয়ে প্রায় পাকাপাকি। কিন্তু হিয়ার মাঝে তোমার কর্তৃত্বকে
অস্বীকার করি কি করে? বেঁকে বসলাম আমি। সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে ফিরলাম কলকাতায়।
জানো রিনা, কলকাতায় ফিরে তন্ন তন্ন করে দিন রাত এক করে খুঁজছি তোমাকে। কিন্তু………..

রিনা : পেতে তো আমিও চেয়েছিলাম ডিয়ার। কিন্তু পেলাম আর কই?

রিচার্ড থমসন : মনে পড়ে রিনা?
তোমার আমার সেই দার্জিলিং এর মাউন্ট হারমন স্কুলের দিনগুলো।

রিনা : সে মনে নেই আবার? দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমরা একত্রে জড়ো হয়েছিলাম
সেন্ট অ্যানড্রুস চর্চে। প্রার্থনা সেরে ফাদার জোসেফ এবং কিছু ব্রিটিশ কর্তা আমাদের
যত্নসহকারে নিয়ে গেলেন মাউন্ট হারমনের গন্ডীর ভেতর।

রিচার্ড : জানো রিনা, যেদিন প্রথম তোমায় দেখি, তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে আমার সবথেকে প্রিয় ওই
পাইন গাছটার নিচে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা যেনো গাছের পাতা বেয়ে তোমার সর্বাঙ্গের
তৃষ্ণা মিটিয়ে দিচ্ছিল। আমি মুগ্ধ হয়ে শুধু চেয়েছিলাম তোমার অবয়ব ভঙ্গির দিকে। চোখে চোখ
পড়তেই তুমি লজ্জাবতী পাতার মতো নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে চলে গেলে। অবশ্য নিরাশ করোনি
আমায়। যাওয়ার সময়ে ঠোঁটের কোণে হালকা একটা হাসি উপহার স্বরূপ দিয়ে গেছিলে।

রিনা : বব্বা! কতো রোমান্টিক উনি। যেনো শেক্সপিয়ারের The Tempest কেও হার মানিয়ে
যায়। তবে আপনার ক্রিয়াকলাপও আমার চোখ এড়িয়ে যায়নি মশাই। প্রতি বিকেলে তুমি যখন
ম্যালে গিটার নিয়ে বসতে, আমি ক্যাভেন্টরের ব্যালকনি থেকে কুয়াশার চাদর সরিয়ে তোমাকে
খুঁজে নিতাম প্রতিনিয়ত। পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম সূর্যাস্তের আভা এসে ঘুমিয়ে পড়তো তোমার
গিটারের উপর। পাহাড়ি পাখিগুলো তোমার সুরে তাল মেলাবে বলে নিশ্চুপ হয়ে যেত। অনন্তকালধরে
পাহাড়ের বুক চিঁরে আবহমান জলরাশিরাও খানিক থমকে দাঁড়াত তোমার গিটারের কথা শুনবে বলে।
তারপর তোমার আঙুলের স্পর্শে গিটারের স্ট্রিংগুলোর অনবদ্য সুরেলা কম্পনে মত্ত হয়ে উঠত
চারিদিক। যেনো নতুন করে আবার প্রাণ সঞ্চার হতো শৈলচিত্তে।
জানো প্রিয়, তুমি যখন চার্চে যেতে আমি ভুল করে তোমার পথ অনুসরণ করতাম প্রত্যহ। শেষের
বেঞ্চে বসে তোমার নৈষ্ঠিক প্রার্থনায় আমি মোহিত হয়েছি বারংবার।

রিচার্ড : Oh really? Ho.. Ho…। অথচ আমি এসবের কিছুই বুঝতে পারি নি ডিয়ার। আর
যখন বুঝলাম তখন…………….

আজ সকাল থেকে অবিরাম বৃষ্টিতে ভিজে চলেছে তিলোত্তমা কলকাতা। আমার প্রাণের শহর।
জানো রিনা লোকে সর্বদা প্রশ্ন করে – খাস বিলেতি হয়েও কলকাতার প্রতি এতো টান কিসের?
আচ্ছা তুমিই বলো, বিলেতি হয়ে যদি একজন খাস বাঙালি নারীর টানে আবদ্ধ হতে পারি, তবে
কলকাতার প্রতি টান না থাকা এ আর অস্বাভাবিক কি? বাঙালি আর কলকাতা তো একই
আত্মারই দুই আত্মীয়। তাই না?
প্রকৃতির এই বিশেষ মুহূর্তটা আমাকে আজও ভুলতে দেয়না সেদিনের কথা। যেদিন এমনই এক
বর্ষামুখর প্রভাতে  তুমি………………..

রিনা : কি হলো? ও বুঝেছি….। সেই ১৭ই শ্রাবণের কথা ভাবছ তো? তারিখটা মনের মনিকোঠায়
আজও দগদগে। সেদিনের অভিশপ্ত মুহূর্তগুলোর জন্য আমিই দায়ী ছিলাম। তুমি ঠিকই বলেছ
রিচার্ড। সেদিনটা ছিলো ঠিক আজকের মতোই নান্দনিক। পার্থক্য শুধু মুহূর্তের। বিশ্বাস করো,
তখনও পর্যন্ত যা পারিনি সেদিন তা-ই পারতে গেছিলাম, জিততে গেছিলাম তোমার হৃদয়।
অন্তরের উদ্যমী মনোভাবকে জাগ্রত করে এগিয়ে গেছিলাম মনের কথাটুকু বলতে। কিন্তু
তোমাদের হস্টেলে ঢুকতেই ধরা পড়ে গেলাম আমি। হেরে গেলাম নিজের কাছে। বোর্ড অফ
কন্ট্রোলের নির্দেশে বরখাস্ত হয়ে গেলাম সাত দিনের মধ্যে। মুহূর্তের দমকা হাওয়ায় সবকিছু
যেনো এলোমেলো হয়ে গেলো।

রিচার্ড : কে বলেছে তুমি হেরে গেছো? তোমার কাছ থেকে সেদিন যা কিছু বাজেয়াপ্ত করা
হয়েছিলো পরবর্তী কালে সেসব আমাকে দেখানো হয়। তার মধ্যে বিশিষ্ট ছিল লাল রঙের একটা
ডায়েরি। যেখানে অজস্রবার তোমার কলমে বিখ্যাত হয়েছি আমি। একজন বাঙালি যে কতোটা
পবিত্র এবং নিষ্ঠার সঙ্গে ভালোবাসতে জানে তা সমগ্র স্কুলের কাছে সেদিন প্রমাণ করে
দিয়েছিলে তুমি। তাৎক্ষণিক যথার্থ মুল্য হয়তো সেদিন পাওনি তুমি, কিন্তু ভালোবাসার যে

জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত তুমি রেখে দিয়ে গেছিলে মাউন্ট হারমনের প্রতিটি কোণে, তা কখনো দাম দিয়ে
কেনা যায় না রিনা।
তারপর বলো… বিয়ে করলে কবে? husband কি করেন?

রিনা : বিয়ে? husband? তুমি আমাকে এতটা অকৃতজ্ঞ ভাবো রিচার্ড?

রিচার্ড : কেনো রিনা? হটাৎ এইরকম বলছো?

রিনা : তুমি আজও আমাকে চিনতে পারোনি রিচার্ড। চিনলে বিয়ে, husband এইসব প্রসঙ্গই
আসতো না।

রিচার্ড : ও বুঝেছি। তবে যতোই হোক, জীবনকে নিয়ে এইভাবে ছেলেমানুষি করা তোমার মোটেই
উচিৎ হয়নি রিনা।

রিনা : ছেলেমানুষি তো তুমিও কিছু কম করনি রিচার্ড। বিয়ে তো তুমিও করলে না।

রিচার্ড : what? তুমি জানলে কি করে? রিনা আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তুমি আমার সমন্ধে
জানলে কি করে? আর আমার নম্বরই বা পেলে কোথায়? প্লিজ আমাকে সব খুলে বলো।

রিনা : তুমি সুশান্তকে চেনো?

রিচার্ড : সুশান্ত?

রিনা : হ্যাঁ, সুশান্ত বোস।

রিচার্ড : ও হ্যাঁ, সুশান্ত বোস। সে তো বিগত এক বছর ধরে আমার কাছে এডিটিং শিখতে আসে।
তবে ওর সাথে আরো কয়েকজন আসে। কিন্তু সুশান্ত এখানে কিভাবে সম্পর্কিত?

রিনা : সুশান্ত আমার কাছে ইংরেজী পড়ে।

রিচার্ড : I see….. তার মানে?

রিনা : আজ্ঞে হ্যাঁ সাহেব। এবার পরিষ্কার হলো তোমাকে ছেলেমানুষ বলার কারণ?

রিচার্ড : বুঝলাম। কিন্তু এইভাবে জীবনটা নষ্ট না করলেই পারতে রিনা। আমি হলাম গিয়ে
ব্যাচেলর মানুষ, পেটের দায়ে সাংবাদিকতার কাজে হিল্লী দিল্লী করে বেড়াতে হয়। কাজের ফাঁকে
কষ্টগুলো ভুলে থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু তুমি?
রিনা আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই এবং সেটা তোমার নিজের বাড়িতেই। তোমার ঠিকানা দাও
প্লিজ।

রিনা : নিজের বাড়ি? ঠিকানা? হা… হা… হা… হা…. সেইসব বহুদিন আগের কথা সাহেব।

রিচার্ড : মানে? What do you mean Rina?

রিনা : আমাদের পাম এভিনিউ এর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছি প্রায় ত্রিশ বছর আগে। সেই থেকে
আমার ঠিকানা শ্যামবাজারের কাছে একটা পোড়ো বাড়ির ভাঙা ঘর। যদিও ভাড়া টা অনেকটাই
নগন্য।

রিচার্ড : পাম এভিনিউ এর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছি, শ্যামবাজার, পোড়ো বাড়ির ভাঙা ঘর
এইসব কি বলছ তুমি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

রিনা : দার্জিলিং থেকে ফিরে আসার পর একপ্রকার গৃহবন্দিই ছিলাম বলতে পারো। তারপর
লরেটো ডে থেকে স্কুল ফাইনাল পাশ করার পর ভর্তি হলাম প্রেসিডেন্সি কলেজে। ঠিক সেই
সময়েই মা বাপি একের পর এক সম্বন্ধ নিয়ে আসতে থাকেন। কিন্তু আমার চিত্তপটে তোমার

প্রতিচ্ছবি তখনও জাজ্বল্যমান। এমতাবস্থায় আমি কি করে একজন পুরুষকে তোমার আসনে
স্থান দেব?

রিচার্ড নিশ্চুপ থাকলো..

রিনা : মা বাপি কে একদিন আমি তোমার কথা বিস্তারিত ভাবে সব বললাম, এমনকি মাউন্ট
হারমনে পড়ার সময়ে তোমার উপর আমার অনুভূতি, আবেগের কথাগুলোও সব খুলে বললাম। এবং
সবশেষে সরাসরি জানিয়ে দিলাম বিয়ে যখন করতেই হবে তখন তোমাকেই করবো। ধৈর্য্যৈর বাধ
ভাঙল মা বাপির। ওঁনারা আমার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে বাড়ি বিক্রি করে দিলেন এবং
স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি যা ছিলো সবকিছু আশ্রমে দান করে চলে গেলেন। তারপর থেকেই
আমার নতুন ঠিকানা হল শ্যামবাজারের ওই পোড়ো বাড়ি। কোনোরকমে টিউশন পড়িয়ে কলেজ পাশ
করি এবং পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপিকার চাকরিতে যোগদান করি।

রিচার্ড : oh no!। আমি তো এসবের কিছুই জানতাম না। আর জানবোই বা কি করে? মাউন্ট
হারমন ছেড়ে চলি।আসার আজ প্রায় পয়ত্রিশ বছর পর তোমার সাথে কথা হচ্ছে। তার আগে
আমিও বহুবার তোমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমি বারবার ব্যর্থ হয়েছি।
যোগাযোগের আশা বলতে গেলে প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। অথচ কি অদ্ভুত এই ভাগ্যের পরিহাস
দেখো রিনা, সুশান্তের মাধ্যমেই আজ এতো বছর পর আমরা আমাদের খুঁজে পেলাম।

রিনা : ছিলাম আমরা এ শহরের বুকেই, শুধু যোগাযোগের বিচ্ছিন্নতার দায়ে চলে গেছিলাম লক্ষ
লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে। মাঝখান থেকে নীরবতার স্রোতে ভেসে গেছে পয়ত্রিশটা বছর।

রিচার্ড :  ঈশ্বরের অশেষ কৃপা। এতোদিন পর আবার আমাদের মিলিয়ে দিয়েছেন। আচ্ছা রিনা,
এবার তো আমরা দেখা করতে পারি? অন্তত বাকি জীবনটা তো আমরা একসাথে কাটাতে পারি।

রিনা : তা আর হয় না রিচার্ড। এতগুলো বছর তো কষ্ট করেই কাটালে। আমার মতো একজন
রোগীর দায়িত্ব নিয়ে শেষ জীবনটাকে আর অন্তত অতিষ্ঠ করে তুলো না ডিয়ার। তাছাড়া সামনে
তোমার অনেক কাজ।

রিচার্ড : রোগী? What happen Rina? কি হয়েছে তোমার?

রিনা : ও কিছু না মাই ডিয়ার। তোমার অনেক সময় কেড়ে নিলাম তাই না রিচার্ড?

রিচার্ড : oh no Rina. Its too much. Please tell me the truth. What’s
wrong with you?

রিনা : আসলে বিগত সাত বছর ধরে আমি liver cancer এ আক্রান্ত। আর……

রিচার্ড : oh no! এ কি বলছো রিনাআর? আর কি? বলো রিনা। please.

রিনা : আমি….. আমি…..

রিচার্ড : রিনা প্লিজ। What happens?

রিনা : আমি অন্ধ হয়ে গেছি রিচার্ড। কতকটা এই রোগের প্রতিক্রিয়া বলতে পারো। দেখো না,
চোখ দুটো যে আমার সাথে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করবে এ আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।

রিচার্ড : রিনা তুমি আমাকে কি শোনাচ্ছ এইসব? আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না। আমি
তোমার সাথে দেখা করতে চাই রিনা, তোমার ঠিকানাটা দাও প্লিজ। please Rina let me
meet with you dear.

রিনা : ঠিক সময়ে আমার ছাত্ররা তোমাকে আমার বাড়ি নিয়ে আসবে। সেদিন না হয় আমাকে
দেখো। একটু ভালো করেই দেখো। আজ তোমার অনেক মূল্যবান সময় আমি নষ্ট করে দিলাম।

আসলে তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল রিচার্ড, তাই আর ফোন না করে থাকতে পারলাম না। ভালো
থেকো রিচার্ড। take care darling.

পারস্পরিক সাক্ষাতের সৌভাগ্য কারোরই আর হয়ে ওঠেনি। বলাবাহুল্য সম্ভব হয়নি। কারণ,
ডাক্তারদের বেঁধে দেওয়া সময়ের আগেই রিনা পাড়ি দেয় চির ঘুমের দেশে। হৃদয়দ্বয়ের স্মৃতির
পটে যে ছবিগুলো রঙিন ফ্রেমে সুসজ্জিত ছিলো, অপ্রত্যাশিত ঝড়ের তাণ্ডবে সেগুলো ভেঙে
চুরমার হয়ে গেছে। বেসামাল রিচার্ডের হৃদয়ে তখন শুধুই বিষাদের সুর। অন্ধকার, একাকীত্ব আর
একরাশ হতাশই যেনো হয়ে ওঠে নিত্যদিনের সঙ্গী। বেশ কিছু দিন পরে হারিয়ে যায় রিচার্ডও।
মাঝে পরে রয় দুটি প্রাণের চরম আত্মত্যাগের এক জ্বলন্ত নিদর্শন, যার প্রতিটি অক্ষর
চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে যায় ভালোবাসার সংজ্ঞাকে।

সৌভিক দে রায়

ধন্যবাদসহ,
সৌভিক দে রায়
কলকাতা

আরও দেখুন

কবি নাজনীন নাহার এর কবিতা “আমি মানুষ’’

আমি মানুষ! নাজনীন নাহারআমি মানুষ!হ্যাঁ আমি মানুষ।আমি অমানুষের করি নাশ,মানচিত্র থেকে মুছে দেবো আমি অমানুষদের …