নীড় পাতা / জেলা জুড়ে / আমরা কবে হচ্ছি মানুষ? দুর্ঘটনায় হারানো স্বামীর শেষ স্মৃতিটুকুও চুরি হয়ে গেল দীপ্তির !

আমরা কবে হচ্ছি মানুষ? দুর্ঘটনায় হারানো স্বামীর শেষ স্মৃতিটুকুও চুরি হয়ে গেল দীপ্তির !

বিশেষ প্রতিবেদক:
গত ৫ই জুন শুক্রবার নাটোরের হালতি বিলের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় নওগাঁর বদলগাছিতে ব্র্যাকে কর্মরত পাবনার মোস্তফা কামাল। ঘটনাস্থল থেকে নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতলে পৌঁছানোর পর তাদের ব্যাগ কে বা কারা চুরি করে নেয়। স্বামীর সঙ্গে তার শেষ স্মৃতিটুকু হারিয়ে হতবিহ্বল দীপ্তি। ৭ জুন দীপ্তির খালাতো ভাইয়ের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে খোঁজ খবর শুরু ক’রে মোস্তফা কামালের স্ত্রী নূর-ই ইয়াসমিন দীপ্তি’র সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে ঘটনার আদ্যপান্ত তুলে আনার চেষ্টা করেছেন নারদ বার্তার বিশেষ প্রতিবেদক সুরজিত সরকার।

হালতি বিলে সবে পানি আসা শুরু হয়েছে। কৃষকের ধান ও ভুট্টা ঘরে উঠানো একেবারেই শেষ পর্যায়ে। বিলের বুক চিরে সাদা ঢালাই রাস্তায় মটরসাইকেল ছুটে চলেছে। মটরসাইকেলের পেছনের দিকে বসে স্বামীর সঙ্গে বেশ ফুরফুরে মেজাজে দীপ্তি। মাঝে মাঝে স্বামী মোস্তফা কামাল দীপ্তিকে বিল দেখিয়ে দেখিয়ে বর্ণনা করছিলেন এখানকার জনজীবন ও সৌন্দর্য্য। একটু থেমে দীপ্তির মুঠোফোনে বেশকিছু ছবি ফ্রেম বন্দি করে নিয়ে আবার মটরসাইকেল চালু করলেন। ছবি তুলতে ভালো লাগে কামালের আর সঙ্গে স্ত্রী থাকলে তো কথাই নেই। মটরসাইকেল চলছে, পাল্লা দিয়ে কমছে গন্তব্যের দূরত্ব। ব্র্যাকের চাকুরে হিসেবে মটরসাইকেল চালোনায় বেশ দক্ষ কামাল কারণ তাকে বেশিরভাগ সময় মটরসাইকেল চালাতে হয়। হালতি বিলের একটি গ্রাম হালতি। এই গ্রামটি পার হয়ে কিছু দূর এগোতেই একটি ট্রলি সামনের দিকে। একই দিকে যাচ্ছে ট্রলিটি। মোস্তফা কামাল ট্রলিকে ওভারটেক করে সামনের দিকে এগিয়ে যায় ঠিকই তবে সামনে একটি খাদ। বর্ষায় দীর্ঘ সময় রাস্তাটি পানির নিচে থাকে। ভাঙ্গা অংশটি ঠিক করা হয়না অনেক দিন। এজন্য প্রায় সময় দুর্ঘটনা ঘটে। কামালের ক্ষেত্রেও ঘটল তাই। মটরসাইকেল নিয়ে পড়ে গেলেন রাস্তার বাম দিকটায়। কিছু সময় আগে পাশকাটিয়ে আসা ট্রলি মূর্হুতেই চাপা দিয়ে দেয় মটরসাইকেল সমেত কামাল ও দীপ্তিকে। যে ট্রলিকে পাশ কাটিয়ে আসলেন কিছুক্ষণ আগেই, সেই ট্রলি কিন্তু কামালকে গন্তব্যে পৌঁছে দিলেন যেখান থেকে কেউ ফিরতে পারে না। একটু আগেই দুটি মানুষ তাদের স্বপ্নের কত কত চাষ করছিলেন অথচ নিমিষেই সবকিছু স্তব্দ।

বিলের জমিতে কাজ করা কৃষকেরা ছুটে এসে উদ্ধার করেন কামাল ও দীপ্তিকে। রাস্তার এক কোণে কামাল আর ট্রলির নিচে থেকে দীপ্তিকে নিয়ে ভ্যানযোগে কাছেই পাটুল বাজারে। সেখান থেকে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে করে নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালে। দীপ্তি তখনও জানেন না তার স্বামী কামাল তাকে ছেড়ে চলে গেছেন সব কিছুর উর্দ্ধে।

ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে বসে দীপ্তি তার আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। হাসপাতালে একজন পরিচিত আসেন। দুর্ঘটনার সময় স্থানীয়রা তাদের জিনিষপত্র সঙ্গে দিয়ে দেন। হাসপাতালে এসে একদিকে স্বামীর অবস্থা নিয়ে অস্থির অন্য দিকে নিজের শরীরের জখমের যন্ত্রনায় কাতর দীপ্তির মনে ছিল না তাদের ব্যাগের কথা। তবে হাসপাতাল পর্যন্ত যে ব্যাগ সাথেই ছিল সেটা তার খুব ভালো ভাবে স্মরণে আছে। ব্যাগের কথা মনে পড়তেই খেয়াল করেন ব্যাগগুলো নেই।

কেউ একজন সুযোগ বুঝে ব্যাগগুলো নিজের মনে করে নিয়ে গেছেন হাসপাতাল থেকে।
একবার ভাবুন পাঠক, আমরা মানবিকতার কোন স্তরে বসবাস করছি। একজন স্ত্রী দুর্ঘটনায় আহত তখনও জানেন না স্বামীর কি অবস্থা। অথচ সুযোগ সন্ধানী কেউ একজন নিজের সুযোগ ঠিকই কাজে লাগালেন।

ব্যাগে হয়ত তেমন কিছু ছিলনা আমরা বলতেই পারি, দামের দিক দিয়ে বিচার করলে হয়তো সেটাই হবে। একজন মানুষ পৃথিবী থেকে চিরতরে চলে গেলেন, তার স্মৃতিগুলো আঁকড়ে তার পরিবারের মানুষগুলো বাঁচবে এটাই হয়ত স্বাভাবিক কিন্তু এখন কী করবেন তারা। স্বামীর সঙ্গে দুর্ঘটনার কিছু সময় আগে তোলা ছবিগুলো সেই মোবাইল ফোনে যেটিও চুরি হয়ে গেছে। ব্যাগে ছিল ঘড়ি, মটরসাইকেলের চাবি, মানিব্যাগ, হুওয়ায়ে ওয়ায় সেভেন মোবাইল, স্যামসাং ট্যাব, একজোড়া সোনার কানের দুল, আংটিসহ বেশ কিছু প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র।

দেড় বছরের বৈবাহিক জীবনে দুজন ছিলেন দুই জায়গায় চাকরি সূত্রে। সেই হিসেবে তাদের সংসার জীবন মাত্র সাত বা আট মাসের। নূর-ই ইয়াসমিন দীপ্তি’র যে ফোনটি চুরি হয়ে গেছে সেটাতে 01701545281 নম্বরের সিম ছিল।

এ বিষয়টি নিয়ে নাটোর সদর হাসপাতলে পরিচালক ডা: আনসারুল হকের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান যে, বিষয়টা তার জানা নেই তবে অফিসে গিয়ে খোঁজ করবেন এবং সিসি টিভি ফুটেজ দেখে চেষ্টা করবেন চোরকে শনাক্ত করতে। পাশাপাশি তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে বিভিন্ন ধরনের মানুষের অবাধ যাতায়াত থাকায় কে কোন মানসিকতার বোঝা মুশকিল। তারপরও যেহেতু বিষয়টি মর্মস্পর্শী সেজন্য আমি চেষ্টা করব এবং চাইব যেন মহিলাটি তার স্বামীর শেষ স্মৃতিটুকু অন্ততঃ ফিরে পান।

প্রিয় পাঠক, পুরো পৃথিবীতে দানবীয় যজ্ঞ চালাচ্ছে করোনা। আমাদের তবুও থামানো গেল না। সত্যিই আমরা এখনও শিক্ষা নিলাম না। আমাদের দেশে নাকি একটি স্বাভাবিক ঘটনা দুর্ঘটনা কবলিতদের উদ্ধারের সময় তাদের মূল্যবান জিনিষপত্র ছিনিয়ে নেয়া। এটা কি মানবিকতা নাকি আমরা নিষ্ঠুর অন্ধকারে ক্রমেই ডুবে যাচ্ছি! তবুও চাই। কী চাই আমরা নিজেরাও জানি না। আমাদের বিবেক বোধ অন্ধ হয়ে গেছে। দীপ্তির কান্না জড়িত বর্ণনার মধ্যে বেশির ভাগ সময় একটি কথাই বারবার বের হচ্ছিল, “ও ভাই… যদি ওগুলো পেতাম! টাকার দরকার নেই। শুধু ওর ব্যাগ, আর ফোনটা পেলে… ওর স্মৃতিটুকু ধরে রাখতে পারতাম…

আরও দেখুন

নাটোরে ছাত্রলীগ কর্মীকে কুপিয়ে জখম

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজনৈতিক পূর্ব শত্রুতার জেরে নাটোরে ছাত্রলীগের এক কর্মীকে কুপিয়ে জখম করেছে প্রতিপক্ষের লোকজন। …