শুক্রবার , এপ্রিল ২৬ ২০২৪
নীড় পাতা / জাতীয় / আমদানি কমছে, বাড়ছে রেমিট্যান্স, ফিরছে স্বস্তি

আমদানি কমছে, বাড়ছে রেমিট্যান্স, ফিরছে স্বস্তি

নিউজ ডেস্ক:
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টের ১১ দিনে পণ্য আমদানির জন্য ১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খুলেছেন দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। আগের মাস জুলাইয়ের এই ১১ দিনে ২ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল।

আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে অর্থনীতি; রিজার্ভ কমে ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে, বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) বিশাল ঘাটতিতে পড়ে ওলোটপালট হয়ে গেছে সব হিসাবনিকাশ। সেই আমদানি খরচ অর্ধেকে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টের ১১ দিনে পণ্য আমদানির জন্য ১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খুলেছেন দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। আগের মাস জুলাইয়ের এই ১১ দিনে ২ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। তার আগের মাস জুনের ১১ দিনে খোলা হয়েছিল ২ দশমিক ৩৩ বিলিরয়ন ডলারের এলসি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ৩৭ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক আর্থিক বছরে পণ্য আমদানিতে এত ব্যয় হয়নি।

অন্যদিকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহে ২০২০-২১ অর্থবছরের মতো উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। আগস্টের প্রথম ১০ দিনেই ৮১ কোটি ৩০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত বছরের আগস্টের একই সময়ের চেয়ে ২০ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি। এর আগে কোনো মাসেই ১০ দিনে এত বেশি রেমিট্যান্স কখনই আসেনি দেশে।

বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৯৫ টাকা) টাকার অঙ্কে ১০ দিনের রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৭ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা।

এ হিসাবে প্রতিদিন এসেছে ৮ কোটি ১৩ লাখ ডলার বা ৭৭২ কোটি টাকা।

বাজারে ডলারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ব্যাংকগুলো ১১০ টাকার বেশি দরেও রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। সে হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ আরও বেশি।

মাসের বাকি ২০ দিনেও এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে, এমন আশার কথা শুনিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জুলাই মাসের মতো আগস্ট মাসেও ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসবে।’

জুলাইয়ে ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার (২.১ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত ১৪ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে এটি বেশি ১২ শতাংশ।

প্রতি ডলার ৯৫ টাকা হিসাবে টাকার অঙ্কে ওই অর্থের পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত (১ মাস ১০ দিনে) ২৯১ কোটি (২.৯১ বিলিয়ন) ডলার দেশে এসেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি।

২০২১-২২ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত ২৫৪ কোটি ৭০ লাখ (২.৫৪ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।

করোনা মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ধাক্কায় ওলটপালট হয়ে যাওয়া অর্থনীতিতে কয়েক দিন আগে জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধিতে যখন দেশজুড়ে ক্ষোভ-হতাশা এবং আগামী দিনগুলোতে কী হবে, এই প্রশ্ন সবার মধ্যে, তখন স্বস্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের প্রবাহ। মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০২০-২১ অর্থবছরের কথা। ভরা করোনা মহামারির মধ্যেও ওই অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০১৯-২০) চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।

‘মহামারির মধ্যে ওই সময় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছিলেন প্রবাসীরা’- এই মন্তব্য করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় অর্থনীতিতে যে নতুন সংকট দেখা দিয়েছে, সেই সংকট কাটাতেও সবার আগে এগিয়ে এসেছেন প্রবাসীরা। আবার বেশি বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন।’

আরেক অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপের ফলে আমদানি কমতে শুরু করেছে। এই মুহূর্তে এটা সত্যিই স্বস্তির খবর। এভাবে আমদানি কমলে আর রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়লে খুব শিগগিরই আমাদের সংকট কেটে যাবে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন যেটা করতে হবে, সেটা হলো, ডলারের বাজারকে যে করেই হোক স্থিতিশীল করতে হবে। টাকাকে শক্তিশালী করতে হবে। আর এ জন্য কিছু সময়ের জন্য হলেও ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানো উচিৎ। তাহলে বাজারে টাকার সরবরাহ কমে আসবে; টাকার চাহিদা বাড়বে, ডলারের বিপরীতে শক্তিশারী হবে।

‘এই কাজটি এখন সরকারের নীতিনির্ধারক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জরুরিভিত্তিতে বিবেচনা করা উচিৎ বলে আমি মনে করি।’

২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে মন্দা দেখা দেয়। পুরো অর্থবছরে ২ হাজার ১০৩ কোটি (২১.০৩ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল; গড়ে প্রতিদিন ৫ কোটি ৭৬ লাখ ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।

প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় উল্লম্ফন ঘটে ২০২০-২১ অর্থবছরে। সে সময় ২ হাজার ৪৭৮ কোটি (২৪.৭৮ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। ওই অর্থবছরে প্রতিদিন গড়ে ৬ কোটি ৭৯ ডলার প্রবাসী আয় হিসেবে দেশে এসেছিল।

এসব হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে রেমিট্যান্সে রয়েছে ঊর্ধ্বগতি। এই প্রবণতা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে এবং এই অর্থবছরে নতুন রেকর্ড তৈরি হবে বলে মনে করছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘গত অর্থবছরে সাড়ে ৭ লাখ লোক কাজের সন্ধানে বিভিন্ন দেশে গেছেন। তারা ইতোমধ্যে রেমিট্যান্স পাঠাতে শুরু করেছেন। সে কারণেই ঈদের পরও রেমিট্যান্স বাড়ছে। এই ইতিবাচক ধারা পুরো অর্থবছর জুড়েই অব্যাহত থাকবে বলে আমরা আশা করছি।’

সাধারণত দুই ঈদের আগে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাড়ে; ঈদের পর কমে যায়। তবে এবার কোরবানির ঈদের আগে যে গতিতে রেমিট্যান্স এসেছে, সেই ধারা ঈদের পরেও অব্যাহত আছে।

দেশে গত ১০ জুলাই কোরবানির ঈদ উদযাপিত হয়। ঈদের আগে রেমিট্যান্স প্রবাহে ঢল নামে। ঈদের ৯০ কোটি ৯৩ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ঈদের পরে ২১ দিনে এসেছে ১১৮ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের কিছু বেশি।

ঈদের পরেও কেন রেমিট্যান্স বাড়ছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত কয়েক মাসে ডলারের দর বেশ খানিকটা বেড়েছে। প্রণোদনার পরিমাণ দুই শতাংশ থেকে আড়াই শতাংশ করা হয়েছে। এসব কারণে প্রবাসীরা এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। সে কারণেই বাড়ছে রেমিট্যান্স।’

তিনি বলেন, ‘এই সময়ে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির খুবই দরকার ছিল। নানা পদক্ষেপের কারণে আমদানি ব্যয় কমতে শুরু করেছে। রপ্তানির পাশাপাশি রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণে আশা করছি এখন মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।’

সে হিসাবে কোনো প্রবাসী এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে ১ ডলার দেশে পাঠালে ১১০ টাকার সঙ্গে নগদ প্রণোদনার ২ টাকা ৫০ পয়সা যুক্ত হয়ে ১১২ টাকা ৫০ পয়সা পাচ্ছেন।

কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে ডলারের দর প্রায় একই। সে কারণেই প্রবাসীরা এখন অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে ঝুঁকি নিয়ে দেশে টাকা না পাঠিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন বলে জানান ব্যাংকাররা।

রেমিট্যান্স বাড়ার আরেকটি কারণ উল্লেখ করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি চাঙা হয়েছে। সেখানে কর্মরত আমাদের প্রবাসীরা বেশি আয় করছেন। দেশেও বেশি টাকা পাঠাতে পারছেন।

‘দেশে ডলারের সংকট চলছে। মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা চলছে। রিজার্ভ কমছে। এই মুহূর্তে রেমিট্যান্স বাড়া অর্থনীতির জন্য খুবই ভালো হবে।’

অর্থ মন্ত্রণালয়ও তেমন পূর্বাভাস দিয়েছে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছর জুড়ে (২০২১-২২) ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিতে থাকা প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে নতুন অর্থবছরে ১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে।

এই অর্থবছরে রেমিট্যান্স বাড়ার কারণ হিসেবে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘করোনা-পরবর্তী সময়ে দেশ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ শ্রমিক নতুন করে বিদেশে যাওয়ায় তাদের কাছ থেকে বাড়তি পরিমাণ রেমিট্যান্স পাওয়া যাবে।’

দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর হালচাল নিয়ে তৈরি করা পাক্ষিক প্রতিবেদনেও রেমিট্যান্স নিয়ে সুসংবাদের আভাস দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গত ২১ জুলাই প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় বাড়াতে সরকার ইতোমধ্যে রেমিট্যান্সে নগদ প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ করেছে। করোনা মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় সব প্রবাসী তাদের কর্মস্থলে ফিরেছেন। টাকার বিপরীতে ডলার বেশ খানিকটা শক্তিশালী হয়েছে।

‘এই বিষয়গুলো আগামী মাসগুলোতে রেমিট্যান্স বাড়াতে সাহায্য করবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৩০ জুন ২০২২-২৩ অর্থবছরের নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। এতে বলা হয়, রেমিট্যান্স ঊর্ধ্বমুখী হবে এবং চলতি অর্থবছরে গত বছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি আসবে।

আরও দেখুন

বাগাতিপাড়ায় বৃষ্টির জন্য নামাজ আদায়

নিজস্ব প্রতিবেদক:নাটোরের বাগাতিপাড়ায় তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে রক্ষা পেতে বৃষ্টির প্রার্থনায় দুটি স্থানে নামাজ আদায় করেছেন …