নিউজ ডেস্ক:
পদ্মায় লঞ্চের চিরাচরিত হুইসলের সঙ্গে আগেই যুক্ত হয়েছিল বাসের হর্নের শব্দ। এবার এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ট্রেনের হুইসলও। পদ্মাপারের চার জেলার মানুষ নতুন এই আওয়াজ নিয়মিত শুনতে পাবে আজ মঙ্গলবার থেকে। সঙ্গে থাকবে কু-ঝিক-ঝিক শব্দতরঙ্গ।
পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প চালু হচ্ছে আজ। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া রেলস্টেশন থেকে যাত্রী হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ট্রেনে পদ্মা পাড়ি দেবেন। যাবেন ফরিদপুরের ভাঙ্গা জংশন পর্যন্ত। এর মধ্য দিয়ে এই পথে ট্রেন চলাচল শুরু হচ্ছে।
ভাঙ্গায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে অংশ নেবেন শেখ হাসিনা। তবে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হতে আরো দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় লাগবে। প্রাথমিকভাবে ঢাকা থেকে রাজশাহী, খুলনা ও বেনাপোলের পথে তিনটি ট্রেন চলাচল করবে। মধুমতি এক্সপ্রেস, সুন্দরবন এক্সপ্রেস ও বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের সময়সূচি এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হিসেবে পদ্মা সেতুর মাওয়া স্টেশন প্রান্তে সুধী সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। সকাল ১১টায় এই অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করবেন রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে সুধী সমাবেশে এক হাজার ৬৭৭ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটে আমন্ত্রিত যাত্রীদের নিয়ে ভাঙ্গার উদ্দেশে ট্রেনে উঠবেন প্রধানমন্ত্রী।
পদ্মা সেতুর ওপরে বাসসহ অন্যান্য যান চলাচল করে, এর ঠিক নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। এই রেল সংযোগ প্রকল্পের অধীনে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। এই পুরো পথে থাকবে মোট ২০টি স্টেশন। এর মধ্যে ১৪টি স্টেশন নতুন করে করা হচ্ছে। বাকি ছয়টি স্টেশন আগে থেকেই ছিল। সেগুলোর আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। এই রেলপথের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত হচ্ছে। পাশাপাশি বিদ্যমান ভাঙ্গা-পাচুরিয়া রাজবাড়ী সেকশনটি পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হবে।
জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন কালের কণ্ঠকে বলেন, রেলব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, এই রেলপথ সেই উদ্যোগকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই পথ আন্তর্জাতিক রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গেও যুক্ত হবে। এর মাধ্যমে ট্রান্স-এশিয়ান রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রবেশ করবে বাংলাদেশ।
নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, সরকার প্রতিটি জেলাকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে চাচ্ছে। খুলনা থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সেটা পদ্মা দিয়ে ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হবে। পণ্য পরিবহনে সক্ষমতাও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে পদ্মা রেল প্রকল্পের কারণে। ভবিষ্যতে পায়রা বন্দর থেকে পটুয়াখালী, বরিশাল যুক্ত হবে এই পথে।
পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-ভাঙ্গা রেলপথ শেষ পর্যন্ত আরো ছয়টি রেলপথের সঙ্গে যুক্ত হবে। প্রাথমিক ভাবনায় রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, যশোরের বেনাপোল, খুলনা, রাজশাহীর ট্রেন এই পথে চালানোর চিন্তা আছে রেলওয়ের। আবার ভারতে যাতায়াতের মৈত্রী ট্রেনও এই পথ ব্যবহার করবে ভবিষ্যতে।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, শুধু ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চালালে রেলকে লোকসান গুনতে হবে। তাই এই রেলপথ ব্যবহার করে অন্তত রাজবাড়ীর সঙ্গে ঢাকাকে যুক্ত করা হবে। বর্তমানে খুলনা, দর্শনা, বেনাপোল ও রাজশাহীর সঙ্গে ঢাকার সরাসরি রেল যোগাযোগ রয়েছে। পদ্মা সেতু ব্যবহার করে এসব অঞ্চলে নতুন ট্রেন গেলে বিদ্যমান পথে মাঝের স্টেশনগুলোর যাত্রীরা রেলের সেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। এমন একটি আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিচালন) সরদার শাহাদাত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, হুট করে সব ট্রেন সরিয়ে দেওয়া হবে না। প্রথম দিকে বিদ্যমান রুটেও ট্রেন চলবে। হয়তো সংখ্যা কমিয়ে নিয়ে নতুন রুটে যুক্ত করা হবে। এতে বিদ্যমান রুটে চাপ কমবে। ট্রেনের সময়সূচি ঠিক রাখতে সুবিধা হবে। নতুন পথে নতুন রেলযাত্রী তৈরি হবে।
রেলের সূত্রগুলো জানায়, আগামী ১ নভেম্বর থেকে যাত্রী নিয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেনের বাণিজ্যিক চলাচল শুরু হতে পারে। যাত্রী পরিবহন শুরুর আগে ট্রেনে আসনের শ্রেণিভেদে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। টোল নিয়ে এখনো সেতু কর্তৃপক্ষ ও রেলের মধ্যে আলোচনা চলছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, উদ্বোধনের পরপর এ বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে যাবে। একটি কমিটি এ নিয়ে কাজ করছে।
ঢাকার কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, কেরানীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর, লৌহজং, পদ্মা সেতু, শরীয়তপুরের জাজিরা, মাদারীপুরের শিবচর, ফরিদপুরের ভাঙ্গা, নড়াইল, মাগুরা হয়ে যশোর পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে নতুন রেলপথ। যদিও প্রকল্পের অধীন প্রথম ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন গিয়ে রাজবাড়ী হয়ে ঘুরে যাবে অন্য পথে। ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথে মূল লাইনের সঙ্গে লুপ ও সাইডিং লাইন থাকছে ৪২.২২ কিলোমিটার। আর তিন কিলোমিটার ডাবল লাইনসহ মোট ২১৫.২২ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে।
৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মীয়মাণ পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ১৮ হাজার ২১০ কোটি ১১ লাখ টাকা দিচ্ছে সরকার। বাকি ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে চায়না এক্সিম ব্যাংক। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।
বাকি কাজ চলমান থাকবে
ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রকল্পের পথ চালু হলেও বাকি অংশের কাজ চলমান থাকবে। আগামী বছরের জুনের আগেই যশোরে ট্রেন নিতে চায় সরকার। প্রকল্পের নির্মাণকাজ করা হচ্ছে তিন ভাগে। সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুরো পথের কাজ হয়েছে ৮৩ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ হয়েছে মাওয়া-ভাঙ্গা অংশে ৯৭.৫০ শতাংশ। আর ঢাকা-মাওয়া অগ্রগতি ৮৩ শতাংশ ও ভাঙ্গা-যশোর পথের কাজ হয়েছে ৮০ শতাংশ।
প্রকল্পের প্রভাব প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অবকাঠামো ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, এমন অবকাঠামো নিঃসন্দেহে যোগাযোগে বড় প্রভাব রাখবে। তবে সরকারের উচিত হবে প্রভাবের জন্য উপযোগিতা তৈরি করে দেওয়া। সঠিক উপযোগিতা তৈরি করা গেলে প্রান্তিক মানুষ এমন বড় প্রকল্পের সুফল ভোগ করতে পারবে।
পদ্মা সেতুর নিচের অংশে রেললাইন। পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেন চালানোর সময় তোলা।