নিউজ ডেস্ক:
বিশ্বের বৃহত্তম পনেরোটি দেশের মুক্তবাণিজ্য জোট ‘আরসেপে’ যোগ দিচ্ছে বাংলাদেশ। এই জোটে যোগ দেওয়ার পর দেশের পণ্য রপ্তানি বাড়বে পাঁচশ’ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় যা প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা। এর পাশাপাশি চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডসহ বিশ্বের ১৫টি দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়বে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদেই বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যিক জোট রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপে (আরসেপ) যোগদানের বিষয়টিতে আগ্রহ প্রকাশ করে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করা হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) এক সমীক্ষায় দেখিয়েছে, বেশকিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও আরসেপে যোগ দেওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য লাভজনক। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, আরসেপে যোগদানের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা পাওয়ার পরই এই জোটে যোগ দেওয়ার যাবতীয় প্রস্তুতি শুরু করে মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আরসেপে যোগ দেওয়ার পর কিভাবে দেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা কাজ শুরু করেছেন। শীঘ্রই আরসেপে যোগদান সংক্রান্ত আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হবে। সরকার মনে করছে, বাংলাদেশের সামনে এখন এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অর্থনীতি এগিয়ে নিতে হলে যে কোনো বাণিজ্যিক জোটের সঙ্গে কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে এককভাবে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য বা অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি করার ওপরও জোর দেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই আরসেপের সদস্যপদ প্রাপ্তির জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আবেদন করার প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। ট্যারিফ কমিশন তাদের সমীক্ষায় আরসেপে যোগদানের সুবিধা-অসুবিধাগুলো খতিয়ে দেখেছে। তাদের প্রতিবেদনে মূলত এ জোটে যোগ দেওয়ার পক্ষেই মত দেওয়া হয়। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, আরসেপে যোগ দিলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি ১৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ বাড়বে, যার পরিমাণ পাঁচশ’ কোটি ডলারেরও বেশি। এ কারণে দ্রুত আরসেপে যোগ দেওয়া প্রয়োজন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, আরসেপকে চীনের নেতৃত্বাধীন বাণিজ্যিক ব্লক বলা হলেও যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়াও এই জোটের সদস্য। তা ছাড়া ভারত যে কোনো সময় প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হিসেবে আরসেপের সদস্য হতে পারবে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ জনকণ্ঠকে বলেন, বাণিজ্যিকভাবে শক্তিশালী বিশ্বের পনেরো দেশের মুক্ত বাণিজ্য জোট আরসেপে যোগ দেবে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এলডিসি উত্তরণ আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের কাজ করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে রপ্তানি বাড়ানোর কৌশল হিসেবে আরসেপে যোগ দেওয়া হবে। একইভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয়সহ শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতেও আরসেপ থেকে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল কাজ করছে।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ১৫ নবেম্বর চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান) জোটের ১০ সদস্য-ব্রনাই, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিন্সসহ মোট ১৫টি দেশ বিশ্বের বৃহত্তম এ বাণিজ্যিক জোটে যোগদানের চুক্তি স্বাক্ষর করে। আর গত বছরের জানুয়ারিতে যাত্রা শুরু করে ১৫ দেশের বাণিজ্যিক জোট আরসেপ। এর আগে ২০১২ সালে আরসেপ গঠনের পরিকল্পনা প্রথম সামনে আসে, আর ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর এটি গঠনের উদ্যোগ গতি পায়। এ ছাড়া কোভিড-১৯ মহামারি হানা দেওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে আঞ্চলিক অর্থনীতি পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছলে নতুন গতি পায় আরসিইপির উদ্যোগ। জোটভুক্ত দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা ২৩০ কোটি। আর সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ২৬ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার। এই জোটের অর্থনীতির আয়তন বিশ্বের মোট জিডিপির ৩০ শতাংশ। ফলে, এই চুক্তি বিশ্বের সবচেয়ে বড় অবাধ বাণিজ্য এলাকা তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র-ক্যানাডা এবং মেক্সিকোর মধ্যে যে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল রয়েছে সেটি বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়েও এশিয়ার নতুন এই বাণিজ্য অঞ্চলটির পরিধি বড় বলে অনেকে মনে করেন।
এ চুক্তির মূল লক্ষ্য সদস্য দেশের মধ্যে আন্তঃবাণিজ্যে শুল্কের পরিমাণ হ্রাস, বাণিজ্য সেবার উন্মুক্তকরণ এবং উদীয়মান অর্থনীতির সদস্য দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আর্থ-সামাজিক উন্নতি সাধন করা। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ) নূর মো. মাহবুবুল হক বলেন, আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় কিছু পূর্ব সতর্কতাসহ আরসেপে বাংলাদেশের যোগদানের পক্ষে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। নিয়মানুযায়ী, চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে অন্য দেশও আরসেপে অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করতে পারছে। ইতোমধ্যে শ্রীলঙ্কা ও হংকং এই জোটে দেওয়ার জন্য জন্য আবেদন করেছে। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞদের মতে, একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র আসিয়ানসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো, যারা আরসেপের অন্তর্ভুক্ত। ফলে বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযুক্ত থাকা যৌক্তিক হবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ এখন যেসব দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করার বিষয়ে আলোচনা করছে, তার মধ্যে ছয়টি দেশ আরসেপে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আরসেপভুক্ত দেশগুলো নিজেদের শুল্ক কমানোর জন্য ১০ বছর থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত সময় নিয়েছে। বাংলাদেশ আরসেপে অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করলে আরসেপভুক্ত ১৫ দেশ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। এক্ষেত্রে প্রত্যেকটা দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পৃথকভাবে দরকষাকষি করতে হবে। ফলে একেক দেশের সঙ্গে একেক রকম দরকষাকষি করতে হবে।
প্রতিযোগী ভিয়েতনামের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে ॥ পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী ভিয়েতনাম। ভিয়েতনাম চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি করে। দেশটিতে চীনের বিনিয়োগও প্রচুর। আবার চীনসহ আরসেপভুক্ত দেশগুলোতে ভিয়েতনামের রপ্তানির পরিমাণও উল্লেখযোগ্য। ফলে ভিয়েতনাম ইতোমধ্যে আরসেপভুক্ত দেশগুলোর ভ্যালু চেনের সঙ্গে সংযুক্ত ও ইন্টিগ্রেটেড। বাংলাদেশ এই ইন্টিগ্রেশনের বাইরে থাকলেও কাঁচামাল আমদানির মূল উৎস চীন। এ অবস্থায় আরসেপে যোগদান করে বাংলাদেশ কীভাবে সুফল পেতে পারে, সে বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া আরসেপভুক্ত প্রত্যেকটা দেশের সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোথায় কোন্ ধরনের আইনকানুন রয়েছে, সেগুলো ভালোভাবে পর্যালোচনা করা হবে। সেবা খাত, বিনিয়োগ ও ট্রিপসের (ট্রেড-রিলেটেড অ্যাসপেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস) আওতায় বাংলাদেশ যেসব সুবিধা পায়, সেগুলো মাথায় রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, যে কোনো জোটে যাওয়া কিংবা চুক্তি করার আগে বিষয়গুলোর সমীক্ষা প্রয়োজন। তবে এ ধরনের উদ্যোগ ভালো। দেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে, আমরা স্বল্পোন্নত বা এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। জীবনযাত্রার মান আরও উন্নত করতে হলে অবশ্যই দেশের রপ্তানি বাণিজ্য বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে আরসেপ একটি গুরুত্বপূর্ণ জোট হতে পারে।
আরসেপ বা আরসিইপি কি কেন প্রয়োজন ॥ আসিয়ান জোটের ১০টি দেশ ছাড়াও এই চুক্তিতে সই করছে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। ভারতের এই চুক্তিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সস্তা চীনা পণ্য তাদের বাজার ছেয়ে যাবে এই ভয়ে দেশটি আলোচনা থেকে বেরিয়ে যায়। তবে আসিয়ান জোটের ১০ সদস্যÑ ব্রুনাই, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিন্সসহ মোট ১৫টি দেশ বিশ্বের বৃহত্তম এ বাণিজ্যিক জোটে যোগদানের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। আরসেপ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের খরচ ও সময় কমিয়ে এ জোটের যে কোনো সদস্য দেশে পণ্য রপ্তানির সুযোগ করে দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের আলাদা বিধিমালার ঝামেলা এড়ানোর সুযোগ পাবে কোম্পানিগুলো। জানা গেছে, চীনের আরসিইপি চুক্তির ফলে বাংলাদেশে তিন ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। এতে চুক্তিবদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে শক্তিশালী সাপ্লাই চেন গড়ে উঠবে, ফলে তারা সস্তায় কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য সংগ্রহ করবে। চুক্তিবদ্ধ দেশগুলো একে অপরকে বিনিয়োগ সুবিধা দেবে, ফলে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মতো উন্নত দেশগুলোর বিনিয়োগের বেশিরভাগই বাংলাদেশ যাবে মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামের মতো দেশে। যা বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে।