রেজাউল করিম খান
সরকারের রূপকল্প ২০২১ এর আওতায় ‘ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ ও ‘সবার জন্য বিদ্যুৎ’ এর লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় বিদ্যুৎ খাতের পুনর্বিন্যাস, পুনঃগঠন ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমে জেনারেশন, ট্রান্সমিশন ও বিতরণ ক্ষেত্রের জবাবদিহিতা ও উন্নততর সেবা নিশ্চিত করতে ১লা অক্টোবর, ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড থেকে সকল সম্পদ ও দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করে নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানী (নেসকো) লিমিটেড বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। এটি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এর একটি প্রতিষ্ঠান।
নেসকো উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ টি জেলার আওতাধীন ২৪ টি উপজেলা শহরে ৫০ টি বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগে কাজ করেেছ। এর প্রধান কার্যালয় রাজশাহীতে। প্রতিষ্ঠার তারিখ: ০৩ অগাস্ট, ২০০৫ খিস্টাব্দ। বর্তমানে নেসকোর গ্রাহক সংখ্যা ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৮৮৬ জন। বিদ্যুৎ বিতরণ লাইনের দৈর্ঘ্য ১৯ হাজার ১৩১.৪১ কিলোমিটার। তারা প্রতি মাসে ৩২৬.৩৬ মেগা কি. ওয়াট ঘন্টা বিদ্যুৎ কিনে ২৯২.০৮ মেগা কি. ওয়াট ঘন্টা বিক্রি করে। অর্থাৎ ২৪. ২৮ মেঘা কি. ওয়াট ঘন্টা বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকে। এরপরও কেন লোড শেডিং হয়?
এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ জানান, এখন লোড শেডিং হয় না। তবে সিস্টেম মেরামত, সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। নেসকোর আওতাধীন একটি জেলা শহরের পরিসংখ্যান বলছে, সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় প্রতিদিনই ২৪ ঘন্টায় ৭ বার পর্যন্ত বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করেছে।
টেলিফোন করলে সেখানকার বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ বলেন, ‘লাইনে কাজ চলছে’, ‘বজ্রপাতে ট্রান্সফরমার পুড়ে গেছে’, ‘সঞ্চালন লাইনে সমস্যা হয়েছে’ ইত্যাদি। এই বিদ্যুৎ বিভ্রাট এতো ভয়াবহ হয়ে পড়েছে যে, রাজশাহী ও রংপুর এলাকার বিভিন্ন স্থানে গ্রাহকগণ অভিযোগ, বিক্ষোভ মিছিল, মানব বন্ধন, এমনকি-অনশন পর্যন্ত করছেন।
গত ২৮ জুলাই সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর: রাজশাহীতে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ থাকলেও মাত্রাতিরিক্ত বিদ্যুতের লোড শেডিং ও মাস শেষে ভৌতিক এবং সর্বশেষ জুন মাসের বিলে নেসকোর বিরুদ্ধে সুক্ষ কারচুপির অভিযোগ তুলেছে সামাজিক সংগঠন রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ। বিদ্যুতের এসব সমস্যা দ্রুত নিরসনের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও নেসকো অফিস ঘেরাও কর্মসূচিও পালন করা হয়েছে। ৩০ এপ্রিল পঞ্চগড়ে বিদ্যুতের অনিয়মের প্রতিবাদে প্রতীকী অনশন পালন করেছেন গ্রাহকগণ। অনশন পালনরত বসুনিয়াপাড়া এলাকার আশরাফুল ইসলাম বলেন, এমন বিদ্যুৎ থাকার চেয়ে না থাকাই ভাল। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করতে পারে না। ফ্রিজ নষ্ট হয়ে গেছে। গত বছর ২৪ অক্টোবর নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলা পরিষদ হলররুমে দুর্নীতি দমন কমিশন ও উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি গণশুনানির আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি কমিশনার দুর্নীতি দমন কমিশন এএফএম আমিনুল ইসলাম বলেন, সবচেয়ে বেশি অভিযোগ নেসকোর বিররুদ্ধে। নেসকোর অনিয়ম নিয়েই ১১৮টি অভিযোগ পড়েছে। নর্দান ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানী (নেসকো) লিমিটেড চলছে ‘বিদ্যুৎ বিল-২০১৮’ আইন দিয়ে। যা সম্পূর্ণই তাদের পক্ষে আর গ্রাহকের বিপক্ষে। নেসকোর জন্য কোনো পৃথক আইন হয় নি। পরিচালিত হয় না কোম্পানি আইনেও। আইনের এতো বাধ্যবাধকতার মধ্যে কিন্তু গ্রাহকের কোনো সুবিধার কথা বলা হয় নি। বিদ্যুৎ বিভ্রাট বা বৈদ্যুতিক সমস্যার কারণে গ্রাহকের সম্পদ বিনষ্ট হলে, শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলে ক্ষতিপূরণের কোনও বিধান নেই। গ্রাহকের যে কোন অনুসন্ধান, সেবা ও অভিযোগ-এর জন্য নেসকো বলছে, ‘কল করুন-১৬৬০৩ নম্বরে’। কিন্তু সেখানেও বিপদ।
সাধারণত, সেবামূলক কল টোল ফ্রি হয়। কিন্তু এই কল করলে আপনাকে প্রতি মিনিটে গুণতে হবে প্রায় পাঁচ টাকা। বিদ্যুৎ সরবরাহ ইউনিটের নির্দিষ্ট ‘অভিযোগ কেন্দ্র’ অথবা ‘গ্রাহক সেবা কেন্দ্র’-এ আপনার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের অভিযোগ জানানো হলে আপনাকে অভিযোগ নম্বর ও নিস্পত্তির সম্ভাব্য সময় জানিয়ে দেয়ার নিয়ম। অভিযোগ নম্বরের ক্রমানুসারে আপনার বিদ্যুৎ বিভ্রাট দূরীভূত করার লক্ষ্যে ২৪ ঘন্টার মধ্যে নিস্পত্তির ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যদি নির্ধারিত সময়ে বিদ্যুৎ বিভ্রাট দূরীভূত করা সম্ভব না হয়, তার কারণ গ্রাহককে অবহিত করা হবে। কিন্তু নেসকোতে এসবের কোনও বালাই নেই। তারা চলে তাদের নিয়মে।
এমতাবস্থায় গ্রাহকগণ এই সত্য মেনে নিয়েছেন যে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর নানা সমস্যা ও অনিয়মের কারণে ঘোষিত ক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ হয় না।
রেজাউল করিম খানঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট