নিজস্ব প্রতিবেদক,গুরুদাসপুর:যে শিক্ষক সঠিক পথ দেখাবেন, সেই শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের ভুল পথে ঠেলে দিচ্ছেন। গত পাঁচ বছর যাবৎ নিষিদ্ধ গাইড বই পড়তে বাধ্য করছেন শিক্ষার্থীদের। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ ফরিদ মন্ডল ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রকাশকদের প্রতিনিধির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে শিক্ষার্থীদের গাইড বই পড়তে বাধ্য করছেন বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। এমনকি বিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুযায়ী গাইড বই না কিনলে পরীক্ষায় ফলাফল ভাল না হওয়া এবং অকৃতকার্যের ঘটনাও ঘটে। প্রধান শিক্ষকের দীর্ঘদিন যাবৎ গাইড বাণিজ্য থেকে রক্ষা পেতে চায় সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। এছাড়াও প্রধান শিক্ষকের প্রভাবে বিদ্যালয়ের অনেক সহকারী শিক্ষক অন্যায় দুর্নিতীর প্রতিবাদ করতেও ভয় পায়।
রোববার সকালে নাজিরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে অনুসন্ধান চালায় সমকাল। সমকাল প্রতিনিধি স্কুলে প্রবেশ করার খবর টের পেয়ে স্কুলের পেছন গেট দিয়ে পালিয়ে যায় প্রধান শিক্ষক। এ সময় শ্রেণী কক্ষ থেকে প্রায় ২০-৩০ জন শিক্ষার্থী বের হয়ে মাঠের মধ্যে চলে আসে। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলে, ৬ষ্ট শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বাধ্য করা হয় ‘পাঞ্জেরী গাইড বই’ কিনতে। স্কুল থেকে দেওয়া হয় প্রতিটি শ্রেণী কক্ষে একটি করে সিলেবাস। সিলেবাসের মধ্যে লেখা থাকে পাঞ্জেরী গাইড বইয়ের নাম। নিজেদের স্বাধীনতা মত কেউ গাইড বই কিনতে পারেনা। তাছাড়াও স্কুলের শিক্ষকরা ভালভাবে পড়ালে নিষিদ্ধ গাইড বই কিনতে হতো না। প্রধান শিক্ষক মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে নিজের অনুসারী কিছু শিক্ষকে কমিশন দিয়ে শিক্ষার্থীদের গাইড বই কিনতে বাধ্য করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাঁচ জন সহকারী শিক্ষক জানান, নাজিরপুর উচ্চ বিদ্যালয় দীর্ঘদিন যাবৎ অনিয়ম দুর্নীতিতে ভরপুর। প্রতিবাদ করতে গেলেই অন্যায় ভাবে হয়রানী করা হয়। পাঞ্জেরী গাইড বইয়ের গুরুদাসপুরের এজেন্ট মোমিনুল ইসলাম প্রতি বছর প্রধান শিক্ষক ফরিদ মন্ডলকে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা ওই নিষিদ্ধ গাইড বই বাধ্যতামুলক শিক্ষার্থীদেরকে কেনার জন্য ঘুষ বাবদ প্রদান করে থাাকেন। মোটা অঙ্কের টাকা পাওয়ার জন্য তিনি গাইড বই বাধ্যতামুলক করেছেন সকল শিক্ষার্থীদের কাছে। এছাড়াও কোন শিক্ষার্থী যেন নিজের ইচ্ছেমত নিষিদ্ধ গাইড বই কিনতে না পারে তার জন্য প্রতিটি ক্লাসে বিদ্যালয় থেকে সিলেবাস তৈরি করে দেওয়া হয়। সিলেবাসে লেখা থাকে পাঞ্জেরী গাইড বইয়ের নাম। পাঞ্জেরী গাইড বই ছাড়া অন্য বই পড়ে প্রস্তুতি নিয়ে কোন শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিলে তার ফলাফল খারাপ হয়। কারন ওই গাইড থেকেই প্রশ্নপত্র ও উত্তর তৈরি করা হয়। এমনকি ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদেরকে পরীক্ষা না হওয়ার কারনে ফ্রম ফিলাপ বাবদ নেওয়া টাকা ফেরত দিতে বললেও প্রধান শিক্ষক তা আত্মসাত করেছে। শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট গ্যারেজ পার্কিং জায়গাটি ভাড়া দিয়ে টাকা উত্তোলন করেন প্রধান শিক্ষক। তারপরও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে রশিদ দিয়ে গ্যারেজের টাকা উত্তোলন করা হয়। কয়েকবছর পূর্বে এই বিদ্যালয়ে ইয়াবা বিক্রি হতো। সম্প্রতি সময়ে ট্যাব বিতরণেও অনিয়ম করায় গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে।
অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মোঃ সাহেদ হোসেন জানায়, ‘প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে আমি নাজিরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ট শ্রেণীতে ভর্তি হই। ৬ষ্ট শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত আমি পাঞ্জেরী গাইড বই ব্যবহার করছি। কারন প্রধান শিক্ষক প্রতি বছর এই গাইড বই কিনতে বলে। এটা ছাড়া অন্য কোন গাইড বই কিনলে পরীক্ষায় ফলাফল ভাল হয়না। তাই বাধ্য হয়েই ব্যবহার করতে হচ্ছে।’
অষ্টম শ্রেণীর আরও এক শিক্ষার্থী নিরব হোসেন জানায়,‘ক্লাস সিক্স থেকে আমাকে পাঞ্জেরী গাইড ব্যবহার করতে বাধ্য করেছে শিক্ষকরা। এমনকি বিদ্যালয় থেকে দেওয়া সিলেবাসেও পাঞ্জেরী লেখা। শুধু গাইড বই নয়। এই বিদ্যালয়ের প্রতিটি জায়গায় অনিয়ম দুর্নীতি। প্রধান শিক্ষকের কাছে একাধিকবার আমাদের রুমে ফ্যান নষ্ট হওয়ার কারনে মেরামত করতে অনুরোধ করেছি। তারপর সাইকেল গ্যারেজ ভাড়া না দিয়ে আমাদের গাড়ি গুলো যেন রাখতে পারি তার জন্যও বলেছি। কিন্তু তিনি টাকা পেলে আমাদের কথা ভূলে যান। অতি দ্রæত আমাদের প্রধান শিক্ষককে অপসারণ না করা হলে বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাবে।’
এছাড়াও অষ্টম শ্রেণীর তাছলিম আহম্মেদ, গৌরব, রনি ইসলাম, নবম শ্রেণীর রবিনসহ বিভিন্ন শ্রেণীর প্রায় ১০০ জন ছাত্র-ছাত্রী অভিযোগ করে বলেন, প্রধান শিক্ষকের অনিয়ম দুর্নীতির কারনে বার বার গণমাধ্যমে শিরোনাম হয় এই স্কুল। এতে করে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ক্ষতি হয়। এর আগে মেধাবীদের মাঝে ট্যাব বিতরণ না করে স্বজনপ্রীতি করে ট্যাব দেওয়া হয়েছিলো। দীর্ঘদিন পূর্বে স্কুলে ইয়াবা বিক্রি হতো। গ্যারেজ ভাড়া দিয়ে টাকা আত্মসাত করার পরেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা তোলা। প্রতিটি ফ্রম ফ্লাপে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা। শ্রেণীকক্ষে প্রচন্ড গরমে ক্লাস করতে হয়। ফ্যান নষ্ট হলেও মেরামত করে না। অথচ মেরামত বাবদ টাকা তুলে আত্মসাত করেন প্রধান শিক্ষক। স্কুলের গাছ বিক্রি করে টাকা আত্মসাত এবং নিজের বাড়িতে সোফা তৈরিসহ বিভিন্ন স্ব-ঘোষিত অনিয়ম দুর্নীতি করলেও তার বিরুদ্ধে কোনরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়না।
পাঞ্জেরী প্রকাশনীর গুরুদাসপুরের এজেন্ট মমিনুল ইসলামের মুঠোফনে ফোন দিয়ে সমকালের কথা শুনেই ফোন কল কেটে দেন। পরবর্তীতে তার সন্ধানে গুরুদাসপুর থানা চত্বরে যাওয়া হলে সমকাল প্রতিনিধিকে দেখে তরিঘরি করে বাইক নিয়ে পালিয়ে যান এবং ফোন বন্ধ করেন।
সহকারী প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম বলেন, এসকল বিষয়ে তিনি কোন মন্তব্য করতে পারবেন না। সকল প্রশ্নের জবাব প্রধান শিক্ষক দিবেন।
রবিবার সকাল দশটায় নাজিরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ ফরিদ মন্ডলের বক্তব্য নেওয়ার জন্য বিদ্যালয়ে যাওয়া হয়। গণমাধ্যকর্মীর উপস্থিতি টের পেয়ে বিদ্যালয়ের পেছন গেইট দিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর তার বাড়িতে বক্তব্য নেওয়ার জন্য গেলেও প্রথমে বাড়িতে আছেন বলে জানান। তারপর বাড়ির পেছন দিয়ে পালিয়ে যান।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ শাহাদুজ্জামান মুঠোফনে বলেন,‘বিদ্যালয়ে গাইড বই নিষিদ্ধ। প্রধান শিক্ষক যদি এমন কর্মকান্ড করে থাকেন তাহলে তিনি অন্যায় করেছেন। অতি দ্রæত তদন্ত কমিটি গঠন করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’#
নীড় পাতা / জেলা জুড়ে / গুরুদাসপুর / ঘুষ নেয় প্রধান শিক্ষক! দীর্ঘদিন যাবৎ নিষিদ্ধ গাইড বই পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীরা
আরও দেখুন
নন্দীগ্রামে অবৈধভাবে পুকুর খনন করার অপরাধে একজনকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা
নিজস্ব প্রতিবেদক নন্দীগ্রাম,,,,,,,,,,,,, বগুড়ার নন্দীগ্রামে অবৈধভাবে পুকুর খনন করার অপরাধে একজনকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা …