নিজস্ব প্রতিবেদক, পুঠিয়া:
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর হাট। ঢাকা-রাজশাহী বানেশ্বর মহাসড়কের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা হাটটি এই অঞ্চলের অন্যতম বড় আমের হাট হিসেবেই অধিক পরিচিত। আম পাকার আগে থেকেই হাঁকডাকে ভরপুর থাকে বানেশ্বর বাজারটি। সিজনাল ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি চাষি কিংবা বাগান মালিকরাও আম বিক্রি করতে আসেন এই বাজারে।
সাপ্তাহিক হাটের দিন ছাড়াও প্রতিদিনই বেলা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন বাড়ে লোক সমাগম। তবে বাজারের আড়ৎদার বা পাইকারি ক্রেতাদের কাছে জিম্মি চাষি বা বিক্রেতারা। গণিতের হিসেবে ৪০ কেজি ধরে এক মণ কেনা বেঁচা হলেও এই হাটে এক মণ সমান ৫০ কেজি। ক্ষেত্র বিশেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫২ কিংবা ৫৪ কেজিতেও।
সরেজমিনে জানা যায়, প্রতি মণে ৬ থেকে ১৪ কেজি পর্যন্ত অতিরিক্ত দেওয়ার এই প্রথাকে ঢলন বলা হয়। অনেক আগে থেকেই আম বিক্রির এই প্রথাটি পরিচিত আম সংশ্লিষ্টদের কাছে। এর প্রতিবাদ করতে গিয়েও বিপাকে পড়তে হয় গ্রাম থেকে আসা চাষিদের। বাজারের আড়তদাররা সম্মিলিতভাবে হুমকি দেন আম না কেনার, এতে লাভ নয় বরং ক্ষতিরই শঙ্কা থাকে চাষিদের। স্থানীয় প্রশাসন সব জেনেও দর্শকের ভূমিকায় থাকেন বলেও অভিযোগ বাগান মালিকদের।
বাজারে পুঠিয়ার নয়াপাড়া থেকে আম বিক্রি করতে এসেছিলেন আব্দুস সামাদ। জানতে চাইলে তিনি আমাদের বলেন, ওরা (আড়তদাররা) ৫০ কেজিতে এক মণ ছাড়া আম নিচ্ছে না। কি করা যাবে? শেষমেশ বাধ্য হয়ে বেঁচতেই হচ্ছে। আমরা যারা চাষি বা পাইকারি বিক্রেতা আছি আন্দোলন করছি, কিন্তু যারা আম কেনে তারা আর নিবে না, সব বন্ধ করে দিয়ে বলবে আম আর কিনবো না।
তিনি আরও বলেন, এক রকম বাধ্য হয়েই বেশি করে দিতে হয়। গাছের আম তো পাকে পড়ে যাচ্ছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমাদের তো আর উপায় নাই। অভিযোগ আর কি, সবাই জানে। সবাই এভাবেই দেয় তাই আমরাও দেই। যখন বাধা-বিঘ্ন করি তখন বলে আমরা আর আম কিনবো না, তোমরা যেটি পারো বেঁচো।
আমের বাজার সম্পর্কে তিনি বলেন, এবার আমার গোপালভোগ, আটি, লকনা, হিমসাগর, আম্রপালি জাতের আম ছিল। আগে গোপালভোগ ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকা মণ দাম ছিল, ২২০০ টাকা মণ পর্যন্ত বিক্রি করছি, পরে দাম কমে ১৭০০ টাকা মণে নামছে। আর আটি আম শুরুতে ১৬০০ টাকা মণ থাকলেও এখন ৭০০/৮০০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। লকনা আম আগে ৮০০ টাকা মণ বিক্রি করছি, আর এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা মণে। সব আমের দামই কমেছে।
আরেক আম বিক্রেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, আজকে প্রায় ১৫/১৬ মণ আম বিক্রি করছি। আড়তে যদি যাই ৪৮ কেজিতে এক মণ নেয়, আবার ছোট আম বলে ৫ থেকে ১০ কেজি বাদ দিয়ে দেয়, হিসেব করে খুচরা ৫০/৭০ টাকা হলে সেটাও দেয় না। আমরা নিরূপায়। আজকে আড়তদারের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবো, কালকে আর আম নিবে না। আমি কাঁচা মালটা তখন কি করবো?
তিনি আরও বলেন, আড়তদাররা এসব করলেও প্রশাসনের তৎপরতাটা নেই। শুধু পুলিশ এসে একটু পাহারা দেয়, তারা সহযোগিতা করে। আগে তো ছিল কাঠার দাঁড়িপাল্লা, আর এখন ডিজিটাল পাল্লা। আগে দাঁড়িপাল্লায় সোলা দিয়ে রাখতো, আর এখন ডিজিটালে ২ কেজি বাদ দিয়ে রাখে। ২ কেজি বাদ দিয়ে রেখেও আবার হিসাবপাতি করে ৪৮ কেজিতে মণ নেয়। আমরা কই যাবো?
চারঘাট উপজেলার হলিদাগাছী থেকে নিজের বাগানের আম বিক্রি করতে এসেছিলেন আশিফ আলী। এসময় তিনি বলেন, এবার দামের খুবই খারাপ অবস্থা। আম কেনার লোক কম। এছাড়া ফলনও বেশি হয়েছে এবার, তাই দাম কম। তিনি আরও বলেন, এখন তো সারাদেশেই আম পাওয়া যায়। সবারই যদি নিজের প্রয়োজনীয় আমটা গাছেই হয়, তাহলে আর কিনবে কেন। তার ওপর এই ঢলন প্রথা। সবাই নিরুপায় হয়ে বিক্রি করছে। প্রতি বছর এভাবে বিক্রি করে করে সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
ঢলন নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মুশফিকুর রহমান মিম নামের এক আড়তদার বলেন, আম কাঁচামাল, কিছু আম পচে নষ্ট হয়। তাই আমরা যখন কিনি, তখন ছয় কেজি ঢলন নিয়ে থাকি। আবার আমরা যখন বিক্রি করি তখনও কিছু বেশি দেই।
প্রশাসনের নির্দেশনার বিষয়ে জানেন কিনা—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সেটা তো জানি। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় পাঠানোর যেসব আম নষ্ট হবে, সেটা কে দেবে? তখন তো ব্যবসায়ীরাই ক্ষতির শিকার হবে। এই ক্ষতি এড়ানোর জন্যই ঢলন। আর এটা তো সবাইকে জানিয়েই নেওয়া হয়।
পুঠিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জিএম হিরা বাচ্চু বলেন, আমরা অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু প্রতিহত করতে পারিনি। তাদের কারণ দেখায়, বাহিরে যখন নেই তখন তো ঢলন দেয়। আমরা বলেছি, ঢলন তো দরকার নেই। ৪০ কেজিতে মণ ধরে কম দামে ধরেন, ৫০ থেকে ৫৫ কেজিতে মণ করবেন এটা তো হিসাব মিলে না। আমরা সবাইকে নিয়েই চেষ্টা করছি, কিন্তু হয় না, করতে পারি নি বলেও উল্লেখ করেন উপজেলা চেয়ারম্যান।
তবে পুঠিয়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নূরুল হাই মোহাম্মদ আনাছকে একাধিক বার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। ফলে তার মন্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের রাজশাহী জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মাসুম আলী বলেন, শুধু বানেশ্বর বাজারে না, কেশরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট, রহনপুর বাজারে রীতিমতো প্রথায় পরিণত হয়েছে ঢলন প্রথা। আমরা নিজেরাও এই ঢলন প্রথার বিরুদ্ধে চেষ্টা অব্যাহত রাখছি। বাজারের ব্যবসায়ী, ইজারাদার, প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে অনেক বসা হয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি। তবে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।