নিউজ ডেস্ক:
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১ হাজার ১৮৫ পণ্যের যৌক্তিক শুল্কহার নির্ধারণ করবে সরকার। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে পদোন্নতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং অভিন্ন কারণে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধিবদ্ধ নিয়ম প্রতিপালনের চাপে এমন সিদ্ধান্ত, যা সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনার আওতায় আগামী তিন বছরের মধ্যে বাজেটারি পদক্ষেপের মাধ্যমে এ যৌক্তিক শুল্কহার বাস্তবায়ন করা হবে।
এ লক্ষ্যে চারটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ১. আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত ৬০টি পণ্য সংশ্লিষ্ট কাস্টমস ডিউটিকে বাউন্ডরেট ট্যারিফের সীমার মধ্যে নামিয়ে আনা, ২. কাস্টমস ডিউটি আরোপযোগ্য পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে নির্ধারিত ন্যূনতম মূল্য পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার, ৩. সম্পূরক শুল্ক (এসডি) ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) স্ট্রিমলাইন বা প্রবাহরেখা নির্ধারণ এবং ৪. রপ্তানি উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট বিদ্যমান নীতি পর্যালোচনা এবং সুপারিশ প্রণয়ন করা। চলতি বছর থেকেই এসব লক্ষ্যমাত্রার লক্ষ্য অর্জনে ত্রৈমাসিকভিত্তিক বিভাজিত কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হবে। ট্যারিফ যৌক্তিকীকরণবিষয়ক স্ট্যাডি গ্রুপের তৈরি করা চূড়ান্ত খসড়া প্রতিবেদনে এ কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কর্তৃক গঠিত অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ ও ট্যারিফ যৌক্তিকীকরণবিষয়ক উপকমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে এ ট্যারিফ যৌক্তিকীকরণবিষয়ক স্ট্যাডি গ্রুপ গঠন করা হয়। যার সদস্যরা দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সময়াবদ্ধ এ কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করে। চলতি মাসেই এর খসড়া প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে জমা দেওয়া হতে পারে। যার একটি খসড়া দৈনিক কালবেলার হাতেও এসেছে।
এদিকে পদোন্নতির মত না পাল্টালে জাতিসংঘের মুখ্য কার্যনির্বাহী পরিষদ ইকোসকের ঘোষণা অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বাংলাদেশের চূড়ান্ত উত্তরণ ঘটবে আগামী ২০২৬ সালেই। অন্যদিকে, এ পদোন্নতি বা উত্তরণের কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনির্ভর পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্কহার ওই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে ডব্লিউটিওর নির্দেশিত ‘বাউন্ড রেট’ ট্যারিফে নামিয়ে আনতে হবে, যা ডব্লিউটিওর সব সদস্য দেশকে চুক্তি অনুযায়ী এলডিসি থেকে বের হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগের নির্ধারিত উচ্চ ট্যারিফ বা শুল্কহারও বিধিবদ্ধ নিয়মে কমিয়ে আনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
ডব্লিউটিওর তথ্যমতে, বর্তমানে ম্যাক্সিমাম অ্যাড ভ্যালুরেম ডিউটির (বাউন্ড রেট) আওতায় ৯৩০ পণ্য রয়েছে। তবে আমদানি পর্যায়ে আরোপিত অন্যান্য শুল্ক ও চার্জ (ওডিসি) মিলিয়ে বাউন্ড রেটের আওতায় পণ্য সংখ্যা ১ হাজার ৫০০-এর মতো। এর মধ্যে ১ হাজার ১৮৫ পণ্যের শুল্কহার ২০২৬ সালের ভেতর ডব্লিউটিও নির্দেশিত বাউন্ড রেটে নামিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়েছে ট্যারিফ যৌক্তিকীকরণবিষয়ক স্ট্যাডি গ্রুপের প্রতিবেদনে। অন্যদিকে, এরই মধ্যে দেশে এলডিসি-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জাতীয় শুল্কনীতি ২০২৩ প্রণয়ন করেছে। দেশীয় শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধি, রপ্তানি সম্প্রসারণ ও বহুমুখীকরণ, বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে যুগোপযোগী শুল্কনীতির মাধ্যমে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এ নীতির প্রধান উদ্দেশ্য। এতে গত দুই দশকের শুল্ক কাঠামো, বন্ড ব্যবস্থা ইত্যাদি
পর্যালোচনা করে শুল্ক নির্ধারণে ১৬টি সাধারণ নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, ট্যারিফ যৌক্তিকীকরণবিষয়ক স্ট্যাডি গ্রুপের প্রতিবেদনে এ শুল্কনীতির বিভিন্ন টার্মস ও রেফারেন্সের সমন্বয় ঘটেছে।
স্ট্যাডি গ্রুপের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, ৬০টি পণ্য সংশ্লিষ্ট কাস্টমস ডিউটিকে বাউন্ড রেট ট্যারিফের সীমার মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে চলতি বছরের মধ্যে ২০টি, ২০২৫ সালে ২০টি এবং সবশেষ ২০২৬ সালের ভেতর আরও ২০টি পণ্যের শুল্কহারে এ সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনার আওতায় বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। এজন্য কোন বছর কোন ২০টি পণ্যের ওপর এ বাউন্ড রেট ট্যারিফ কার্যকর করা হবে, তা চিহ্নিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
অন্যদিকে, কাস্টমস ডিউটি আরোপযোগ্য পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ৯৩টি পণ্যের হেডিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এইচএস কোডের বিপরীতে নির্ধারিত ন্যূনতম মূল্য পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করতে বলা হয়েছে। এজন্য চলতি বছরের মধ্যে ৩০টি পণ্য, ২০২৫ সালে ৩০টি এবং ২০২৬ সালের মধ্যে বাকি ৩৩টি পণ্যের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
এ ছাড়া ডব্লিউটিওর কাছে বাংলাদেশ কর্তৃক প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন এবং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার অংশ হিসেবে ৫১৬ পণ্যের নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) এবং অনুরূপভাবে আরও ৫১৬ পণ্যে আরোপিত সম্পূরক শুল্ক (এসডি) যৌক্তিকীকরণের সুপারিশ করা হয়েছে। এতে ২০২৩ সালের বাজেটের মাধ্যমে আরডি ১৯১টি এবং এসডি ২৩৪টি, ২০২৪ সালের মধ্যে যথাক্রমে ৯১টি এবং ১৯১টি ও সবশেষ ২০২৫ সালের ভেতর আরডি ২৩৪টি এবং এসডি ৯১টি পণ্যের ওপর কার্যকরের কথা বলা হয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট পণ্যের এইচএস লাইন চিহ্নিত করে নির্ধারিত অর্থবছরের মধ্যে তা প্রতিপালনের তাগিদ দেওয়া হয়।
আর রপ্তানি উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট বিদ্যমান নীতি পর্যালোচনা এবং সুপারিশ প্রণয়নের অংশ হিসেবে ওই প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক দরপত্রের বিপরীতে দেশীয় পণ্য এবং সেবা সরবরাহকারীদের কর অব্যাহতি সমন্বয় করতে বলা হয়। এ কার্যক্রমের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার নং ২৭, তারিখ ২৯ জুলাই ২০২০ বাতিল করার সুপারিশ করা হয়েছে।
এর পাশাপাশি গাইডলাইন ফর ফরেন এক্সচেঞ্জ ট্রানজেকশনের চ্যাপ্টার ৭-এর প্যারাগ্রাফ ৩৫-এ প্রয়োজনীয় সংশোধন করারও সুপারিশ দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসরকারি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, এটি একটি ভালো ও যুগোপযোগী উদ্যোগ। উন্নয়নশীলের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও ডব্লিউটিওর নির্দেশিত বিধিবদ্ধ নিয়ম প্রতিপালনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নির্ধারিত শুল্কহার বাউন্ড রেট ট্যারিফের মধ্যে নামিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। তবে এটি কাগুজে সুপারিশে সীমাবদ্ধ রাখলেই লক্ষ্য পূরণ হবে না। প্রতিবছরই বাজেটারি পদক্ষেপের মাধ্যমে এর কাঙ্ক্ষিত হার বাস্তবায়নও জরুরি।
আর বিজনেস ইনিসিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বলেন, বাংলাদেশ আগামী ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হতে যাচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিভিন্ন পণ্যের ওপর বাংলাদেশের আরোপিত শুল্কহার বাণিজ্যকারী দেশের সঙ্গে নিরপেক্ষ নয়। ডব্লিউটিওর নীতিমালা অনুসারে উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে স্থানীয় এবং আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে আরোপিত ওই শুল্কহার যৌক্তক এবং নিরপেক্ষ হতে হবে। যাতে করে তা দেশজ শিল্প এবং রপ্তানিকারক দেশের সঙ্গে কোনো বৈষম্য সৃষ্টি না করে। এজন্য স্ট্যাডি গ্রুপের সুপারিশ যেমন হতে হবে যুগোপযোগী এবং জটিলতামুক্ত, তেমনি গৃহীত সুপারিশ কার্যকর প্রতিফলন ঘটানোরও চেষ্টা থাকতে হবে।