নিউজ ডেস্ক:
দেশের সব ধরনের প্রযুক্তি খাতকে আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে। কঠোরভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে সরকারি ওয়েবসাইটের। হ্যাকারদের তথ্য চুরি ঠেকাতেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রযুক্তিবিদদের নিয়ে এ সংক্রান্ত একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, দেশে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার কারণে প্রযুক্তিকেন্দ্রিক নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। আগামীতে প্রযুক্তিকেন্দ্রিক অপরাধ বাড়ার আশঙ্কা আরও বেশি। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো হ্যাক করে হ্যাকাররা অনেকেই বিপদে ফেলছে। বিপদে পড়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে নানা ধরনের অনৈতিক সুবিধা। বস্ন্যাক মেইলিংয়ের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটছে অহরহ। সম্প্রতি বিভিন্ন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট হ্যাক করে বা ওইসব ওয়েব সাইটের আদলে হুবহু নকল ওয়েবসাইট বানিয়ে নিরীহ মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে।
প্রযুক্তিগত নানা দিকের বিষয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, সরকারি ওয়েবসাইটগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আইসিটি মন্ত্রণালয়ের। তারা ওয়েবসাইটের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত ও ওয়েবসাইট ডেভেলপ করা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ করে থাকে। আমার দায়িত্বে রয়েছে শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখভাল করা। যার মধ্যে রয়েছে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইমুসহ সামাজিক যোগাযোগের সব মাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিশেষ কোনো ব্যক্তিগত বা গ্রম্নপ বা দাপ্তরিক সাইট বন্ধ করার দায়িত্ব দেওয়া
হয়েছে বিটিআরসিকে (বাংলাদেশ টেলিকম রেগুলেটরি কমিশন)। যার সঙ্গে প্রযুক্তি খাত নিয়ে কাজ করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও যুক্ত। প্রয়োজন অনুযায়ী বিটিআরসি কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত সাইটগুলোকে বন্ধ করাসহ অন্যান্য উদ্যোগ নেন।
একাধিক প্রযুক্তিবিদ নাম প্রকাশ না করার স্বার্থে যায়যায়দিনকে জানিয়েছেন, অতি সম্প্রতি বরিশাল ও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসনের সরকারি ওয়েবসাইট হ্যাক হয়েছিল। মাত্র কয়েক দিনে হ্যাকাররা ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কাড়ি কাড়ি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। পরে দেশের প্রযুক্তিবিদরা হ্যাক হওয়া ওয়েবসাইট উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। চলতি সপ্তাহেই বিদেশি নাগরিকের ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদপত্র প্রযুক্তির মারপঁ্যাচে বানিয়ে দেওয়ার অভিযোগে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এক নারী কর্মকর্তাকে চাকরিচু্যত করা হয়েছে। আরেকজনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রযুক্তির অপব্যবহার করেই ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ বানানো হয়েছিল বলে তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব ধরনের ওয়েবসাইট ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে জড়িত এক শীর্ষ প্রযুক্তিবিদ নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই দেশের অধিকাংশ সরকারি ওয়েবসাইটগুলোর নিরাপত্তা ছিল খুবই দুর্বল। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার হ্যাক করে রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে সরকার। সরকারের তরফ থেকে দেশের প্রযুক্তি খাতের নিরাপত্তা জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তারই ধারাবাহিকতায় দেশীয় প্রযুক্তিবিদরা সরকারের বিভিন্ন ওয়েবসাইট ডেভেলপ ও সফটওয়্যার সরবরাহসহ প্রযুক্তিকেন্দ্রিক নানা ধরনের কাজ করার সুযোগ পান। গত ৫ বছরের দেশের অধিকাংশ সরকারি ওয়েবসাইটের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। যদিও এখনো যৎসামান্য ত্রম্নটি আছে। তবে এসব ত্রম্নটি সাধারণ মানের কোনো হ্যাকারের পক্ষে শনাক্ত করা সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, একটি ওয়েবসাইট সুরক্ষিত থাকে মূলত তিনটি বিশেষ কারণে। যার মধ্যে একটি হচ্ছে ওয়েবসাইটের নিরাপত্তা জোরদার করা। অপরটি হচ্ছে সরকারি ওয়েবসাইট যেসব কর্মকর্তা ব্যবহার করবেন, তাদের প্রযুক্তি বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান থাকা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার যথাযথ জ্ঞান না থাকার কারণেও অনেক সময় হ্যাকাররা ওয়েবসাইটটি বা ওয়েবসাইটগুলো হ্যাক করার সুযোগ পায়। অনেক সময় অনেক কর্মকর্তা পেনড্রাইভ ব্যবহার করেন। যথাযথ নিয়ম মেনে পেনড্রাইভ ব্যবহার না করতে পারলে ওয়েবসাইটের গোপন কোড নম্বর লিক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তখন হ্যাকাররা সেই সুযোগটিকে কাজে লাগায়। আরেকটি হচ্ছে লগইন সিস্টেম। এই সিস্টেমটিতে প্রবেশের পর নানা অপশন আসে। এসব অপশনের অধিকাংশই হ্যাকারদের তরফ কৃত্রিমভাবে প্রবেশ করানো হয়। যারা এমন অপশনের ফাঁদে পা দেন, তখনই ওয়েবসাইটের গোপন কোড নম্বর লিক হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। সেই সুযোগটিকেই কাজে লাগায় হ্যাকাররা।
ওই প্রযুক্তিবিদ বলছেন, হ্যাকার একটি নেগেটিভ শব্দ। হ্যাকার বলতেই মানুষ প্রযুক্তিবিদদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা করেন। এজন্য সারাবিশ্বেই যারা প্রযুক্তি দিয়ে ভালো কাজ করেন তাদের ইথিক্যাল হ্যাকার বলা হয়। এসব হ্যাকার হ্যাক হওয়া কোনো ওয়েবসাইটকে উদ্ধার করেন জনস্বার্থে ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এবং রাষ্ট্রের ভালোর জন্য।
চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের বিসিসির (বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল) উদ্যোগে ইথিক্যাল হ্যাকারদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার আগারগাঁও আইসিটি ভবনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন দেশের ৮০ জন খ্যাতিম্যান ইথিক্যাল হ্যাকার। যাদের মধ্যে ৫০ জনকে প্রথম সারির ইথিক্যাল হ্যাকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। তারা প্রযুক্তির নানা দিক নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন।
বক্তব্য প্রদানকারী একজন শীর্ষ ইথিক্যাল হ্যাকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইথিক্যাল হ্যাকররা এখনো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কাজ করার সুযোগ খুব কমই পাচ্ছে। সরকারের তরফ থেকে বা রাষ্ট্রের কোনো দপ্তর বা অধিদপ্তর যখন তাদের কোনো সমস্যায় পড়ে ডাকেন, শুধু তখনই তারা গিয়ে কাজ করে দিয়ে আসেন। কারণ আগ বাড়িয়ে কাজ করতে যাওয়ার বিপত্তি অনেক।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, অতি সম্প্রতি বরিশাল জেলা প্রশাসনের সরকারি ওয়েবসাইট হ্যাক হয়েছিল। বিষয়টি আমাদের নজরে আসে। ওয়েবসাইটটি উদ্ধার হচ্ছিল না। এক পর্যায়ে আমরা যারা ইথিক্যাল হ্যাকার তারা বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানাই। এতে হিতে-বিপরীত হয়। সাইবার বা প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন প্রথমেই আমাদের সন্দেহ করে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারণা ছিল, আমরাই ওয়েবসাইটটি হ্যাক করেছি। এখানেই শেষ নয়, হ্যাক হওয়া ওয়েবসাইট উদ্ধার করে দিয়ে আমরা জেলা প্রশাসনের কাজ থেকে পারিশ্রমিক হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা নেব। এমন অসৎ উদ্দেশ্যেই আমরাই ওয়েবসাইট হ্যাক করেছি বলে সবার আগে আমাদের সন্দেহ করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা যে ওয়েবসাইটটি হ্যাক করিনি তা প্রমাণ করতে সমর্থ হই। এরপর আমাদের মু্িক্ত মেলে।
এমন ঘটনার পর থেকে আমরা রাষ্ট্রীয় বা সরকারিভাবে ডাক না পেলে আগ বাড়িয়ে কোনো মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের হ্যাক হওয়া ওয়েবসাইট সম্পর্কে তথ্য না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে আমরা অত্যন্ত গোপনে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে বিশ্বস্ত লোকদের মাধ্যমে বিষয়টি জানিয়ে থাকি। এমন ঘটনার পর যদিও রাষ্ট্রযন্ত্রের অনেক বিভাগেরই আমাদের সম্পর্কে ভুল ভেঙেছে।
এই প্রযুক্তিবিদ বলছেন, বাংলাদেশের বর্তমানে সরকারি প্রায় সব ওয়েবসাইটই সুরক্ষিত। তবে লগইন করার পর যৎসামান্য কিছু দুর্বলতা কোনো কোনো ওয়েবসাইটে দেখা যায়। যতটুকু দুর্বলতা আছে তা সুরক্ষিত করার কাজ করছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে যে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ওয়েবসাইটটি পরিচালিত হয়, সেটি আগে সুরক্ষিত করা জরুরি। ইতোমধ্যে সরকারের তরফ থেকে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
যেসব ওয়েবসাইট রেনডম বা হরহামেশাই ব্যবহৃত হচ্ছে, সেগুলোকে সরকার আলাদাভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুরক্ষিত করার কাজ করে যাচ্ছে। তবে বিগত পাঁচ বছরে সরকার প্রযুক্তি খাতে মোটামুটি খুবই শক্তিশালী নিরাপত্তা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। যা ভবিষ্যতে প্রযু্িক্তগত নানা ঝামেলা থেকে রক্ষা পাবে দেশ।
সূত্রটি বলছে, গত সোমবার থেকেই সারাবিশ্বেই অ্যালফাবেট ইন্টারন্যাশনাল নামে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান জনপ্রিয় ভিডিও শেয়ারিং পস্নাটফর্ম ইউটিউব ব্যবহারে জটিলতা দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে প্রযুক্তিগত সেবা জি মেইল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশেও।