নিউজ ডেস্ক:
পর্যটন শহর কক্সবাজারে গেলে চোখে পড়বে নানা রং ও আকৃতির শামুক-ঝিনুক। চোখে পড়বে শামুক-ঝিনুকের তৈরি মালা, শোপিস, ঝাড়বাতি, হাতের ব্যাগসহ নানা কারুকাজের জিনিসপত্র। এসব শৌখিন জিনিসপত্র এখানকার পথঘাটে তো পাওয়াই যায়, এগুলো বেচাকেনার জন্য রয়েছে মার্কেটও। তবে কক্সবাজারের ঝিলংঝার চান্দেরপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এই এলাকায় মাটি ফুঁড়ে ফুটে উঠছে বিশাল এক ঝিনুক! অবশ্য এটি সাগরের ঝিনুক নয়, ঝিনুকের আদলে প্রাণহীন ইট-পাথরের প্রতিকৃতির কক্সবাজার রেলস্টেশন। চট্টগ্রাম থেকে রেললাইন যাচ্ছে কক্সবাজারে। সেখানে ঝিনুকের আকৃতিতে গড়ে তোলা হচ্ছে দেশের প্রথম আইকনিক রেলস্টেশন ভবন। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নিয়ে যাওয়ার প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর অন্যতম। ফলে আগামী নির্বাচনের আগে, অর্থাৎ বর্তমান সরকারের মেয়াদেই স্বপ্নের এ রেললাইন চালু করতে প্রকল্প দ্রুত শেষ করার জন্য জোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এটা হলে এ বছরেই ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ট্রেন যাবে পর্যটন শহর কক্সবাজারে।
এ জন্য রেললাইনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শেষ করে আনা হচ্ছে স্টেশনটির নির্মাণকাজ। ইতোমধ্যে প্রায় ৬০ কিলোমিটার রেললাইন বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। সমানে চলছে অন্যান্য স্টেশন, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের কাজও। সব মিলিয়ে প্রকল্পের ৮০ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্টেশনটি নির্মাণ করা হচ্ছে কক্সবাজারে। শেষ পর্যায়ে রয়েছে কক্সবাজারে ঝিনুকের আদলে তৈরি করা দেশের প্রথম এই আইকনিক রেলওয়ে স্টেশনের কাজ। ২৯ একর জমির ওপর ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩৭ বর্গফুট জায়গায় গড়ে উঠছে রেলস্টেশন ভবনটি। ভবনটি হবে ছয়তলা। মূল ভবনের সামনে খোলা মাঠে তৈরি হবে ঝিনুকাকৃতির দৃষ্টিনন্দন একটি ফোয়ারা। যাত্রীরা ঝিনুক ফোয়ারা দিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করবেন। তারপর চলন্ত সিঁড়ি আর পদচারী সেতু হয়ে উঠবেন ট্রেনে। আবার ট্রেন থেকে নেমে ভিন্ন পথে বেরিয়ে যাত্রীরা পা বাড়াবেন সৈকত শহরে। এজন্য তৈরি হচ্ছে গমন ও বহির্গমনের পৃথক দুটি সড়ক। স্টেশনে থাকছে পর্যাপ্তসংখ্যক গাড়ি পার্কিংয়ের তিনটি বড় জায়গা।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে সংশ্নিষ্ট প্রকৌশলীদের তত্ত্বাবধানে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক কাজ করছেন। এরই মধ্যে স্টেশনটির মূল কাঠামোর নির্মাণকাজ প্রায় শেষ করে আনা হয়েছে। স্টেশনের সামনের দিকে নির্মাণ করা হচ্ছে ঝিনুক আকৃতির দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারাটিও। কর্তব্যরত প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, স্টেশন ভবনের উত্তরে ৬৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থের তিনটি প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ করা হচ্ছে। পর্যটকরা যাতে স্টেশনে লাগেজ রেখেই দিনভর সমুদ্রসৈকত ভ্রমণ করে রাতের ট্রেনে ফিরতে পারেন, সে জন্য রাখা হচ্ছে লকারের ব্যবস্থা। টিকিট কাউন্টার, অভ্যর্থনা কক্ষ, তথ্যকেন্দ্র, মসজিদ, শিশুদের বিনোদনের জায়গা, প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জ, শপিংমল, রেঁস্তোরা, কনফারেন্স হল ও কর্মকর্তাদের কার্যালয়। এ ছাড়া কক্সবাজার অংশে মাইলের পর মাইল দৃশ্যমান রেললাইন।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড দুই ভাগে কাজটি করছে। এর আগে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারের ঝিলংজায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প উদ্বোধন করেন। ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল এটি ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।
জানা যায়, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইনের মধ্যে ৩৯টি বড় সেতু, ২২৩টি ছোট সেতু ও কালভার্ট, বিভিন্ন ধরনের ৯৬টি লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করা হচ্ছে। হাতি চলাচলের জন্য রাখা হয়েছে আন্ডারপাস। ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজারে।
গত ১৮ জানুয়ারি চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড মাঠে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। তখন তিনি আগামী জুনের মধ্যে রেলপথ স্থাপন এবং ডিসেম্বরের মধ্যে স্টেশন ব্রিজ-কালভার্টসহ অন্যান্য নির্মাণকাজ শেষে চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেললাইনে ট্রেন চালু করা হবে বলে জানান। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মফিজুর রহমান বলেন, করোনা মহামারি ও বর্ষা মৌসুমের ভারি বৃষ্টিপাতসহ নানা কারণে কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যায়নি। তবে চলতি বছরের মধ্যেই ট্রেন চালু করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে। রেললাইন স্থাপনের পাশাপাশি অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের কাজও সমানে চলছে।
চলতি বছরের শেষ নাগাদ ট্রেন চালুর কথা বলা হলেও সেটা আদৌ সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন উঠেছে। কারণ কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাট সেতুর ওপর দিয়ে যাবে কক্সবাজার রেললাইনের ট্রেন। কিন্তু কালুরঘাট সেতুটি পুরোনো ও জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষই ২০০১ সালে সেতুটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। সড়ক-কাম রেল সেতুটি দিয়ে এখন যেসব ট্রেন চলাচল করে, সেগুলোর এক্সেল লোড ১১ দশমিক ৯৬ টন। কিন্তু রেলওয়ে কক্সবাজারে যে ট্রেন নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে, সেসব ইঞ্জিন ১৫ এক্সেল লোডের। যেহেতু কর্ণফুলী নদীতে নতুন রেল সেতু করা অনেক সময়ের ব্যাপার, তাই পুরোনো সেতুটি সংস্কার করেই কক্সবাজার রুটে ট্রেন চালাতে চায় রেলওয়ে। এ জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দ্বারস্থ হয় রেলওয়ে। তবে সেতুটির সংস্কারকাজ এখনও শুরুই করা যায়নি। বুয়েট ও রেলের সংশ্নিষ্ট প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, সেতুটির সংস্কারকাজ শেষ করতে কমপক্ষে এক বছর লেগে যেতে পারে। ফলে এ সময়ের মধ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন চালু করা যাবে কিনা সংশয় রয়েছে।