বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা রেলপথগুলো একে একে চালু হচ্ছে। রেলওয়ের সংযোগ পয়েন্ট চালুর মধ্য দিয়ে দু’দেশের যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে আমূল পরিবর্তন আসছে। রেলপথে পণ্য আনা-নেওয়া সড়কপথের চেয়ে যেমন অনেক সহজ ও সাশ্রয়ী। অন্যান্য পরিবহণের তুলনায় এটি জাতীয় বা বৈশ্বিক ক্ষেত্রে আরও অর্থনৈতিক এবং নিরাপদ সুযোগ সরবরাহের দুয়ার খুলে দেয়।
পৃথিবীর বেশকিছু দেশ এই চলাচল সুবিধা ব্যবহার করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়ে উন্নতির শিখরে আরোহন করছে। এছাড়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগী ও অন্যান্য স্বার্থভিত্তিক বিবিধ সম্পর্কে সংযুক্ত হচ্ছে। ফলে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই যোগাযোগ ব্যবস্থা দ্বারা বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশই লাভবান হচ্ছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং ভারতীয় হাইকমিশন ঢাকা সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ভারত ও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ৭টি আন্তঃসীমান্ত রেল সংযোগ ছিল। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের পরে ধ্বংস বা বন্ধ হয়ে যায় ৫টি রেলসংযোগ। যেগুলো পরবর্তীতে পুনরুদ্ধার করে কার্যকর করা হয়েছে। যা হলো, পেট্রাপোল (ভারত)- বেনাপোল (বাংলাদেশ), গেদে (ভারত)-দর্শনা (বাংলাদেশ), সিংহবাদ (ভারত)-রোহনপুর (বাংলাদেশ), রাধিকাপুর (ভারত)-বিরল (বাংলাদেশ) ও হলদিবাড়ি (ভারত)-চিলাহাটি (বাংলাদেশ)। অবশিষ্ট ২টি রেল সংযোগ নির্মাণাধীন রয়েছে। যেখানে আগরতলা (ভারত)-আখাউড়া (বাংলাদেশ) ও করিমগঞ্জ/মহিশাসন (ভারত)-শাহবাজপুর (বাংলাদেশ) রেলসংযোগও চালু হওয়ার পথে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের একাধিক বিবৃতি সূত্রে জানা যায়, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রেল সংযোগ সম্প্রসারিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে আর্থিক, কারিগরি, অপারেশনাল এবং অবকাঠামোর উন্নতিতে ভারত সরকার ঋণ দিচ্ছে। আন্তর্দেশীয় মালগাড়ি চলাচল, গেজ কনভার্সন অর্থাৎ মিটার গেজ লাইনকে ব্রডগেজে রূপান্তরিত করা, রোলিং স্টক অর্থাৎ ইঞ্জিন, ওয়াগন ও যাত্রীবাহী কোচ আধুনিকীকরণে সহযোগিতা করছে। এতে লাভবান হচ্ছে দু’দেশই। ইঞ্জিন, কামরা, ওয়াগন একই প্রযুক্তির হওয়ায় দ্রুত যাত্রী ও মাল পরিবহনের সময় ও খরচের অনেক সাশ্রয় হচ্ছে।
দুদেশের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তারা জানান, দু’দেশের মধ্যে রেল যোগাযোগের ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ফলে বন্ধ থাকা লাইনগুলো পুনরুদ্ধারে দু’দেশের সরকার ঐকমত্যে পৌঁছেছে। সবগুলো লাইন চালু হলে দেশ দুটির মধ্যে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন বৃদ্ধি পাবে। ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে ও এশিয়ান রেলওয়েতে সম্পৃক্ত হতে পারলে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক বাড়বে। এছাড়াও বৈশি^কভাবেও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে গতিশীল এবং পরিবেশবান্ধব করতে রেলপথ বিশেষ সহায়ক হিসেবে সর্বস্থানে গ্রহণযোগ্য।
ভারতীয় হাইকমিশন ঢাকা সূত্রে জানা যায়, রেলপথে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরিতে নানা ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিনটি আন্তঃসীমান্ত ট্রেন সার্ভিস রয়েছে। ২০০৮ সালে চালু হওয়া মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেন সার্ভিসটি কলকাতা ও ঢাকা, ২০১৭ সালে চালু হওয়া বন্ধন এক্সপ্রেস ট্রেন সার্ভিসটি খুলনা ও কলকাতার মধ্যে চলাচল করে। এই দুটি ট্রেন পরিষেবা ২০২২ সালের মে মাসের শেষের দিকে কোভিড-১৯’র পরে আবার চালু করা হয়েছিল এবং ঢাকা ও নিউ জলপাইগুড়ির মধ্যে তৃতীয় ও নতুন আন্তঃসীমান্ত মিতালি এক্সপ্রেস ট্রেন পরিষেবা ১ জুন ২০২২ এ চালু হয়।
এদিকে ২০২২ এ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে রেলওয়ে সংযোগ বৃদ্ধিকে প্রাধান্য দিয়ে বেশ কয়েকটি নতুন প্রকল্পে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। ভারত বাংলাদেশকে অনুদানের ভিত্তিতে ২০টি ব্রডগেজ লোকো প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং দুটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে। একটি ভারতীয় রেলওয়ে ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং অন্যটি বাংলাদেশ রেলওয়ের ডিজিটালাইজিং ও দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে আইটি অ্যাপ্লিকেশন প্রবর্তনের জন্য।
এছাড়াও বর্তমানে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫টি কার্যকর রেল-সংযোগের সবকটি মালবাহী ট্রেন নিয়মিত চলাচল করছে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন (বাংলাদেশ অর্থবছর ২১-২২) এর মধ্যে পণ্য পরিবহনের মোট ১৫৯৮টি ভারতীয় রেলওয়ে রেক বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল। মোট ১৫৮৩০৫.৫ ওয়াগন বরাদ্দ করা হয়েছিল এবং এ সময়ে দ্বিপাক্ষিক ট্রাফিক থেকে মোটা অংকের মুনাফাও আয়ও হয়েছিল। এ উদ্যোগগুলো থেকে বোঝা যায় দুদেশের মধ্যে রেল যোগাযোগের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বাকি সংযোগগুলো চালু হলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ বৃদ্ধি পাবে। যা দুদেশেরই অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে যার সুফল ইতিমধ্যেই পাওয়া শুরু হয়েছে। এতে করে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের সংখ্যাও বাড়বে। এতে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে রেল যোগাযোগে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে মনে করেন দুদেশের সংশ্লিষ্ট সকলে।