হাওড়ের বুক চিরে শেখ হাসিনা সড়ক : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর এগিয়ে যাওয়া
স্বপ্নের হাতছানি দিচ্ছে হাওরের বুকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়া-বিজয়নগরের শেখ হাসিনা সড়ক। হাওরের স্বচ্ছ জলরাশি ভেদ করে একে বেঁকে যাওয়া সড়কটির কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। এটি কেবল একটি সড়কই নয়, যেন পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর এগিয়ে যাওয়ার বার্তা। সড়কটির ফলে জেলা সদরের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগযোগ স্থাপিত হচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত বিজয়নগর উপজেলার। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে ওই অঞ্চলের শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষিসহ সামগ্রিক আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে। বহুল কাক্সিক্ষত সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ দিকে হলেও এখন থেকেই এর সুফল পেতে শুরু করেছে বিজয়নগর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের অন্তত আড়াই লক্ষাধিক জনগোষ্ঠী। ইতোমধ্যে জেলা সদর ও বিজয়নগর উপজেলার মানুষ পায়ে হেঁটে ও সিএনজি অটোরিকশায় করে আসা যাওয়া করতে পারছে। এতে করে তাদের আর অন্য উপজেলার ওপর দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে না। স্থানীয়রা দ্রুত অবশিষ্ট নির্মাণকাজ শেষ করে স্বপ্নের এ সড়কটি পুরোপুরি চালুর দাবি জানিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, ২০২৩ সালের জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারি মাসে সড়কটি পুরোপুরিভাবে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া সম্ভব হবে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরের সঙ্গে বিজয়নগর উপজেলার সরাসারি কোনো সংযোগ সড়ক নেই। প্রায় ৩৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জেলার আখাউড়া অথবা সরাইল হয়ে জেলা সদরে আসতে হয়। এতে সময় লাগে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয় পত্তন, সিঙ্গারবিল, চম্পকনগর, বিষ্ণুপুর ও পাহাড়পুর ইউনিয়নের বাসিন্দাদের।
বর্ষাকালে হাওর পাড়ি দিয়ে জেলা শহরে আসতে তাদের একমাত্র ভরসা নৌকা, আর শুষ্ক মৌসুমে পায়ে হাঁটা ছাড়া বিকল্প নেই। তাই কয়েক দশক ধরেই বিজয়নগরবাসী দাবি জানিয়ে আসছিল হাওরের বুকে সড়ক নির্মাণের। কিন্তু হাওড়ে সড়ক নির্মাণে অনেকটা চ্যালেঞ্জ ছিল সংশ্লিষ্টদের জন্য। বছরের অর্ধক সময় পানিতে টুইট¤ু^র থাকে বিস্তীর্ণ হাওড় এলাকা।
অবশেষে সব বাধা ডিঙিয়ে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের শিরাইলকান্দি থেকে বিজয়নগরের পত্তন ইউনিয়নের সিমনা পর্যন্তÍ সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ভূমি অধিগ্রহণসহ নানা জটিলতার কারণে নির্মাণকাজ বিলম্বিত হয়েছে। এখন কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সড়কটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৩৫ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে শেখ হাসিনা সড়ক। বর্ষাকালে ভাঙন রোধে সড়কের পাশে বসানো হয়েছে সিসি ব্লক। সড়কের তিনটি সেতুর সবকটিরই নির্মাণ কাজ শেষ। সেতুর এপ্রোচ সড়কের কাজ শেষ করে শুরু হবে কারপেটিং কাজ। এরপরই খুলে দেয়া হবে স্বপ্নের শেখ হাসিনা সড়ক। সাড়ে ৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ সড়ক শুধু যে শহরের সঙ্গে দূরত্বই কমাবে তা নয়; ভূমিকা রাখবে স্থানীয় কৃষি, শিক্ষা ও অর্থনীতিতে।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, প্রতি বছর বিজয়নগর উপজেলায় প্রায় ৫০ কোটি টাকা মূল্যের আম, লিচু, মাল্টা ও কাঁঠালসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফল উৎপাদিত হয়। কিন্তু যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় কৃষকরা যথাসময়ে এসব ফল জেলা শহরে নিয়ে যেতে পারতেন না। এতে করে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতেন তারা। এখন শেখ হাসিনা সড়ক ব্যবহার করে দ্রুত সময়ের মধ্যে উৎপাদিত ফল শহরে নিয়ে যেতে পারবেন কৃষকরা। অসুস্থ মানুষের দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করাটাও কঠিন ছিল। এজন্য তাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অন্য উপজেলার ওপর দিয়ে সদরে পৌঁছাতে হয়েছে। এতে তাদের আর্থিক অপচয়সহ সময়ও নষ্ট হতো। তবে এখন সড়কটি হয়ে যাওয়ায় এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ দিনের দুঃখের অবসান ঘটবে। সড়কটি দ্রুত চালু হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে।
এলজিইডি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী এ টি এম রবিউল আলম বলেন, ব্রিজ, এপ্রোচসহ সড়কের সব কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। দ্রুত সময়ের মধ্যে কারপেটিংয়ের কাজ শুরু হবে। আগামী ১/২ মাসের মধ্যে কাজ শেষ করে চলাচলের জন্য পুরোপুরিভাবে উন্মুক্ত করে দেয়া সম্ভব হবে। তবে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, হাওড়ের মাঝে সড়কটি নির্মাণ করতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। সেই সঙ্গে করোনা মহামারির কারণেও কাজের গতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা যায়নি। এখন সব ঠিকঠাক থাকলে জানুয়ারিতেই সড়কটি দিয়ে যান চলাচল শুরু হবে।