দেশের কারাগারগুলোয় মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন কিংবা ইলেকট্র্রনিক ডিভাইস ব্যবহার বন্ধ করাসহ একগুচ্ছ সুপারিশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের গঠিত তদন্ত কমিটি। সম্প্রতি ঢাকার আদালতপাড়া থেকে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার পর গঠিত তদন্ত কমিটি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে। এমন পরিস্থিতির মোকাবিলায় কারাগারগুলোর জ্যামার সার্বক্ষণিক সচল রাখার পাশাপাশি কোনো আসামিই যাতে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন কিংবা ইলেকট্র্রনিক ডিভাইস সঙ্গে রাখতে না পারে সে ব্যাপারে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়।
সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : ১. কারাগারের সর্বত্র ব্যাকআপসহ সিসি ক্যামেরা স্থাপন, যাতে কারাগারের যে-কোনো ধরনের অসংগতি, অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি ও অনিয়মের বিষয় কারা কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক জানতে পারে। সেই সিসি ফুটেজের ছয় মাস থেকে এক বছরের ব্যাকআপ সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ২. কারাগারগুলোর প্রতিটি প্রবেশদ্বারে ব্যাকআপসহ বডি ও লাগেজ স্ক্যানার স্থাপন করতে হবে; যাতে কেউ ইচ্ছা করলেই অবৈধ কোনো মালামাল বা মাদকদ্রব্য নিয়ে ঢুকতে না পারে। ৩. কারাগারের স্পর্শকাতর জায়গায় যেসব কারারক্ষী বা কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী দায়িত্ব পালন করবেন তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয় (ব্যাকগ্রাউন্ড) সরকারি এজেন্সির মাধ্যমে যাচাই করতে হবে। ৪. দণ্ডপ্রাপ্ত ফাঁসির আসামি বা দুর্ধর্ষ বন্দির বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত চিঠিপত্রের মাধ্যমে না করে ইমেইল বা স্বীকৃত কোনো মাধ্যমে করতে হবে। ৫. আদালতের শুনানি কার্যক্রমে দণ্ডপ্রাপ্ত ফাঁসির আসামি বা দুর্ধর্ষ বন্দির ক্ষেত্রে শারীরিক উপস্থিতি অব্যাহতি দিয়ে ভার্চুয়ালি হাজিরার ব্যবস্থা করতে হবে। ৬. আসামিদের শুনানির ক্ষেত্রে আদালত চত্বরে সব ধরনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে একটি সেল গঠন করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম চালাতে হবে। এ ছাড়া আদালতে আসামিদের হাজির করার ক্ষেত্রে ডান্ডাবেড়ি পরানোর সুপারিশ করেছে সরকার কর্তৃক গঠিত ওই তদন্ত কমিটি। ২০ নভেম্বর পুলিশের চোখে স্প্রে ছুড়ে রাজধানীর আদালতপাড়া থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার পরই দেশে জারি করা হয় রেড অ্যালার্ট। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনা তদন্তে ২১ নভেম্বর সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের (কারা) নেতৃত্বে চার সদস্যের কমিটি গঠন করে মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবের কাছে জমা দিয়েছে। তবে প্রতিবেদন নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি কমিটির কোনো সদস্য। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুরক্ষা সেবা বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, কারাগারের অধিকাংশ দুর্ঘটনার সঙ্গে একশ্রেণির অসাধু কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী, কর্তব্যরত পুলিশের কিছু সদস্য জড়িত থাকেন। বন্দি আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা ওই সময় বন্দিদের মাদক, মোবাইল ফোন ও বিভিন্ন অবৈধ দ্রব্য দিয়ে থাকেন। বন্দিদের নিরাপত্তাও ওই সময় শিথিল থাকে। এসব কারণেই মূলত বন্দি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া কারাগারে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে অপরাধীরা তাদের সহযোগীদের আগাম তথ্য পাচার করে দিয়ে থাকে। জানা গেছে, কারাগারে বন্দি আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে পুলিশ অধিদফতরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে ২৫ অক্টোবর জননিরাপত্তা বিভাগে চিঠি দেয় সুরক্ষা সেবা বিভাগ। চিঠিতে বলা হয়, দেশের কারাগারে আটক বন্দিদের কারাফটক থেকে পুলিশি পাহারায় আদালতে নেওয়া হয়। আদালতের কার্যক্রম শেষে পুনরায় কারাগারে প্রত্যাবর্তনের সময় যাতে বন্দিরা মাদক, মোবাইল ফোন ও অবৈধ দ্রব্য বহন করতে না পারেন এ লক্ষ্যে ওই সময় পুলিশি নজরদারি ও তল্লাশি কার্যক্রম জোরদার করার জন্য পুলিশ অধিদফতরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে অনুরোধ জানানো হয়। এর আগেও কারাগারের অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর সুরক্ষা সেবা বিভাগের তৎকালীন যুগ্মসচিব মুনিম হাসানের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল কমিটি। ওই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে নিয়মিতভাবে প্রিজনভ্যানে আসামিদের কোর্টে পাঠানো হয়। সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রিজনভ্যানে গমনকারী আসামিরা তাদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলার জন্য কর্তব্যরত পুলিশ চার-পাঁচটি মোবাইল ফোন প্রিজনভ্যানে দেওয়া হয়। কারাগার থেকে আসামিদের কোর্টে প্রিজনভ্যানের মাধ্যমে আনা-নেওয়ার কাজটি পুলিশ করে থাকে।’