নিউজ ডেস্ক:
আমদানি বাণিজ্যে ডলারনির্ভরতা কমাতে চায় সরকার। চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে বিশ্বব্যাপী মার্কিন ডলারের আধিপত্য চলছে। বাংলাদেশের ব্যাংক ও অব্যাংক খাতে প্রায় প্রতিদিনই হুহু করে ডলারের দাম বাড়ছে। ইতিহাসের পাতায় রেকর্ড হয়ে টাকার বিপরীতে ডলার ১১৫ টাকায় উঠেছে। একই সঙ্গে ইউরোর দামও বাড়ছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। ডলার সংকটের কারণে আমদানির এলসি খুলতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। অবশ্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিদেশ ভ্রমণ, বিলাসী পণ্য আমদানিসহ ডলার খরচ কমাতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিলেও সংকট কমছে না। বরং প্রতিদিনই এই সংকট তীব্র হচ্ছে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের তুলনায় আমদানি ব্যয়ের ক্ষেত্রে প্রতি মাসে অন্তত ২ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে ডলারের আধিপত্য আরও বাড়ছে। তাই বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানি বাণিজ্যে ডলারের ঘাটতি কমাতে ভিন্ন পথ খুঁজছে সরকার। এ জন্য ডলারের প্রতি নির্ভরতা কমিয়ে চৈনিক মুদ্রা ইউয়ান, ভারতীয় রুপি এবং রাশিয়ার মুদ্রা রুবলসহ আরও বিভিন্ন দেশের মুদ্রাকে বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের জন্য চিন্তা-ভাবনার পথ খোঁজা হচ্ছে। এমনকি সরকারের ভিতরে ও বাইরে এ নিয়ে জোরালো আলোচনা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের আধিপত্য কমাতে অনেক দেশই চেষ্টা করছে। আমরাও চীনের সঙ্গে এক ধরনের আলাপ-আলোচনা করছি। তবে এটা একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তিনি বলেন, এর কৌশল কী হবে, কোন প্রক্রিয়ায় আমরা এগোব এখনো সেসব নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবি বলছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কিছু মুদ্রা নিজেদের উপস্থিতি জোরালো করতে সচেষ্ট। বৈশ্বিক বাণিজ্যে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও লেনদেনে মুদ্রাগুলো নিজেদের ভূমিকা বিস্তৃত করছে। এর মধ্যে আছে ইউরোপের মুদ্রা ইউরো, জাপানের ইয়েন ও ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিং। চীনের ইউয়ান এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আসছে, রাশিয়ার রুবলও প্রভাব বিস্তার করছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি অনেক বেড়েছে। এক বছরে রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেশি হয়েছে ৩ হাজার ৩২৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) চেয়ে প্রায় ৯১৪ কোটি ডলার বেশি এবং এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা ধরে) এ ঘাটতির পরিমাণ ৩ লাখ ১৪ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। গত অর্থবছর এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩৭৭ কোটি ডলার। এ ছাড়া বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের একটা বড় অংশই হয়ে থাকে চীনের সঙ্গে। দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে অব্যাহতভাবে। এ ছাড়া আরেক প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গেও বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। এর বাইরে রাশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। এসব দেশের সঙ্গে আন্তবাণিজ্যে লেনদেনের ক্ষেত্রে একক মুদ্রা হিসেবে ডলারের আধিপত্য কমাতে চায় সরকার। এসব দেশের মুদ্রায় লেনদেন করতে পারলে একদিকে ডলারের প্রতি নির্ভরতা কমবে, অন্যদিকে বাণিজ্য ঘাটতিও কমে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে বাংলা-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও মুখপাত্র আল মামুন মৃধা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বৈশ্বিক এই সংকটে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংকট হলো ডলার সংকট। আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি প্রতিদিনই বাড়ছে। চলমান এই সংকট নিরসনে সরকার অনেক উদ্যোগ নিলেও তা কাজে আসছে না। চীনসহ বিশ্বের অন্যান্য যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি অনেক বেশি সেসব দেশের সঙ্গে তাদের মুদ্রায় লেনদেন করতে পারলে তা ঘাটতি কমিয়ে আনার সহায়ক হবে। একই সঙ্গে মার্কিন ডলারের আধিপত্যও কমে আসবে, যা সামগ্রিকভাবে চলমান বৈশ্বিক সংকট নিরসনে বাংলাদেশ অনেকটা স্বস্তিদায়ক পথের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে বলে তিনি মনে করেন। এর জন্য বাংলাদেশ সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে উদ্যোগ নিতে হবে। ফেডারেল ব্যাংক অব রিজার্ভ (ফেড)-এর সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনা করে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অর্থ পরিশোধ ও প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নস্ট্র, ভস্ট্র ব্যাংক হিসাব ব্যবহারের মাধ্যমে লেনদেন নিষ্পত্তি করা হয়। এক্ষেত্রে সে কাজই করতে হবে সবার আগে। আর এ প্রক্রিয়া দ্রুত করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। এদিকে অর্থবিভাগের একটি সূত্র জানায়, গত সপ্তাহে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ঢাকা সফর করে গেছেন। এ সময় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। সে সময় উপরোক্ত ইস্যুতেও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। চীনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জানানো হয়েছে বাংলাদেশ সরকার চীনা মুদ্রায় আন্তর্জাতিক লেনদেন নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিলে তারা তাদের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহায়তা করবেন। এদিকে সম্প্রতি বিসিসিসিআইর এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, চীন আমাদের জন্য একটি বড় বাজার। বাংলাদেশের জন্য প্রচুর সম্ভাবনাময়। কিন্তু সে দেশ থেকে শুধু আমদানি বাড়ছে। বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে রপ্তানি বৃদ্ধির বিকল্প নেই। সেখানে আমাদের অনেক পণ্য রপ্তানির সুযোগ রয়েছে, সেটা কাজে লাগাতে হবে। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ যেসব দেশে আমরা পোশাক রপ্তানি করছি, চীন তার চেয়েও কয়েক গুণ বড় বাজার। আমাদের শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালসহ বিভিন্ন পণ্য চীন থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু রপ্তানি করতে পারি না। সে জন্য চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ব্যবধান অনেক বেশি। এ ঘাটতি কমাতে হলে চীনে আমাদের রপ্তানি বাড়াতে হবে। একই অনুষ্ঠানে অন্য বক্তারা বলেন, চীন বা অন্য কোনো দেশের মুদ্রায় আন্তর্জাতিক লেনদেনগুলো করতে পারলে আমাদের ডলারনির্ভরতা কমে আসবে। এতে টাকার মানও শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখতে পারবে। এতে বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্র জানায়, বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে চীনে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৬৮০ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যেখানে ওই বছর আমদানি হয়েছে প্রায় ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য। এ বিশাল বাণিজ্য ব্যবধান কমিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করছে সরকার। এদিকে আরেক প্রতিবেশী দেশ ভারতে পণ্য রপ্তানিতে নতুন আশা জাগিয়েছে বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি দেড় বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। গত অর্থবছরের ২০২১-২২ অর্থবছর আগের বছরের তুলনায় ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে। একক দেশ হিসেবে ভারত এখন বাংলাদেশের সপ্তম রপ্তানি বাজারের তালিকায় উঠে এসেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের শীর্ষ ১০ বাজারের একটি এখন ভারত। অথচ গত অর্থবছরেও বাংলাদেশের শীর্ষ ১০ রপ্তানি বাজারের তালিকায় ভারতের স্থান ছিল না। আগের বছরগুলোতে ভারতের অবস্থান ছিল ১৪-১৫তম স্থানে। সবার ওপরে বরাবরের মতোই যুক্তরাষ্ট্র অবস্থান করছে। দ্বিতীয় স্থানে জার্মানি। তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানে যথাক্রমে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন ও পোল্যান্ড। এদিকে সোমবার (১ আগস্ট) ২০২১-২২ অর্থবছরের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চলতি হিসাব ভারসাম্যে (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স) বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। বিদায়ী অর্থবছরের ঘাটতির (ঋণাত্মক) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৬৯ কোটি ডলার। আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে একই সময়ে ঘাটতি ছিল ৪৫৭ কোটি ডলার। এ ছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরের সামগ্রিক লেনদেনে (ওভার অল ব্যালেন্স) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৩৮ কোটি ডলার। অথচ ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে এই সূচকে ৯২৭ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর দেশে ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে এসেছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে এসেছিল ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ডলার। একই সময়ে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪ হাজার ৯২৪ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের চেয়ে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। একই সময় আমদানি ব্যয় হয়েছে ৮ হাজার ২৪৯ কোটি ডলার। আমদানি বেড়েছে ৩৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। রপ্তানির চেয়ে আমদানি বৃদ্ধির হার বেশি হওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতিও বেড়েছে।