আবু জাফর সিদ্দিকী:
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিলের নাম চলনবিল। ৩টি জেলাজুড়ে এর বিস্তৃতি। নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার অংশ জুড়ে যে জলভূমি বর্ষা এবং বর্ষাপরবর্তী সময়ে দেখা যায় সেটাই বিখ্যাত চলনবিল। শুকনো মৌসুমে এসব বিলে জল থাকে না। তখন চাষাবাদ চলে বিলের জমিনে। তবে বর্ষায় কানায় কানায় পানিতে পূর্ণ হয়ে রূপের পসরা সাজিয়ে বসে। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চলনবিল ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। ব্রহ্মপুত্র নদ যখন তার প্রবাহপথ পরিবর্তন করে বর্তমান যমুনায় রূপ নেয়, সে সময়েই চলনবিলের সৃষ্টি। গঠিত হওয়ার সময় চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় ১ হাজার ৮৮ বর্গ কিলোমিটার। বর্তমানে এর আয়তন অনেক কমে এসেছে।
আসলে চলনবিল অনেকগুলো ছোট ছোট বিলের সমষ্টি। বর্ষায় এই বিলগুলোতে জলপ্রবাহ বেড়ে এরা একসঙ্গে বিশাল এক বিলের রূপ নেয়। সিরাজগঞ্জ জেলার অংশ বিশেষ, পাবনা জেলার চাটমোহর এবং নাটোর জেলার সিংড়া ও গুরুদাসপুর উপজেলাজুড়ে এ বিলের বিস্তৃতি। বর্ষাকালে প্রকৃতির অপরূপ রূপে সাজে এ বিল। চারিদিকে শুধু পানি থৈ-থৈ করে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসুরা ভিড় করে চলনবিলে। এই ভরা বর্ষা মৌসুমেও সেটাই ঘটছে। এ মুহূর্তে দিগন্তপ্রসারি টলমল জলে এক নয়নমনোহর রূপে, এক অপরূপ সাজে সেজেছে চলনবিল।
সারাদেশের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রের মতোই একটি স্থান চলনবিল। সাপ্তাহিক ছুটির দিন অর্থাৎ শুক্রবার দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এ অঞ্চলে ছুটে আসেন হাজার হাজার মানুষ। প্রতিদিনই ভিড় জমে এ বিলে। মোটর সাইকেল, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস এমনকি রিকশায় চড়ে হাজারো মানুষকে আসতে দেখা যায় চলনবিল এলাকায়। শুক্রবার বিকেল হলেই বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের কর্মকর্তারা, চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা চলে আসেন আনন্দ উপভোগের জন্য। শ্যালো নৌকা, বৈঠা-নৌকা, পালতোলা নৌকায় ঘুরতে দেখা যায় ভ্রমণপিপাসুদের।
প্রায় ৩৫০ বছর আগে সিংড়া উপজেলার ডাহিয়া এলাকায় ইসলাম প্রচার করতে আসা ঘাসী-ই-দেওয়ানের তিশিখালীর মাজার রয়েছে। সেখানে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে খয়রাত বা মানসা করতে আসেন লোকজন। সেখানে নামাজের জন্য রয়েছে একটি মসজিদও। এই সুযোগে দেখে নিতে পারেন চলনবিল জাদুঘরটিও। গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজিপুর গ্রামে অবস্থিত এ জাদুঘর। স্থানীয় শিক্ষক আব্দুল হামিদ ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় নিজ বাড়িতে ১৯৭৮ সালে গড়ে তুলেছেন ব্যতিক্রমী এ সংগ্রহশালা।
চলনবিলে প্রাপ্ত নানান নিদর্শন, মাছ ধরার বিভিন্ন সরঞ্জাম ছাড়াও এখানে আছে অনেক দুর্লভ সংগ্রহ। আবহমান বাংলার হৃদয়কাঁড়া অপরূপ সৌন্দর্য আর ইতিহাস-ঐতিহ্যমন্ডিত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ভরপুর উত্তর জনপদের বিরল প্রাকৃতিক জলসম্পদ দেশের বৃহত্তম বিল চলনবিল। বিশাল অবয়ব আর ঐতিহ্যে ভরা কিংবদন্তির ভান্ডার চলনবিলে বর্ষার বিপুল জলরাশি, প্রাকৃতিক মাছ আর অজস্র পাখির সমারোহ যে কোনো পর্যটকের হৃদয় কাঁড়ে। তাই বর্ষায় প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা থেকে আগত প্রকৃতিপ্রেমী হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে শত শত নৌকা ছুটে বেড়ায় চলনবিলের বুক চিরে। চলনবিলের দর্শনীয় স্থানগুলো মূলত বর্ষাকালেই বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। এ সময়েই থৈ থৈ পানির কারণে সব জায়গায় যাওয়াটাও সহজ। কিন্তু যথাযথ প্রচারণা না থাকায় দেশের অন্যান্য এলাকার মানুষের কাছে পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনাময় চলনবিল আজও সেভাবে সমাদৃত হয়ে উঠতে পারেনি। তবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ, যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা আর প্রচারণার সুযোগ পেলে কিংবদন্তির এ চলনবিল দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।
গুরুদাসপুরের বিলসা, তাড়াশের কুন্দইল ও চলনবিলের বুক চিরে বয়ে চলা বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের তাড়াশ এলাকার অন্তর্গত ৯ ও ১০নং ব্রিজ এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও বর্ষায় অসাধারণ হয়ে উঠে। বর্ষায় এসব এলাকায় রাস্তার উভয় পাশেই দেখা মেলে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির। এর পাশেই বিশাল জলরাশির মাঝে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন পার্ক।
বেহুলা-লখিন্দরের উপকথা কারই বা অজানা, সেই বেহুলার স্মৃতিবিজড়িত বেহুলার ক‚প (কুয়া) আজও আছে তাড়াশ উপজেলার বিনসাড়া গ্রামে। সঙ্গেই আছে তার নামে প্রতিষ্ঠিত বেহুলা-লখিন্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বেহুলার যাতায়াতে ব্যবহৃত বেহুলার খাড়ি নামের নৌপথ এখনো আছে। খাড়ির পাশে নৌকাসদৃশ ঢিবি আছে। এ ঢিবির নিচে বেহুলার নৌকা রয়েছে বলে বিশ্বাস করেন স্থানীয়রা। চলনবিলে রয়েছে আনোয়ারা উপন্যাসের লেখক নজিবর রহমানের মাজার, রায় বাহাদুরের বাড়ির ধ্বংসস্তূপ, দেশের বৃহত্তম গোবিন্দ মন্দির, কপিলেশ্বর মন্দির, বারুহাসের ইমাম বাড়ি, শীতলাইয়ের জমিদার বাড়ি, হান্ডিয়ালের জগন্নাথ মন্দির ও রায়গঞ্জের জয়সাগর মৎস্য খামার।
চাটমোহরের হরিপুরে লেখক প্রমথ চৌধুরী ও বড়াইগ্রামের জোয়াড়ীতে লেখক প্রমথ নাথ বিশীর বাড়িসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান বুকে ধারণ করে আছে চলনবিল। বিলপাড়ের তাড়াশের নবগ্রামে নওগাঁ শাহি মসজিদ (মামার মসজিদ) ও ভাগ্নের মসজিদ নামে দুটি মসজিদ রয়েছে। পাশেই হজরত শাহ শরিফ জিন্দানির (র.) মাজার।
জনশ্রুতি আছে, তিনি ষোড়শ খ্রিস্টাব্দে বাঘের পিঠে চড়ে বাগদাদ থেকে এ দেশে এসেছিলেন ইসলাম প্রচারের জন্য। চাটমোহরের হান্ডিয়ালে শেঠের বাঙ্গালা ও শেঠের কুঠি মীরজাফরের সহচর জগৎশেঠের বিশ্রামাগার ছিল বলে লোকে এগুলোকে আজও ঘৃণার চোখে দেখে। হান্ডিয়ালে রয়েছে বুড়াপীরের দরগা। চাটমোহরের সমাজ গ্রামে শেরশাহর ছেলে বাংলার সুবেদার সলিমের নির্মিত সমাজ মসজিদ রয়েছে।
আবু জাফর সিদ্দিকী
কলামিস্ট ও গণমাধ্যম কর্মী, নাটোর।