নিউজ ডেস্ক:
ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্র জানায়, বর্তমানে ডিএনসিসিতে দিনে দুই হাজার ৮০০ থেকে তিন হাজার টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। এর মধ্যে কিছু বর্জ্য নগরে যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়ে থাকে। তাই তুরস্ক সফর শেষে পরীক্ষামূলকভাবে মাটির নিচে ওয়েস্টবিন স্থাপন করতে নির্দেশনা দিয়েছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। এসব ওয়েস্টবিনে সহজেই বর্জ্য ফেলা যায়। ময়লা ফেলার পর ঢাকনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এতে বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়ায় না। তাই পরীক্ষামূলকভাবে এর সম্ভাব্যতা যাচাই করতে পূর্বাচলে ৩০০ ফুট সড়ক, মিরপুরে ৬০ ফুট সড়ক, আগারগাঁওয়ের শহীদ মাহবুব সরণি এবং হাতিরঝিলের শুটিং ক্লাব এলাকায় ওয়েস্টবিন স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ কাজ বাস্তবায়নে প্রস্তুতি শুরু করেছে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ)।
জানতে চাইলে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, তুরস্ক সফরে দেখেছি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারা সিটি করপোরেশন সফল। তাদের শহরে সব ওয়েস্টবিন আন্ডারগ্রাউন্ডে স্থাপন করা হয়েছে। ফলে রাস্তাঘাটে বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ে থাকে না। এসব বিষয় নিয়ে আঙ্কারা সিটি করপোরেশন মেয়রের সঙ্গেও কথা বলেছি। তারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সফলতার বিষয়গুলো আমাকে জানিয়েছেন। আমরা দুই সিটি করপোরেশন (ঢাকা উত্তর সিটি ও আঙ্কারা সিটি করপোরেশন) সিস্টার কনসার্ন হিসেবে কাজ করবো।
তিনি বলেন, ঢাকা শহরে বর্জ্যের কারণে অনেক স্থানে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। অনেক এলাকায় জায়গা সংকটের কারণে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) স্থাপন করা যাচ্ছে না। এমন অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে আমরাও তুরস্কের আদলে এই উদ্যোগ নিয়েছি। এ ছাড়া নতুন আবাসন কোম্পানিগুলোকে তাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মাটির নিচে স্থাপনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ইস্তাম্বুলের মেহমেট আকিফ এরসয় পার্কের ১০০ মিটার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে সুলতান আহমেদ মসজিদ। এই মসজিদ সংলগ্ন একটি বাগানের সামনেও মাটির নিচে পাশাপাশি দুটি ওয়েস্টবিন স্থাপন করা হয়েছে। এর একটিতে কঠিন বর্জ্য, অন্যটিতে গৃহস্থালির বর্জ্য ফেলা হয়। চার কোণের প্রতিটি ওয়েস্টবিন ৬ ফুট চওড়া। লম্বা বা গভীরতা প্রায় ১০ ফুট।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ওয়েস্টবিন দুটির মুখে পা দিয়ে চাপ দিতেই ঢাকনা খুলে যায়। সেখানে বর্জ্য ফেলছেন লোকজন। পাশে বসেই গল্প করছেন পর্যটকরা। বাতাসে দুর্গন্ধ নেই। একইভাবে আয়া সোফিয়া জাদুঘর ও মসজিদ, নীল মসজিদ, গ্র্যান্ড মসজিদ, তাকসিম স্কয়ারে এমন অনেক ওয়েস্টবিন দেখা গেছে।
আয়া সোফিয়া (Hagia Sophia) জাদুঘর ও মসজিদের সামনে ওয়েস্টবিন থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করছিলেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী সালহান। তার গায়ে পরিপাটি পোশাক। পায়ে কালো রঙের জুতা। হাতে ঘড়ি, চোখে চশমা। বর্জ্য সংগ্রহ করার সময় তার হাতে সেগুলো স্পর্শ করা লাগেনি। পুরো কাজটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে করেছেন তিনি।
এক দোভাষীর সাহায্যে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন সালহান। তিনি জানান, এটা নতুন কিছু নয়। কয়েক যুগ আগে থেকেই তারা আধুনিক পদ্ধতিতে বর্জ্য সংগ্রহ করেন। এটা অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব। বর্জ্য ভরে গেলে ক্রেনযুক্ত বিশেষ গাড়ির মাধ্যমে তা নিয়ে যাওয়া হয় ল্যান্ডফিল্ডে।
ইস্তাম্বুলের বিভিন্ন হোটেল ও অফিস থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করার জন্য পৃথক পরিচ্ছন্নতাকর্মী রয়েছেন। তারা বিশেষ ট্রলির মাধ্যমে বর্জ্য সংগ্রহ করেন। কয়েকজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে কানে হেডফোন, হাতে স্মার্টফোন নিয়ে ঘুরতে দেখা গেছে। প্রথম দেখায় মনে হবে তারা কোনো অফিসের কর্মকর্তা পদে চাকরি করেন।
ইস্তাম্বুল থেকে রাজধানী আঙ্কারার দূরত্ব ৪৪৩ দশমিক ৯ কিলোমিটার। সরেজমিনে দেখা যায়, তারাও একই পদ্ধতিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করছে। এখানকার অধিকাংশ ওয়েস্টবিন মাটির নিচে। যেগুলো ওপরে রয়েছে সেগুলোও পরিবেশবান্ধব। ওই এলাকার লোকজনও যত্রতত্র বর্জ্য ফেলেন না। তারপরও শহরে সবসময় কয়েক পালা করে নিয়োজিত থাকেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। কোথাও কোনো বর্জ্য পড়লেই সঙ্গে সঙ্গে তা বিশেষ ক্যারিয়ারের মাধ্যমে সংগ্রহ করছেন তারা।
গত ১৩ ডিসেম্বর আঙ্কারায় বঙ্গবন্ধু বুলভার্ডে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন করে আঙ্কারা সিটি করপোরেশন। ওই অনুষ্ঠানে আঙ্কারা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনসুর ইয়াভাস, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে আঙ্কারা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনসুর ইয়াভাস বলেছিলেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও আঙ্কারা সিটি করপোরেশনের মধ্যে কিছু সমঝোতা হয়েছে। ঢাকার মেয়র আমার সঙ্গে এখানকার নগর উন্নয়নের বহু বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন, পরামর্শ নিয়েছেন। এর মধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অন্যতম। এখন আমরা দুই সিটি সিস্টার কনসার্ন হিসেবে কাজ শুরু করেছি। প্রায়ই কাজের অগ্রগতি নিয়ে আমাদের কথা হয়।
তুরস্কের আদলে ঢাকায় মাটির নিচে ওয়েস্টবিন স্থাপনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন নগর ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রকল্পটি সঙ্গে নাগরিকদের সম্পৃক্ততা করা জরুরি। বিশেষ করে নাগরিক সচেতনতা। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় নগর পরিকল্পনা বিভাগের অ্যালামনাই ও নগর পরিকল্পনাবিদ আয়েশা সাঈদ জাগো নিউজকে বলেন, আধুনিক পদ্ধতিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় তুরস্ক অনেক এগিয়ে। এই পদ্ধতিকে মডেল হিসেবে নিয়ে কাজ করতে পারে ডিএনসিসি। তারা সফল হলে দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশনে একই পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, ঢাকা যত্রতত্র ময়লা ফেলা পরিবেশ দূষণের বড় একটি কারণ। এটি বন্ধে সিটি করপোরেশনকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। সমাজে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। সার্বক্ষণিক শহরে পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োজিত রাখতে হবে। যাতে কোথাও বর্জ্য পড়লে সেটা সঙ্গে সঙ্গে মাটির নিচে ওয়েস্টবিনে চলে যায়।
জানতে চাইলে পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং তুরস্কের ইস্তাম্বুল সাবাহাতিন জাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মাজহার ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, নিঃসন্দেহে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এই উদ্যোগকে আমরা একটি ভালো উদ্যোগ বলতে পারি। এটি প্রশংসার দাবি রাখে। তবে তুরস্কে ওয়েস্টবিন মাটির নিচের পাশাপাশি মাটির ওপরেও রয়েছে। মাটির ওপরে হোক আর নিচে হোক, প্রথমত নাগরিকদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। পাশাপাশি সব প্রকল্পে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। মানুষের অভ্যাসের পরিবর্তন করা না গেলে সফলতা আসবে না।