নিউজ ডেস্ক:
রেলকে দেশের জনসাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে এবং দেশের প্রতিটি জেলাকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে ২০১৩ সালের ৩০ জুন ২০ বছর মেয়াদি একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়, যা ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি হালনাগাদ করা হয়। এ মহাপরিকল্পনার আওতায় ৫ বছর মেয়াদি ৪টি পর্যায়ে প্রায় ২৩০টি প্রকল্প ২০৩০ সাল নাগাদ বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। এতে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এ সময়ের মধ্যে দেশের প্রতিটি জেলাকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে জানিয়েছে রেল মন্ত্রণালয়। যুগান্তকারী এই পদক্ষেপ কার্যকর হলে সারাদেশেই ট্রেনে যাতায়াত করা সম্ভব হবে। রেল নেটওয়ার্ক জুড়বে ট্রান্স এশিয়ার রুটে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
মহাপরিকল্পনার আওতায় বর্তমান সরকারের আমল অর্থাৎ ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬৪টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এই ৬৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ১৪ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়। উন্নয়ন প্রকল্পের পাশাপাশি ৭৬টি নতুন প্রকল্প ও ৬৫টি সংশোধিত প্রকল্পও অনুমোদন করা হয়েছে। ২০১৮ থেকে এ পর্যন্ত এডিপি প্রকল্পের আওতায় ৪৩টি প্রকল্প চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ এখন শেষের পথে।
মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, রেলওয়েতে আরো ৬০০টি ইঞ্জিন, ৬ হাজার যাত্রীবাহী কোচ ও ৭ হাজার মালবাহী ওয়াগান কেনার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া দূরত্ব অনুযায়ী, ইলেকট্রিক ট্রেন ও বুলেট ট্রেনসহ দ্রুতগামী ট্রেন চালু করা হবে। ইতোমধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বুলেট ট্রেনের সম্ভাবতা যাচাইয়ের কাজ চলছে।
সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান সরকারের আমলে ৫০০ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে। ২৮৭ দশমিক ১০
কিলোমিটার মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজ লাইনে রূপান্তরিত করা হয়েছে। ১ হাজার ২৭১ দশমিক ৮১১ কিলোমিটার রেললাইন পুনর্বাসন ও পুননির্মাণ করা হয়েছে। ১০৪টি নতুন রেলস্টেশন ভবন নির্মাণ এবং ১৯২টি স্টেশন বিল্ডিং পুনর্বাসন, ৫৭টি প্ল্যাটফর্ম উঁচু করা, ৪৮৪টি নতুন রেল সেতু নির্মাণ, ৬৪৪টি সেতু পুনঃনির্মাণ ও পুনর্বাসন, ৭৪টি ইঞ্জিন সংগ্রহ, ৫২০টি যাত্রীবাহী বগি সংগ্রহ, ৪৬০টি বগি পুনর্বাসন, ৫১৬টি মালবাহী ওয়াগান সংগ্রহ, ২৭৭টি মালবাহী ওয়াগান পুনর্বাসন, ৩০টি ব্রেকভ্যান কেনা, ১২৩টি স্টেশনের সিগনাল ব্যবস্থা উন্নয়ন, ৯টি স্টেশনে সিগনাল পুনর্বাসন, ১৪৪টি নতুন ট্রেন চালু, চলমান ৪৪টি ট্রেন সার্ভিস বর্ধিতকরণ, ৬টি দুর্ঘটনা রিলিফ ট্রেন কেনা, ৪টি বন্ধ স্টেশন চালু, ই-টিকেটিং ও মোবাইল টিকেটিং সেবা চালু করা হয়েছে।
মহাপরিকল্পনার আওতায় পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা এবং যশোর পর্যন্ত ৩৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১৭২ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। ১৮ হাজার ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ, যার ফলে ঢাকা থেকে পর্যটকরা সরাসরি সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ভ্রমণে যেতে পারবেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ প্রকল্প, তারাকান্দী-বঙ্গবন্ধু সেতু (পূর্ব) ৩৫ কিলোমিটার ও পাবনা-মাঝগ্রাম ২৫ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম পর্যন্ত ডুয়েলগেজ প্রকল্পের আওতায় ১২৯ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণকাজ চলছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ৬৫টি রেলওয়ে স্টেশন থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে টিকেট কাটা এবং ফিরতি টিকেট নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা এবং কুমিল্লার লাকসাম হয়ে চট্টগ্রামে রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের ব্যয় ৩১ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে।
মহাপরিকল্পনার মধ্যে আরো রয়েছে- প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইন নির্মাণ, ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে যমুনা নদীর ওপর বাহাদুরাবাদ-ফুলছড়ি রুটে আরেকটি রেল সেতু নির্মাণ, ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে রেল সেতু নির্মাণ, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বৈদ্যুতিক রেলপথ চালু, খুলনা-পার্বতীপুরে ৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ, আখাউড়া-সিলেটের মধ্যে ৭ হাজার কোটি টাকায় ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প।
এছাড়া রাজধানীর চারপাশে এলিভেটেড সার্কুলার রেলপথ নির্মাণের জন্য গত ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল রেল ভবনে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা কার্যক্রমের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে কনসালটেন্সি ফার্মের সঙ্গে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে যৌথভাবে কাজ করছে চায়না রেলওয়ে সিয়্যুয়ান সার্ভে এন্ড ডিজাইন গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড এবং বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান বেটস কনসাল্টিং সার্ভিসেস লিমিটেড এবং ইঞ্জিনিয়ার্স এন্ড এডভাইজার্স লিমিটেড। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা কার্যক্রম সরকারি অর্থায়নে হচ্ছে। চুক্তি মূল্য ২৪ কোটি ৫৬ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ টাকা। এছাড়া জয়দেবপুর থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত ডাবল লাইন রেলপথ, বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ, সান্তাহার-বগুড়া-কাউনিয়া রেলপথকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প। মোংলা বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে কন্টেইনারবাহী ওয়াগন বাড়াতে খুলনা-মংলা রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। ভারতীয় এলওসি অর্থায়নে ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা-মোংলা নতুন রেললাইন নির্মাণের কাজ প্রায় শেষের পথে। সারাদেশে ডুয়েলগেজ রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে পশ্চিমাঞ্চলের সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ এবং পদ্মা নদীর উপর আরো একটি রেল সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে এই মাস্টারপ্ল্যানে। এছাড়া দেশের রেলওয়েকে দুটি থেকে চারটি জোনে বিকেন্দ্রীকরণ, সিগনালিং ব্যবস্থা আধুনিকীকায়ন, উন্নত স্টেশন ও বিশ্বমানের সেবা নিশ্চিত করা। এছাড়া রাজধানী যানজটমুক্ত করতে ঢাকার কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে দুটি অত্যাধুনিক ট্রানজিট হাব নির্মাণ প্রকল্পের সমীক্ষার কাজ চলছে।
এ প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর জোর দেন। তার আগে বিএনপি-জামায়াত সরকার রেলকে ধ্বংস করার চক্রান্ত করে। বর্তমান সরকারের আমলে প্রতি অর্থবছরে রেল যোগাযোগের উন্নয়নে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছেন। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৪টি ধাপে এই উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। পরে এ পরিকল্পনার সঙ্গে আরো বেশ কিছু প্রকল্পজুড়ে এটির মেয়াদ বাড়িয়ে ২০৪৫ সাল করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন হলে সারাদেশে ট্রেনে যাত্রীসেবা যেমন বাড়বে, তেমনি পণ্য পরিবহনেও সুযোগ পাবেন ব্যবসায়ীরা। এতে দেশের প্রায় সব জেলা রেল নেটওয়ার্কের আওতায় চলে আসবে।
তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে ৬টি রুট দিয়ে ভারতের সঙ্গে রেল সংযোগ স্থাপন করেছি। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইনটি শেষ হলে এটি ট্রান্স এশিয়ান রুটে রেলজুড়ে যাবে। আমরা রেলের উন্নয়নে ইঞ্জিন, কোচ আনার চুক্তি করেছি। এসব এলে রেল হবে বিশ্বমানের। বাংলাদেশের রেল যুক্ত হবে ট্রান্স এশিয়ার রেল রুটে।
সূত্রমতে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রেল উন্নয়নে প্রথম ধাপের ৫ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যানে ২০১১-২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রকল্প উন্নয়নে ১০৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, দুয়েকটি চলমান। সরকারি অর্থায়নে ৩১টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজও প্রায় শেষের পথে। এছাড়া বৈদেশিক অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে ৩৪টি প্রকল্প। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় প্রায় ১ লাখ ২৭ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। দ্বিতীয় ধাপে ৪৮টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। সরকারি অর্থায়নে এর মধ্যে ২৫টি প্রকল্প, প্রায় ৯ হাজার ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ও বৈদেশিক অর্থায়নে ২৩টি প্রকল্প ১৯ হাজার ১১৩ কোটি টাকায় বাস্তবায়িত হবে। এই ৪৮টি প্রকল্পের মোট ব্যয় হবে প্রায় ২৮ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা।
তৃতীয় ধাপের মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, ২০২১-২০২৫ সালে ৩৭টি প্রকল্প ৪৩ হাজার ৯৭০ কোটি টাকায় বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চতুর্থ ধাপে মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, ২০২৬-২০৩০ সালের মধ্যে ৫ বছরে আরো ৩৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ৩৩ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা ব্যয় হবে।
এছাড়া বুলেট ট্রেন ও ইলেকট্রিক ট্রেন চালুসহ উন্নত বিশ্বের ন্যায় রেল সেবার মান বাড়াতে কয়েকটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। কমলাপুর, বিমানবন্দর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের বেশ কয়েকটি রেলস্টেশনে বিদেশি আদলে মাল্টিমোডাল হাব তৈরির পরিকল্পনাও নিয়েছে রেলওয়ে। রেলের এ দীর্ঘমেয়াদি মাস্টারপ্ল্যানে সরকার ছাড়াও অর্থায়ন করছে মূলত বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক, চীন, ভারতীয় ঋণ, জাপান, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ।