নিউজ ডেস্ক:
স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের অর্থনীতি কতটা এগুলো? বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের প্রাক্কালে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যায়, অর্থনৈতিক অর্জন ঈর্ষণীয়। দেশ স্বাধীনের পর থেকে অগ্রগতির কথা বলতে গেলে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের সেই উক্তি- ‘বাংলাদেশ এক তলাবিহীন ঝুড়ি’ সামনে চলে আসে। তিনি যে বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন জুড়ি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন, ৫০ বছর পর সেই বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক সাফল্যে সমৃদ্ধ এক দেশ।
এ ক্ষেত্রে যে দেশটির কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল সেই পাকিস্তান এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতকে পেছনে ফেলে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। মাথাপিছু আয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচক, বিশ্বশান্তি সূচক, গড় আয়ু ও শিশু মৃত্যুর হারসহ এ রকম অর্থনৈতিক ও নানা সামাজিক সূচকে দেশ দুটির চেয়ে বাংলাদেশ এখন বেশ মজবুত অবস্থানে আছে। এমনকি চলমান মহামারি করোনা সহনশীলতা সূচকেও ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অনেক সূচকে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে যাওয়া স্বাধীনতার এই ৫০ বছরে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি ঘটনা সমীক্ষায় (কেস স্টাডি) পরিণত হয়েছে, যা খুব কম অর্থনীতিবিদই অনুমান করেছিলেন। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ যখন জিডিপির প্রবৃদ্ধি হারে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তখন অনেকেই এটিকে একটি আকস্মিক সাফল্য হিসেবে খারিজ করেছিলেন। কিন্তু তখন থেকে প্রতিবছরই পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। এখন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি এখন ভারতের কাছাকাছি এবং পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। দেশটির গড় আয়ু এখন ৭৪; ভারত (৭০) এবং পাকিস্তানের (৬৮) চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ বৈশ্বিকভাবে শীর্ষ তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের একটি এবং এ দেশের অন্য খাতগুলোও এগিয়ে যাচ্ছে।
উদাহরণ স্বরূপ বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প বেশ সম্ভাবনাময়। এ শিল্পের ৩০০ কোম্পানি (এর মধ্যে কয়েকটি গবেষণাও পরিচালনা করে) এখন ৯৭ শতাংশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাচ্ছে এবং বৈশ্বিকভাবে রফতানিও শুরু করছে।
২০২০-২০২১ অর্থবছরেও যখন মহামারির কারণে লকডাউনের ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে, তখনও বাংলাদেশ ৫.২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। ২০২১ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২৫৫৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় হলো- ১৫৪৩ ডলার। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি সমৃদ্ধ ছিল; আজ বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে ৪৫ শতাংশ বেশি সমৃদ্ধ। সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর রাইটস অ্যান্ড সিকিউরিটি (আইএফএফআরএএস) এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘বাংলাদেশ ও পাকিস্তান আগের এক দেশ, এখন দুস্তর ফারাক’ শিরোনামের ওই নিবন্ধে কীভাবে বাংলাদেশ একটি ‘অলৌকিক কাহিনি’ এবং পাকিস্তান একটি বিপর্যয়ের কাহিনি হলো তার বিবরণ তুলে ধরা হয়।
এতে বলা হয়েছে, সামষ্টিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৫০ বছরে ২৭১ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের সফল যাত্রা একটি ভালো উদাহরণ এবং মাত্র দুই দশকে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সূচকে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। গত ২০ বছরে, বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৫০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা পাকিস্তানের তুলনায় আড়াই গুণ। বাংলাদেশে হাজার হাজার পোশাক কারখানা রয়েছে, অথচ এটি এমন একটি দেশ যেখানে তুলা জন্মে না। কিন্তু কয়েকশ মিলিয়ন ডলার মূল্যের তুলা আমদানি করে বাংলাদেশি কারখানাগুলো ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক আকারে রফতানি করছে।
অন্যদিকে পাকিস্তান তুলা উৎপাদনকারী দেশ হওয়া সত্ত্বেও পোশাক ও বস্ত্র পণ্যের রফতানি ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি আরও মন্দ দিক হলো পাকিস্তান এখন তুলাও আমদানি করছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পূর্বাভাস দিয়েছে মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারতকে পেছনে ফেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী, বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১৩৮ দশমিক ৭৯ ডলার। আর একই সময়ে ভারতের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১১৬ দশমিক ৪৪ ডলার। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান পিছিয়ে আছে অনেক খানি। ২০২১ সালে পাকিস্তানের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৫৪৩ ডলার। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ৪৫.১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা পাকিস্তানের ১৭.১ বিলিয়ন ডলারের দ্বিগুণেরও বহু বেশি।
এর আগেও কখনও বিশ্বব্যাংক, কখনও ইন্টারন্যাশনাল মনিটরিং ফান্ড (আইএমএফ), এডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা কখনও অর্থনৈতিক সূচক, কখনও সামাজিক বিভিন্ন সূচক প্রকাশ করে। এগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসবের অনেক সূচকেও ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ পাকিস্তানের দ্বিগুণ এবং তাদের মুদ্রা টাকার ক্ষেত্রেও এর মূল্য পাকিস্তানের রুপির চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার পাকিস্তানের ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে জিডিপির আকারের ভিত্তিতে বৃহৎ অর্থনীতির দেশের তালিকায় ৪১তম অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ।
পাকিস্তানের অবস্থান ৪৪তম। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পাকিস্তানের ২০ বিলিয়ন ডলারের বিপরীতে ৪৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের রফতানি আয় ৪৩ বিলিয়ন ডলারের, পাকিস্তানের সেখানে ২৩ বিলিয়ন ডলার। পাসপোর্ট সূচক, সাক্ষরতার হার, ক্ষুদ্রঋণ ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। তবে পাকিস্তানের ২২ কোটির তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪০ লাখ। অথচ ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৬ কোটি।
বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর আর পাকিস্তানে ৬৭ বছর। পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশু মৃত্যুর হার বাংলাদেশে হাজারে ২৫ জন, পাকিস্তানে প্রতি হাজারে মারা যায় ৫৯ জন। বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাপর্ব শেষ করছে ৯৮ শতাংশ শিশু, পাকিস্তানে ৭২ শতাংশ।
এবার ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকের চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, মহামারি করোনার কারণে বিশ্বের সব দেশেরই জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমেছে। করোনার আগের স্বাভাবিক সময়ের প্রবৃদ্ধি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ সময় ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি যেখানে শতকরা ৫ শতাংশ, বাংলাদেশের সেখানে ৮ শতাংশ। বাংলাদেশের পুরুষ ও নারীদের গড় আয়ু যথাক্রমে ৭১ ও ৭৪ বছর; ভারতে তা যথাক্রমে ৬৭ ও ৭০ বছর। বাংলাদেশে ৩০ শতাংশের বেশি নারী শ্রমে যোগ দিচ্ছেন; ভারতে এ হার মাত্র ২৩ শতাংশ। এক যুগে তা ৮ শতাংশ কমেছে। শিক্ষার হারের ক্ষেত্রে শীর্ষে আছে ভারত। সেখানে শিক্ষার হার ৭৪.৪ শতাংশ। সামান্য পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের শিক্ষার হার ৭৩.৯ শতাংশ। সবার শেষে থাকা পাকিস্তানের শিক্ষার হার ৫৯.১৩ শতাংশ।
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচকে ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ওয়াশিংটনভিত্তিক কনজারভেটিভ থিংক ট্যাংক দ্য হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে ৫৬.৫ স্কোর করে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম। বাংলাদেশের সমান স্কোর নিয়ে ১২১তম অবস্থানে আছে ভারত। পাকিস্তানের অবস্থান ১৫২তম।
বৈশ্বিক শান্তি সূচকে ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস (আইইপি) প্রকাশিত সর্বশেষ বৈশ্বিক শান্তি সূচকে (জিপিআই) ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এখন তৃতীয়। তালিকা অনুযায়ী গত বছরের চেয়ে সাত ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৯১ নম্বরে। স্কোর ২ দশমিক ০৬৮। গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তালিকার ৯৭তম। বাংলাদেশের পরে রয়েছে যথাক্রমে শ্রীলঙ্কা (৯৫), ভারত (১৩৫) ও পাকিস্তান (১৫০)। আফগানিস্তান সূচকের একেবারে তলানিতে অবস্থান করছে।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমেদ সময়ের আলোকে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতির যাত্রা শুরু হয় ১৯৭২ সালে। সে সময়ে অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে ভারত ও পাকিস্তান এগিয়েছিল। আজ ৫০ বছর পর প্রায় প্রতিটি সূচকেই তারা বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে আছে। এটাই আমাদের স্বাধীনতার বড় অর্জন। যেকোনো দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ধরা হয় মানবসম্পদ, যাতে আমরা শুধু পাকিস্তান নয়, অনেক ক্ষেত্রে ভারত থেকেও এগিয়ে আছি। নারীশিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন, মা ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে।
ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে চিহ্নিত করেছে ‘বিস্ময়কর ধাঁধা’ হিসেবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জনগুলো নিয়ে আমরা আজ গর্ব করতে পারি।