নিউজ ডেস্ক:
নানা প্রতিকূলতার মাঝেও শিপ ব্রেকিং সেক্টরে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জাহাজ কাটার তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। চট্টগ্রামের শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে সাম্প্রতিক সময়ে জাহাজের আনাগোনাও বেড়েছে। অনেক শিপ ব্রেকিং ব্যবসায়ী ঋণ খেলাপী এবং দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও এই সেক্টরের উন্নতিতে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন অনেকেই। দেশে স্টিলের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়া শিপ ব্রেকিং শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, দেশের লোহা খাত পুরোপুরি আমদানি নির্ভর। বিশ্বের নানা দেশ থেকে নানা ফর্মে লোহা আমদানি করা হয়। পুরনো জাহাজের পাশাপাশি প্রচুর স্ক্র্যাপও আমদানি করা হয়। পুরনো জাহাজ কেটে সীতাকুণ্ডের শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো থেকে বছরে ১৮ লাখ টনের মতো লোহা পাওয়া যায়। বাকি লোহার প্রয়োজন মেটাতে বিদেশ থেকে স্ক্র্যাপ আমদানি করতে হয়। আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের নানা দেশ থেকে বছরে ৪২ লাখ টনের মতো স্ক্র্যাপ আমদানি করা হয়। এই বিপুল পরিমাণ স্ক্র্যাপ আমদানি এবং প্রক্রিয়াজাত করে রড উৎপাদন করে দেশের প্রায় ৬০ লাখ টন লোহার চাহিদা মেটানো হয়। বর্তমানে দেশে মাথাপিছু লোহার ব্যবহার প্রায় ৩৮ কেজি। বছর কয়েক আগেও দেশে ব্যবহৃত মোট লোহার সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ সরকারিভাবে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু পদ্মা সেতু, কর্ণফুলীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল এবং ঢাকার মেট্রো রেলের মতো ১১টি মেগা প্রকল্পসহ শত শত প্রকল্পে সরকার দেশের উৎপাদিত রডের প্রায় ৬০ শতাংশ ব্যবহার করছে।
সূত্র বলেছে, দেশে বর্তমানে ২০০টির মতো স্টিল মিল রয়েছে। এরমধ্যে ৩৬টি মিল রয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে রড উৎপাদন করে। প্রায় ৯০ লাখ টন রডের উৎপাদনক্ষমতা সম্পন্ন এই ৩৬টি কারখানা বর্তমানে ৬০ লাখ টনের মতো রড উৎপাদন এবং বাজারজাত করে। এসব কারখানার স্টিলের একটি বড় অংশ স্ক্র্যাপ হিসেবে আমদানি করা হলেও শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকেও প্রচুর স্ক্র্যাপ সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।
কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে শিপ ব্রেকিং সেক্টরে নানা ধরনের সংকট বিরাজ করছে। ইতোমধ্যে বহু ব্যবসায়ী ঋণ খেলাপী হয়েছেন। অনেকেই পালিয়ে গেছেন দেশ থেকে। বহু ইয়ার্ড বন্ধ হয়ে গেছে। যেসব ইয়ার্ড চালু রয়েছে সেগুলোতেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্ক্র্যাপ জাহাজ পাওয়া যায়নি। বিশ্বব্যাপী জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় স্ক্র্যাপ উপযোগী জাহাজগুলোও চালানো হচ্ছে। স্ক্র্যাপ না করে জোড়াতালি দিয়ে চলছে বহু জাহাজ। ফলে স্ক্র্যাপ জাহাজের একটি সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বে প্রতি বছর অন্তত ৭শ’র মতো জাহাজ স্ক্র্যাপ হয়। একটি জাহাজ সাগরে ভাসানোর পর গড়ে ত্রিশ বছর চলার পর স্ক্র্যাপ করা হয়।
শিপ ব্রেকিং সেক্টরে এক সময় তাইওয়ানের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। আশির দশকে বাংলাদেশে যখন শিপ ব্রেকিং শিল্প শুরু হয় তখন তাইওয়ান ছিল এই খাতে পৃথিবীর এক নম্বর দেশ। পরবর্তী দশকে চীন এবং কোরিয়ার উত্থান ঘটে। পরবর্তীতে চীন ক্রমান্বয়ে শিপ ব্রেকিং সেক্টর বন্ধ করতে শুরু করে। ভারত চলে আসে পৃথিবীর এক নম্বর স্থানে। বর্তমানে বাংলাদেশ এই সেক্টরে এক নম্বর স্থান দখল করছে বলেও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান।
সাম্প্রতিক এক হিসেবের উদ্বৃতি দিয়ে শিপ ব্রেকিং এসোসিয়েশনের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, গত তিন মাসে পুরো পৃথিবীতে সর্বমোট ১২০টি জাহাজ স্ক্র্যাপ করা হয়েছে। এরমধ্যে চট্টগ্রামেই এসেছে ৪১টি। আগের বছর একই সময়ে বিশ্বব্যাপি জাহাজ স্ক্র্যাপ হয়েছিল ১৭০টি। ওই সময় বাংলাদেশে জাহাজ এসেছিল মাত্র ২৪টি। এক বছরের ব্যবধানে বিশ্বব্যাপী স্ক্র্যাপ জাহাজের সংখ্যা ৫০টি কমে গেলেও বাংলাদেশে ১৭টি জাহাজ বেশি এসেছে।
সূত্র বলেছে, ২০২০ সালে বিশ্বে মোট ৬৩০টি জাহাজ স্ক্র্যাপ করা হয়। এরমধ্যে ভারতে ২০৩টি, বাংলাদেশে ১৪৪টি, পাকিস্তানে ৯৯টি, তুরস্কে ৯৪টি, চীনে ২০টি ও ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে ৬০টি জাহাজ স্ক্র্যাপ করা হয়। ২০১৯ সালে জাহাজ স্ক্র্যাপ করা হয়েছিল ৬৭৬টি। ওই বছর বাংলাদেশে স্ক্র্যাপ করা হয় ২৩৬টি। ভারতে করা হয়েছিল ২০০টি, তুরস্কে ১০৭টি, পাকিস্তানে ৩৫টি, চীনে ২৯টি ও ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে ৬৯টি জাহাজ কাটা হয়। শিপ ব্রেকিং সেক্টরে জাহাজ আমদানি এবং স্ক্র্যাপ করার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্টরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
একাধিক শিপ ব্রেকিং ব্যবসায়ী গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, অনেক প্রয়োজনীয় এবং সম্ভাবনাময় খাতটি থেকে বাংলাদেশ ছিটকে পড়ার আশংকা তৈরি হয়েছিল। পারিপার্শ্বিক কিছু সুযোগ সুবিধাসহ ব্যবসায়ীদের একাগ্রতায় খাতটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। এতে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান ছাড়াও স্টিল সেক্টরে বহুমুখী সুফল মিলছে বলেও তারা মন্তব্য করেন।