নিউজ ডেস্ক:
ছয় দশক পর এভাবে সব কিছু পাল্টে যাবে তা এলাকার মানুষ ভাবেনি। যেসব জায়গায় সাধারণ মানুষের চলাচল ছিল একেবারেই কম, সেসব এলাকাই এখন বিদেশি নাগরিকদের চলাফেরায় মুখর।
জঙ্গলে ভরা পরিবেশে বিষাক্ত সাপ আর পোকামাকড়ে ভরে গিয়েছিল এমন এক জায়গায়তেই এখন নির্মিত হয়েছে আবাসিক এলাকা। সেখানে দেখা মিলছে সুউচ্চ ২০ তলাবিশিষ্ট ২১টি ভবনের শোভা। আর সেগুলোতে বসবাস করছেন রুশ, বেলারুশ ও ইউক্রেনের প্রায় চার হাজার নারী-পুরুষ।
এটি আর কিছু নয় নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসবাসের জন্য নির্মিত আবাসিক এলাকা ‘গ্রিন সিটি’। এই ‘গ্রিন সিটি’ ঘিরে বিদেশিদের কেনাকাটার জন্য গড়ে উঠেছে অনেক আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শপিংমল, সেলুন, সবজি বাজারসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় অনেক দোকানপাট। আর যাতে তারা সহজেই বুঝতে পারে, সে জন্য সেসব দোকানের সাইনবোর্ডেও দেখা মিলছে রাশিয়ান ভাষা।
ঈশ্বরদী উপজেলার সাহাপুর ইউনিয়নের দিয়াড় সাহাপুর ও অপরদিকে চরসাহাপুর গ্রাম। সেখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রাশিয়ান নারী-পুরুষের পদচারণায় মনে হয় যেন রাশিয়ার কোনো একটি ছোট শহর এটি।
অতীতে এসব এলাকা ভুতুড়ে গ্রাম মনে হতো। দিনের আলোতে নাকি মানুষ চলাচল করতেও ভয় পেত। এলাকার কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি মিলে উদ্যোগ নেন— সপ্তাহে দুদিন এখানে একটি হাট বসবে। তাৎক্ষণিক হাটের নাম দেওয়া হয় ‘নতুনহাট’। সেই থেকে এ এলাকার নাম হয়ে যায় ‘নতুনহাট’। এখন এই নতুনহাটেই বসছে উন্নতমানের জিনিসপত্রের পসরা। গড়ে উঠেছে এসি লাগানো দোকানপাট। সেগুলোতে রাশিয়ানরা কিনছেন জিনিসপত্র।
এলাকাটি দিয়েই চলে গেছে ঈশ্বরদী-কুষ্টিয়া সড়ক, যা সংক্ষেপে আইকে (ঈশ্বরদী-কুষ্টিয়া) রোড নামে পরিচিত। সড়কটি এখন বেশি ব্যবহৃত হয় রূপুপর প্রকল্পের গাড়ি চলাচলে। যেখানে একসময় ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকত, সন্ধ্যা নামলে মানুষ চলাচল থেমে যেত; সেখানে এখন দেখা মেলে গভীর রাতেও ঝলমলে আলোর বিচ্ছুরণ। চারদিকে আলোকিত করে রেখেছে ‘গ্রিন সিটি’। গত তিন বছরে এখানে গড়ে উঠছে এই গ্রীণসিটি।
বিদেশি নাগরিকদের বসবাস করার জন্যই গড়ে তোলা বহুতলভবণ ‘গ্রিন সিটি’ নির্মিত হওয়ার কারণে বেসরকারি ব্যাংকের শাখা, বিদেশিদের বিনোদনের জন্য আধুনিক দৃষ্টিনন্দন পার্ক গড়ে উঠেছে।
ঈশ্বরদী উপজেলার সাহাপুর ইউনিয়নে ছোট এই গ্রামের ভেতরে গ্রিন সিটির মূল ফটকজুড়ে আধুনিকতার ছোঁয়া। দৃষ্টিনন্দন দোকানপাটের সমারোহ। বিদেশি নাগরিকরা ইচ্ছেমতো বেশ আন্তরিকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করেন, কোনো অসুবিধা হয় না। প্রথম দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকাতেন স্থানীয়রা, এখন আর তা নেই। বিদেশিদের চলাফেরার কারণে গ্রাম হয়েছে আধুনিক শহর। বদলে গেছে এলাকার আর্থ-সামাজিক চিত্র।
একদিকে আংশিক বাংলাভাষা আয়ত্ত করে নিয়েছেন কিছু বিদেশি। আবার দোকানিরাও তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রাশিয়ান ভাষা আয়ত্ত করে নিয়েছেন। দিয়াড় সাহাপুরের নতুনহাট এলাকা শুধু নয়, তাদের চলাফেরার জন্য উপজেলার সলিমপুর, পাকশী ইউনিয়নের অন্তত ১০ গ্রামে লেগেছে পরিবর্তনের আধুনিক ছোঁয়া। দেশের একটি ইউনিয়ন পর্যায়ের গ্রামে যেন দেখা মিলছে বিদেশি সংস্কৃতির ছোঁয়া।
দিয়াড় সাহাপুর গ্রামের বাসিন্দারা জানান, তারা কখনও ভাবেননি এভাবে এই এলাকার পরিবর্তন হবে। তারা এখন সুন্দরভাবে ব্যবসা করে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালো আছেন। তাদের আয়-রোজগার বেড়েছে।
দিয়াড় সাহাপুর গ্রামের আল-আমিন বলেন, তিনি সপ্তাহে দুদিন নতুনহাট মোড়ে চুল কাটার কাজ করতেন। প্রথমে ১০০-২০০ টাকা আয় হতো। পরে দিয়াড় সাহাপুর গ্রামে গ্রিন সিটি হওয়ায় তিনি দুই বছরের মধ্যে নিজে একটি এসি সংযুক্ত করে আধুনিক সেলুন দিয়েছেন। রাশিয়ান নাগরিকদের চুলকাটা ও সেভ করলে ৫০০ টাকা, আর শুধু চুল কাটলে ২০০ টাকা দেয়। এতে সারাদিন তার আয় প্রায় ৩-৪ হাজার টাকা হয়। তিনি কর্মচারীও রেখেছেন। তার কর্মচারীও প্রতিদিন আয় করে প্রায় হাজার টাকা।
শর্মা জিয়েস্টের মালিক শাকিল হোসেন বলেন, রাশিয়ানদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি আয়ত্ত করেছেন তাদের ভাষা। রাশিয়ানদের একটি প্রিয় খাবার শর্মা। শসা, টমেটো, পেঁয়াজ, পাতাকপি, গাজর, সস, চিজের সঙ্গে রুটি দিয়ে শর্মা তৈরি করতে হয়। শর্মা সাত রকমের বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়। সপ্তাহের দুদিন বিশ্বাস মার্কেটে বিদেশি নাগরিকদের মিলনমেলা ঘটে।
গ্রিন সিটিতে ২১টি সুদৃশ্য ভবনের মধ্যে বর্তমানে ১৬টি ভবনে বসবাস করছেন ইউরোপের তিন হাজার ৮০০ নাগরিক। অন্য ভবনগুলোর কাজ চলছে। গ্রিন সিটির সঙ্গে সঙ্গে এই এলাকাজুড়ে এখন অবকাঠামো উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে দৃশ্যমান উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। ভুতুড়ে গ্রাম বিদেশিদের শহরে রূপ নিয়ে গোটা সাহাপুর ইউনিয়নের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে।