নিউজ ডেস্ক:
পাটের সুদিন ফিরিয়ে আনতে বন্ধ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোকে বেসরকারী খাতে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে পাঁচটি পাটকল ইজারা দিতে পাঁচ বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে চ‚ড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি)। নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো: ইউনিটেক্স গ্রæপ, সাদ মুসা গ্রæপ, মিমু জুট মিল, বিদেশী বিনিয়োগপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বে গ্রæপ এবং যুক্তরাজ্যের জুট রিপাবলিক। ইজারা দেয়া পাটকলগুলো হলো: চট্টগ্রাম অঞ্চলের হাফিজ জুট মিলস ও কেএফডি জুট মিলস, ঢাকা অঞ্চলের বাংলাদেশ জুট মিলস এবং জাতীয় জুট মিলস এবং খুলনা অঞ্চলের ক্রিসেন্ট জুট মিলস। পাটকলগুলোর মধ্যে কেএফডি জুট মিলসের অন্তর্ভুক্ত কর্ণফুলী জুট মিলস, কর্ণফুলী কার্পেট কারখানা এবং ডাইভারসিফাইড ডেকোরেটিভ ফেব্রিক্স- এই তিনটি ইউনিট রয়েছে। ইজারার চুক্তি পাঁচ থেকে ২০ বছর মেয়াদী হবে। পরবর্তীতে চুক্তির সময়সীমা বাড়ানো যাবে। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কারখানার জমি, যন্ত্রপাতি এবং সুবিধাদি কেবলমাত্র পাট ও পাটজাত পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করতে পারবে। ইজারার শর্ত অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক ঋণের জন্য পাটকলের সম্পত্তি বন্ধক রাখতে পারবে না।
জানা গেছে, তৈরি পোশাক শিল্পখাত বিকাশের আগে আশির দশকে সোনালি আঁশ পাট ছিল অন্যতম প্রধান রফতানি পণ্য। সরকারী পাটকলগুলো নিজেদের দক্ষতা উন্নয়ন ও পণ্য বৈচিত্র্যায়ন করতে না পারায় দিনে দিনে ব্যবসা হারিয়ে রুগ্ন হয়ে পড়েছে। প্রতিবছর লোকসান গুনছে, অন্যদিকে সরকারী পাটকলের বিশাল সম্পদ অব্যহৃত থাকছে। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১৬ কোটি ১৪ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার। এ হিসাবে এই খাতে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ৩১ দশমিক ৬৩ শতাংশ, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। তবে চলতি অর্থবছরের গত চার মাসে পাট রফতানি আয় ও লক্ষ্যমাত্রা দুটোই কমেছে। এই সময়ে রফতানি আয় এসেছে ৩২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪৩ কোটি টাকা।
বিজেএমসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে পাটকলগুলোর লোকসান ৫৭৩.৫৮ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৭৬ কোটি টাকা বেশি। বিজেএমসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সক্ষমতা অনুসারে উৎপাদন না হওয়ায় লোকসান ৩৩৪.৪১ কোটি টাকা, যা মোট লোকসানের ৫৮.৩০ শতাংশ। অতিরিক্ত ৯১৭৭ জন অস্থায়ী শ্রমিকের জন্য ৪৫.১৪ কোটি টাকা এবং গেট মিটিং ও শ্রমিক আন্দোলনে ব্যয় ৬৫.৮৭ কোটি টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছরে লোকসান ছিল ২৭৫.২৩ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে ছিল ১৭.৫৩ কোটি টাকা। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে লোকসান হয় ৭২৯.০১ কোটি টাকা, যা বিগত দশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। পাটকলগুলোর চলতি দেনার পরিমাণ ২৩৮৭.৮৯ কোটি টাকা। খুলনা অঞ্চলের পাটকলগুলোর দেনার পরিমাণ ১০৭৯ কোটি টাকা, চট্টগ্রাম অঞ্চলের মিলে দেনা ২৭৯.৩৩ কোটি এবং ঢাকা অঞ্চলের কলগুলোর দেনা ৯১৫.৭২ কোটি টাকা। আর নন-জুট মিলের দেনা ১১ কোটি টাকা।
বিজেএমসির মতে, সরকারী পাটকলের মোট সম্পদের পরিমাণ ২৫,৩৫২. ৪৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে স্থায়ী সম্পদ ১৪ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা। স্থায়ী সম্পদ হচ্ছে- ভূমি, ভূমি উন্নয়ন, দালান কোঠা ও অন্যান্য, স্থাপনা ও যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র ও সরঞ্জামাদি, পরিবহন ও মোটরযান এবং অন্যান্য সম্পদ। ঢাকা অঞ্চলের মিলে রয়েছে সবচেয়ে বেশি স্থায়ী সম্পদ, এসব মিলে স্থায়ী সম্পদের মূল্য ৪৯৮৪.৪১ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম অঞ্চলের স্থায়ী সম্পদ ৪৪৩৫.২৯ কোটি টাকা আর খুলনা অঞ্চলে স্থায়ী সম্পদের মূল্য ৪৬৬৬.১৯ কোটি টাকা। আর নন-জুট মিলের স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ ২৪৪.০৭ কোটি টাকা। নাম না প্রকাশের শর্তে বিজেএমসির এক মহাব্যবস্থাপক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘পাটকলগুলোর স্থায়ী সম্পদ অনেক বেশি। বিশাল জায়গা থাকলেও অব্যবহৃত। বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় বন্ধ পাটকল চালু করা গেলে নতুন কর্মসংস্থান হবে। আবার যাদের সরকার গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দিয়েছে, তাদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে’।
জানা যায়, বছরের পর বছর ধরে লোকসান গুনতে থাকা ২৫টি পাটকল গতবছর বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। ফলে প্রায় ২৫ হাজার কর্মী কাজ হারায়। পরবর্তীতে, ২০১৮ সালের বাংলাদেশ শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ আইন অনুযায়ী কলগুলো বেসরকারীকরণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। গত এপ্রিলে বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশন (বিজেএমসি) সরকারী পাটগুলো বেসরকারী খাতে ছেড়ে দিতে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহŸান করে। গত ১৫ জুন আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের দরপত্র আবেদন জমা দেয়া শেষ হয়েছে। গত ১৭ জুন ইজারা প্রস্তাব কমিটি দরপত্র খোলার পর প্রথম বৈঠক করে বিজেএমসি। ওই বৈঠকে জানানো হয়, বাংলাদেশ জুট মিলস ইজারা পেতে সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়েছে। এই মিলটি ইজারার জন্য ১১টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। মূলত, ঢাকার কাছাকাছি হওয়ায় এখানে বেশি আবেদন পড়েছে বলে মনে করছেন বিজেএমসির কর্মকর্তারা। দুইটি ভারতীয় ও একটি ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানসহ ২৪টি প্রতিষ্ঠান ইজারা গ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করে। ১৪টি কলের বিপরীতে ৫৯টি প্রস্তাবনা জমা পড়ে। তবে, খুলনার তিনটি কল কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সাড়া পায়নি। পরবর্তীতে বিজেএমসি টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি প্রতিষ্ঠানগুলোর সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করে চূড়ান্ত প্রস্তাবনা আহŸান করে। তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো দুটি জুট মিল বাদ দিয়ে ১২টি কলের জন্য প্রস্তাবনা জমা দেয়। এর মধ্যে কমিটি ২৫টি প্রস্তাব বাছাই করে। বাছাইকৃত ২৫টি প্রস্তাবনা চূড়ান্তভাবে বাছাইয়ের জন্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো হয়।