নিউজ ডেস্ক:
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে তা নিশ্চিত করার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, আমাদের খাদ্যের অপচয় কমাতে হবে, অপচয় যেন না হয়। সারাবিশ্বে একদিকে খাদ্যের অভাব, অপরদিকে প্রচুর খাদ্য অপচয় হয়। এই অপচয় যেন না হয় বরং যে খাদ্যগুলো অতিরিক্ত থাকে সেগুলো আবার কীভাবে পুনর্ব্যবহার করা যায়, সে বিষয়ে আমাদের চিন্তা করে ব্যবস্থা নিতে হবে। উদ্বৃত্ত যে খাদ্য থাকবে বা আপনি খেতে বসেও যে খাবারটা বেশি থাকবে, সেটাও কীভাবে পুনর্ব্যবহার করা, অন্য চাহিদা পূরণ করা যায় কি না- সেটাকেও গবেষণার মধ্যে রাখা দরকার।
শনিবার কৃষি মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস-২০২১’ উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অনুষ্ঠিত মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলেই উত্তরবঙ্গ ‘মঙ্গামুক্ত’ হয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এই উত্তরবঙ্গ আগামীতেও মঙ্গামুক্তই থাকবে। বাংলাদেশে আর যেন কখনও দুর্ভিক্ষ না হতে পারে, আর কেউ যেন চক্রান্ত করে দুর্ভিক্ষ আনতে না পারে সেদিকে বিশেষভাবে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্য চাহিদা ইনশাল্লাহ আমরা পূরণ করে যাব।
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্রান্তে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোঃ মেসবাহুল ইসলাম অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) প্রকাশিত ‘হান্ড্রেড ইয়ার্স অব এ্যাগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন। একই সঙ্গে তিনি জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘বঙ্গবন্ধু ধান ১০০’ অবমুক্ত করেন এবং ‘বঙ্গবন্ধু ধান ১০০’ দিয়ে নির্মিত জাতির পিতার একটি প্রতিকৃতিও উন্মোচন করেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে কৃষিতে ভর্তুকি দেয়ার বিষয়ে এক সময়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা বাধা দিলেও তাদের কথা শোনেননি উল্লেখ করে বলেন, যেমন বিশ্বব্যাংক আমাদের পরামর্শ দিয়েছে এটাতে ভর্তুকি দেয়া যাবে না। আমি বললাম পৃথিবীর সব দেশ দেয়, আমরা দেব না কেন? আমার দেশের মানুষের খাদ্য আগে। তাঁদের প্রথম চাহিদা হচ্ছে খাদ্য। আগে তো আমাকে খাদ্য দিতে হবে। তার জন্য আমার উৎপাদন বাড়াতে হবে। ঠিক আছে আমাদের যদি কেউ এই ব্যাপারে ঋণ না দেয় তখন আমরা নিজের পয়সায় দেব।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে গ্যাস বিক্রির প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাঁর দলকে ক্ষমতায় আসতে না দেয়ার প্রসঙ্গটিও তুলে ধরেন অনুষ্ঠানে। তিনি বলেন, ২০০১ সালে আমরা ক্ষমতায় আসতে পারলাম না। কারণ গ্যাস বিক্রি করার মুচলেকা দেইনি বলে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হলো না। বৃহৎ দুটি দেশ আর প্রতিবেশী দেশ তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারেনি। কারণ, আমার নিজের সম্পদ আমি অন্যের কাছে বিক্রি করার আগে আমার কথা ছিল, আগে দেশের মানুষ। তাদের চাহিদা পূরণ হবে, পঞ্চাশ বছরের মজুদ থাকবে। তারপর যেটি অতিরিক্ত থাকবে সেটা আমরা বেচতে পারি। তাছাড়া এই দেশের সম্পদ আমি বেচতে পারিনি। এ কথা আসলে একটা বিশাল দেশ আমেরিকা আর পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত তাদের পছন্দ হয়নি। কাজেই আমি ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে পারিনি। দেশ বেচে তো আমি ক্ষমতায় আসব না, এটা হলো বাস্তব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিজেরা খাদ্য উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রফতানি করব। অর্থ উপার্জন করব। এটা আমরা পারি, পারব। উৎপাদনের পাশাপাশি খাদ্যের মানও ঠিক রাখতে হবে। কৃষিজমি যাতে কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে সকল খেয়াল রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তাঁর সরকার উন্নয়ন করে যাবে। কিন্তু কৃষিজমি যাতে কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকেও সকলকে খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, কৃষিজমি সংরক্ষণ করেই আমাদের উন্নয়ন করতে হবে। কেননা, আমাদের লক্ষ্যই হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আল্লাহর রহমতে খাবারে বাংলাদেশে আর কোন অভাব থাকবে না। তবে গবেষণা অব্যাহত রাখতে হবে।
এ প্রসঙ্গে উদাহরণ তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, যেমন কোন বীজ গবেষণা করে উৎপাদনের পর গবেষণা অব্যাহত না রাখলে উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে। কাজেই খাদ্য, পুষ্টিসহ আমাদের সব গবেষণা চলমান থাকতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে এবং আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্য মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা এবং শিক্ষা-চিকিৎসাসহ মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করা এবং বাংলাদেশে একটি মানুষকেও যাতে ঠিকানাবিহীন থাকতে না হয় তাই প্রতিটি গৃহহীনের জন্য আমরা ঘর তৈরি করে দিচ্ছি। ঘরে ঘরে বিদ্যুত দেয়ার পাশাপাশি রাস্তাঘাট,পুল, ব্রিজের ব্যাপক উন্নয়ন করে যাচ্ছি এবং এই করোনাকালীনও আমি আহবান জানিয়েছি, আমাদের এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদী না থাকে।
করোনা মহামারীর আগ্রাসনে বিশ্বের অনেক দেশেই খাদ্য সমস্যা দেখা দিলেও তিনি জাতির পিতার বক্তব্য ‘আমাদের মাটি আছে, মানুষ আছে’ উদ্ধৃত করে আমরা যেন আর কোনদিন খাদ্যাভাবে না ভুগি সে বিষয়ে সকলকে সচেষ্ট হবারও আহবান জানান। তিনি বলেন, স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতির পিতা ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে কৃষির ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতার প্রদত্ত ভাষণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের উদ্ধৃতি তুলে ধরেন। যেখানে জাতির পিতা বলেছিলেন- ‘আমার জীবনের একমাত্র কামনা, বাংলাদেশের মানুষ যেন খাদ্য পায়, আশ্রয় পায়, উন্নত জীবনের অধিকারী হয়।’ ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির অপর এক ভাষণের উদ্ধৃতি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী দেশে কৃষি বিপ্লব সাধনের জন্য কৃষকদের কাজ করে যাওয়ার জাতির পিতা আহবান তুলে বলেন, সে সময় ৫০০ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেটের মধ্যে ১০১ কোটি টাকাই বঙ্গবন্ধু কৃষির উন্নয়নের জন্য রেখেছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা সমবায় পদ্ধতিতে সমন্বিত/যৌথ কৃষি খামারের প্রচলন করতে চেয়েছিলেন। তাঁর সেই বিশেষ পদ্ধতির চাষাবাদ ব্যবস্থায় শুধু কৃষি উন্নয়নই নয়, স্থানীয় রাজস্বে পল্লী উন্নয়নের রূপরেখাও নিহিত ছিল। প্রতি গ্রামে যৌথ চাষ হবে এবং ফসলের ভাগ যাবে মালিক, শ্রমিক, গ্রাম তহবিল- এ তিন জায়গায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সার-বীজ কৃষকের হাতের নাগালে পৌঁছে দিয়েছি। অথচ এ সার চাইতে গিয়ে আন্দোলন করায় ১৮ কৃষককে গুলি করে হত্যা করেছে খালেদা জিয়ার সরকার। বিদ্যুত চাওয়ায় নয়জনকে হত্যা করা হয়। আর আজকে আমরা প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দিয়েছি।
অনুষ্ঠানে তাঁর সরকারের উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খাদ্যের চাহিদা পূরণে বিনা পয়সায় খাবার বিতরণ করছি। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনে সহায়তা করেছি। প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ কৃষককে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদান করেছি, তাঁদের মধ্যে এখন পর্যন্ত এক কোটি ২ লাখ ৭০ হাজার ১৪৩ জন ১০ টাকায় ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খোলার মাধ্যমে সুবিধা পাচ্ছেন।
তাঁর সরকার কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ভ্যালু চেন ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করছে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ থেকে বর্তমান পর্যন্ত বৈরি পরিবেশ সহনশীলসহ ৬৫৫টি উন্নত ফলনশীল জাতের ফসল এবং ৫৯১টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। কৃষি, শিক্ষা-গবেষণা খাতে বরাদ্দ আরও বাড়িয়েছি। ফলে আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরা কৃষি খাতে ৪র্থ শিল্প বিপ্লব প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
দেশের কৃষি বিজ্ঞানীদের সাফল্যে তাঁদের ধন্যবাদ প্রদান করে তাঁর সরকারের প্রণীত ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’ এবং ‘বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’ গঠনসহ সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান প্রণয়নের এবং ‘জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতি-২০২০’ প্রণয়নেরও কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সরকার নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রধান কার্যালয় স্থাপন ও কেন্দ্রীয় ল্যাবরেটরি ও বিভাগীয় ল্যাবরেটরি স্থাপনের জন্য ইতোমধ্যে পূর্বাচলে ৫ একর জমি বরাদ্দ দিয়েছে।
খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা সমৃদ্ধ করতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ওপর সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ লক্ষ্যে ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ৮টি বিভাগে ৮টি রেফারেন্স ল্যাবরেটরি স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি এবং নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের হটলাইন চালু করেছি। তিনি বলেন, ২০০৯ সাল থেকে যদি তুলনা করি, তবে ২০২০ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চালের উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ শতাংশ, গমের ২১ শতাংশ, ভুট্টার ৬৪০ শতাংশ, আলুতে ৯৬ শতাংশ, ডালে ৪৪৩ শতাংশ, তৈলবীজে ৭৫ শতাংশ, সবজির ক্ষেত্রে ৫৩৪ শতাংশ এবং পেঁয়াজে প্রবৃদ্ধি হয়েছে শতকরা ২৪৮ ভাগ, যা সত্যিই অভাবনীয়।
বর্তমানে তাঁর সরকার চাহিদার উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিগত ১২ বছরে প্রাণিজ আমিষ দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন যথাক্রমে ৫ গুণ, ৭ গুণ এবং ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপে কৃষিতে বৈপ্লবিক সাফল্য এসেছে। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের ৯৪তম হলেও বাংলাদেশ আজ খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বে ১১তম স্থানে উঠে এসেছে। কৃষকের জন্য কৃষি বাতায়ন, কৃষক বন্ধু ফোন সেবা, কৃষকের জানালা, কৃষি কল সেন্টার খোলার কথাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় কাজ করে যাওয়ার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে এখন বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। যার জন্য আমি মনে করি, খাবারে বাংলাদেশের আর কোনদিন আল্লাহর রহমতে কোন অভাব থাকবে না। এজন্য গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, একটি বীজ যখন আপনি আবিষ্কার করেন, উদ্ভাবন করেন- সেটার যখন উৎপাদনটা হয়, ধীরে ধীরে কিন্তু উৎপাদনের পরিমাণটা কমতে থাকে। এজন্য সব সময় গবেষণাটা অব্যাহত রাখতেই হবে।