নিউজ ডেস্ক:
ইতিহাস ঐতিহ্য সমৃদ্ধ প্রতœতাত্ত্বিক স্থান ও কীর্তিতে ভরা উত্তরের নওগাঁ জেলাও প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দেশব্যাপী চলমান উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা ভূখন্ড টি ১৯৮৪ সালের ১ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত নওগাঁ মহকুমা হিসেবে গণ্য হতো। সেটিই হয়েছে এখন বাংলাদেশের কণ্ঠশোভা নওগাঁ জেলা। এ জেলার উত্তরে ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর, দক্ষিণে বাংলাদেশের নাটোর ও রাজশাহী জেলা, পূর্বে বগুড়া জেলা ও পশ্চিমে ভারতের মালদহ জেলা ও বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অবস্থান।
ধামইরহাট, পত্নীতলা, মহাদেবপুর, বদলগাছী, পোরশা, সাপাহার, নিয়ামতপুর, মান্দা, রানীনগর, আত্রাই ও নওগাঁ সদর এই ১১টি উপজেলা নিয়ে গঠিত নওগাঁ জেলা। এ জেলা ভূমির প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য অনুসারে তিনটি অঞ্চলে গঠিত। বরেন্দ্র অঞ্চল, বিল বা ভর অঞ্চল এবং পলি অঞ্চল। নওগাঁ জেলার ওপর দিয়ে প্রবহমান আত্রাই নদী, ছোট যমুনা নদী। এছাড়া পুনর্ভবা নদী, তুলশীগঙ্গা নদী, নাগর নদ, চিরি নদী, ফকির্ণী নদী এগুলো এখন মৃতপ্রায়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের জোয়ারে এই নওগাঁ জেলাও ভাসছে।
নওগাঁ জেলায় বর্তমান সরকারের গত দুবছরে সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতায় ৪২৪ কোটি টাকার উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে ৪টি পৃথক প্রকল্পে ৫২১ কোটি ৭৮ লাখ টাকার উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সাজেদুর রহমান জানিয়েছেন, রিজিওনাল প্রকল্পের আওতায় নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের নওগাঁ অংশে ৫২ কিলোমিটার এবং রাজশাহী অংশে ২২ কিলোমিটার মোট ৭৪ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্তকরণসহ উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এতে মোট ব্যয় হয়েছে ৪২৪ কোটি টাকা।
২২ দশমিক ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট নওগাঁ-নাটোর সড়ক নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। ১৮ ফুট প্রস্থ, ৮টি ব্রিজ ও ১৫টি কালভার্টসহ এই সড়ক নির্মাণ কাজে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২০১ কোটি টাকা। চলতি ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা। ইতোমধ্যে এই প্রকল্পে ৭৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
এদিকে ৩টি ব্রিজ ও ৩১টি কালভার্টসহ ৩৬ দশমিক ৫ কিলোমিাটর দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট মান্দা-নিয়ামতপুর-শিবপুর-পোরশা সড়ক নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। একইভাবে চলমান রয়েছে পাহাড়পুর-খঞ্জনপুর-জয়পুরহাট সড়ক নির্মাণ কাজ। নওগাঁ অংশে সাড়ে ১৫ কিলোমিটার ও জয়পুরহাট অংশে ৮ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে সংযুক্ত রয়েছে ১৪টি কালভার্ট।
অপরদিকে নওগাঁ জেলার রানীনগর-কালিগঞ্জ-নন্দিগ্রাম (কাঠম) ২২ দশমিক ২২ কিলোমিটার সড়ক ৪টি ব্রিজ নির্মাণসহ প্রশস্তকরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এই তিনটি প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩১৪ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে এই তিনটি প্রকল্পে ১২০ কোটি টাকা ব্যয় সম্পন্ন হয়েছে। এসব প্রকল্প আগামী ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষ হওয়ার কথা।
এদিকে নওগাঁ-রাজশাহী সড়ক উন্নয়ন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নওগাঁ শহরে ভাঙ্গা মাসজিদ থেকে কাজির মোড় পর্যন্ত প্রায় ৬ কিলোমিটার সড়কে ফিনিসিং পর্যায়ে ১ লেয়ার উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করতে ৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে।
বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার বিকেলে এলজিইডির তত্ত্বাবধানে ১ কোটি ৪ লাখ টাকা ব্যয়ে হাঁসাইগাড়ি ইউপি (কাটখৈর জিসি) থেকে গোপাইহাট সড়ক এবং ৯০ লাখ ২ হাজার টাকা ব্যয়ে কাটখৈর জিসি পানিশাইল থেকে সতিহাট সড়কের উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন করেন, নওগাঁ সদরের এমপি ব্যারিস্টার নিজাম উদ্দিন জলিল জন।
এছাড়া এলজিইডি, গণপূর্ত, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে চলছে উন্নয়ন কার্যক্রম। ইতোমধ্যেই নওগাঁ ১০০ শয্যার হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রূপান্তর করা হয়েছে। গ্রামীণ রাস্তাঘাটের উন্নয়নও চলছে একাধারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও পিছিয়ে নেই।
অপরদিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির সারা বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ উপহার গৃহহীনদের ঘরে সুখেই বসবাস করছেন নওগাঁর গৃহহীন পরিবারগুলো। সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে নওগাঁয় আরও ১ হাজার ৫৫৮টি গৃহহীন পরিবার তাদের ছেলেমেয়ে ও পরিবার পরিজন নিয়ে সুন্দরভাবে জীবনযাপন করছেন। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় জেলার ১১টি উপজেলায় এসব গৃহহীন পরিবার জীবনযাপন করছেন। ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রতিটি ঘরে দুটি কক্ষ, একটি টয়লেট, রান্নাঘর, কমনস্পেস, একটি বারান্দা, বিদ্যুত ও পানির সুব্যবস্থা করা হয়েছে।
গত ২০ ও ২৩ জানুয়ারি ভার্চুয়াল কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী সারাদেশে একযোগে গৃহহীনদের কাছে এসব গৃহ হস্তান্তরের উদ্বোধন করেন।
নওগাঁর রানীনগর উপজেলায় প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে মোট ১২৩টি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একডালা ইউনিয়নের ডাকাহার গ্রামের চৌধুরী পুকুর পাড় ও মালিপুকুর পাড়ে ৯১টি, কালিগ্রাম ইউনিয়নের সিলমাদার পুকুর পাড়ে ১১টি, কাশিমপুর ইউনিয়নে ১৩টি ও বড়গাছা ইউনিয়নে ৮টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে এই আশ্রয়ণ প্রকল্পগুলোতে সকল প্রকারের সুবিধা প্রদান সম্পন্ন করা হয়েছে। মহাদেবপুর উপজেলায় দ্বিতীয় পর্যায়ে এনায়েতপুর ইউনিয়নের রোদইল মৌজায় ৩৩টি, খাঁপুর মৌজায় ৩৪টি ও চেরাগপুর ইউনিয়নের বাগধানা মৌজায় ৯টি ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে।
মান্দা উপজেলার ৯০টি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মৈনম ইউনিয়নে ৪৯টি, ভালাইন ইউনিয়নে ২১টি, প্রসাদপুর ইউনিয়নে ৭টি, কালিকাপুর ইউনিয়নে ৭টি, নূরুল্যাবাদ ইউনিয়নে ৩টি, মান্দা ইউনিয়নে ১টি এবং পরানপুর ইউনিয়নে ২টি নির্মাণ করা হয়েছে।
ধামইরহাট উপজেলায় ১৫০টি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মানপুর গ্রামে ৩৯টি, আগ্রাদ্বিগুণের কাশিপুর ৩৫টি, রসপুর ১০টি, উদয়শ্রী বেল পুকুর ১৪টি, জোতওসমান কাগজকুঠা ১৪টি এবং বৈদ্যবাটি গ্রামে ৩৮টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে।
সদর উপজেলার আবাদপুর গ্রামের উপকারভোগী স্বপন জানান, আমি প্রধানমন্ত্রীর ঘর পাওয়ার পর ঘরে ওঠার কিছু দিন পর দেখি আমার ঘরের দেওয়াল ও মেঝের প্লাস্টার উঠে যাচ্ছে। এ বিষয়ে প্রশাসনকে জানানোর পর দেয়াল প্লাস্টার ও মেঝেতে প্লাস্টার করে দেয় এবং আবার রং করে ঠিক করে দিয়েছে। এখন আর কোন অসুবিধা নেই।
উপকারভোগী লুৎফর রহমান, ফরিদা খাতুন, রশিদা বিবি, আমিনুল ইসালাম বলেন, একসময় তাদের কোন মাথা গোঁজার ভাল কোন ঠাঁই ছিল না। অন্যের জমিতে কুঁড়ে ঘর করে কোনরকম দিনযাপন করতেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাদের এসব ঘর করে দেয়ার পর থেকে তাদের থাকার আর কোন অসুবিধা হয় না। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী (অন্ধ) ডলি বেগম সন্তান না থাকায় স্বামীর হাত ধরে বছরের পর বছর পাড়ায় পাড়ায় ভিক্ষা করে বেড়ান। আর দিন শেষে মানুষের বাড়ির অলিতে গলিতে রাত কাটান। বর্তমানে ডলি জেলার রানীনগর উপজেলার চৌধুরীপুকুর পাড়ে নির্মাণ করা প্রধানমন্ত্রীর দেয়া উপহার সেমি পাকা ঘরে বসবাস করছেন। এখন ডলি পাকা ঘরে খুব সুখেই আছেন। আরেক বৃদ্ধ নগর আলী। দেশ স্বাধীনের পর পর দিনাজপুর থেকে নওগাঁয় এসে বসবাস করছেন। কিন্তু দিনমজুর এই বৃদ্ধর ভাগ্যে কখনই কোন বাড়ি জোটেনি। এখন নগর আলী প্রধানমন্ত্রীর উপহার দেয়া সেমি পাকা ঘরে বসবাস করছেন।
এই উপজেলার কাশিমপুর ইউনিয়নের উপকারভোগী তপন সরকার, বিপ্লব সরকার ও শুকিল সরকার। তারা এখন কাশিমপুর পুকুর পাড়ে প্রধানমন্ত্রীর উপহার ঘরে বসবাস করছে। তারা কেউ মেয়ের বিয়ের জন্য কেউবা সুদের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে বাড়ি বিক্রি করে অন্যের বাড়িতে বসবাস করতেন। তারা কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি তাদের নিজের নামে জমিসহ পাকা বাড়ি হবে। এখন তারা প্রধানমন্ত্রীর উপহার ঘরে সুখেই বসবাস করছেন।
এমন অনেক মানুষই যারা কখনও পাকা ঘরের কথা স্বপ্নেও কল্পনা করেননি। আজ তারা প্রধানমন্ত্রীর দেয়া উপহার সেমি পাকা ঘরে সুখে বসবাস করছেন। জেলার সকল বাড়িই মানসম্মতভাবে নির্মাণ করায় কোন বাড়িতেই তেমন কোন সমস্যা হয়নি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি তদন্ত দল নওগাঁর বিভিন্ন উপজেলার বাড়িগুলো পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
উপকারভোগীরা বলেন, এসব ঘরে টয়লেট, বিদ্যুত ও পানির সুব্যবস্থা থাকায় তাদের কোন রকম ভোগান্তিতে পড়তে হয় না। বিদ্যুতের আলোয় ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাও করাতে পারেন। তাই আমরা খুশি। আমরা দোয়া করি প্রধানমন্ত্রী যেভাবে আমাদের মতো অসহায় মানুষদের সহযোগিতা করেছেন আল্লাহ যেন এভাবেই তার উপকার করেন।
এ বিষয়ে নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোঃ হারুন-অর-রশীদ জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় জেলায় প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ১ হাজার ৫৫৮ পরিবারকে ২ শতাংশ খাস জমি বন্দোবস্তপূর্বক, কবুলিয়ত ও নামজারিসহ এসব ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। এসব ঘর নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মাঠ পর্যায়ে সরকারের কর্মকর্তারা নিরলসভাবে কাজ করেছেন। যার ফলে এতগুলো পরিবারের মুখে হাসি ফুটেছে।
ঘরে ফাটল ও মেঝে উঠে যাওয়ার প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক বলেন, যেসব নিচু জমি ভরাট করে নতুন মাটিতে ঘর নির্মাণ ও বর্ষার কারণে দু’একটি ঘরে সামান্য এই সমস্যা দেখা গেছে। আমরা শোনার সঙ্গে সঙ্গে এসব ঘর পুনরায় মেরামত করে দিয়েছি। যাতে করে তাদের কোন থাকতে অসুবিধা না হয়। ইতোমধ্যে সেগুলো ঘর পরিদর্শনও করেছি। আমরাও চাই প্রধানমন্ত্রী যে লক্ষ্য নিয়ে এসব গৃহহীন ও ভূমিহীনকে ঘর হস্তান্তর করছেন সেই লক্ষ্য যেন পূরণ হয়।