নিউজ ডেস্ক:
দেশের স্থলভাগে যেকোনো স্থানে গ্যাসকূপ অনুসন্ধানের সক্ষমতা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) রয়েছে, তবে সমুদ্রে অনুসন্ধানে এখনো পিছিয়ে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমান সরকারের নানা উদ্যোগে স্থলভাগে গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছে বাপেক্স। দেশের তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদের আবিষ্কার, উৎপাদন ও সাশ্রয়ী মূল্যে সরবরাহের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। বাপেক্সের কর্মকর্তারা বলেছেন, বাপেক্সের রিগ, ২ডি, ৩ডি সাইসমিক সার্ভে যন্ত্রপাতিসহ সব যন্ত্র আন্তর্জাতিক মানের। বর্তমান সরকার বাপেক্সের জন্য আধুনিক ও যুগোপযোগী একটি অর্গানোগ্রামও করে দিয়েছে। সেই অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী দক্ষ জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। তারা দেশের স্থলভাগে সর্বত্রই অনুসন্ধান চালাবে এবং জরিপে পাওয়া গেলে যেকোনো জায়গা থেকেই গ্যাস উত্তোলনের জন্য কূপ খননের সক্ষমতা বাপেক্সের আছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, দেশের স্থলভাগে গ্যাসকূপ খনন ও অনুসন্ধানের জন্য এখন বাপেক্সই যথেষ্ট। বাপেক্স ও বিদেশি কম্পানিগুলোর কাজের ক্ষেত্রে ব্যয় করা অর্থের পরিমাণেও অনেক পার্থক্য দেখা গেছে। তার পরও বিদেশি কম্পানিগুলোকে দিয়ে স্থলভাগের কূপ অনুসন্ধানের কাজ করানো হচ্ছে। তবে সমুদ্রে অনুসন্ধানের জন্য বিদেশি কম্পানির প্রয়োজনীয়তা এখনো আছে।
বর্তমানে দেশে ২৮টি গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে, এর মধ্যে ৯টি বাপেক্সের আবিষ্কৃত। ৯টির মধ্যে বর্তমানে সাতটি উৎপাদনক্ষম। একটি বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক না হওয়ায় স্থগিত করা হয়েছে। সর্বশেষ ২৮তম সিলেটের জকিগঞ্জের গ্যাসক্ষেত্রটিতে পাইপলাইন ও প্রসেস লাইন হওয়ার পরে উৎপাদন শুরু হবে। এ ছাড়া বাপেক্সের ১২টি অনুসন্ধান কূপ এবং ১৭টি উন্নয়ন কূপ রয়েছে। দেশের স্থলভাগে এখন এককভাবে কাজ করছে বাপেক্স। গত এক বছরে বাপেক্সকে শক্তিশালীকরণে জোর দেওয়া হয়েছে। এখন একসঙ্গে অনেক প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে বাপেক্স। আগামী তিন বছরে অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে বাপেক্স।
বাপেক্সের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান একটি অনুসন্ধান কূপ খননে খরচ করছে প্রায় ১৮০ কোটি টাকা, সেখানে জকিগঞ্জের কূপ খননে বাপেক্স ব্যয় করেছে ৭৫ থেকে ৮০ কোটি টাকা।
বাপেক্স সূত্রে জানা যায়, আগামী ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন বছরে অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে বাপেক্স। সেখানে পাঁচটি অনুসন্ধান কূপ খনন, আটটি উন্নয়ন কূপ খনন এবং ১০টি ওয়ার্কওভার কূপ খননের শিডিউল করা আছে। এর বাইরে আগামী তিন বছরের জন্য ২৭০ লাইন কিলোমিটার ভূতাত্ত্বিক জরিপ, ১১ হাজার ২২০ লাইন কিলোমিটার ২ডি সাইসমিক জরিপ, ২৫৮০ বর্গকিলোমিটার ৩ডি সাইসমিক জরিপ, ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং ৯০ ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি প্রসেস প্ল্যান্ট স্থাপন করা হবে। প্রসেস প্ল্যান্ট করার জন্য টেন্ডার দেওয়া হয়েছে। শ্রীকাইল গ্যাসক্ষেত্রের জন্য ওয়েলহেড কম্প্রেসর স্থাপন এবং শ্রীকাইল ইস্ট-১ কূপের জন্য গ্যাস গ্যাদারিং পাইপলাইন স্থাপন করা হবে।
বাপেক্সের চলমান কাজগুলো নিয়ে কর্মকর্তারা বলেন, তিতাসের-১৩, ফেঞ্চুগঞ্চ-৩ ও সিলেট-৮ নম্বর কূপের ওয়ার্কওভার চলছে। জকিগঞ্জে যেদিকে গ্যাস পাওয়া গেছে সেদিকে দুই ওয়ার্কওভার প্রকল্পের কাজ চলমান।
গত এক বছরে বাপেক্সের সাফল্য
সিলেটের জকিগঞ্জে দেশের ২৮তম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে বাপেক্স। এখান থেকে যে পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করা যাবে, তার বর্তমান বাজারমূল্য এক হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। এই কূপ থেকে দৈনিক ১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের মাধ্যমে আগামী ১০ থেকে ১২ বছর জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ করা যাবে। শ্রীকাইল ইস্ট-১ কূপ খনন করে নতুন একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে দৈনিক ১০ থেকে ১২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। সিলেট-৯ সফলভাবে কূপ খনন করে দৈনিক পাঁচ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন নিশ্চিত করা হয়েছে। শাহবাজপুর-৩ বিদেশি পরামর্শক ব্যতীত নিজস্ব জনবল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে সফলভাবে ওয়ার্কওভার সম্পন্ন করে দৈনিক ২০ থেকে ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন নিশ্চিত করা হয়েছে। শ্রীকাইল-৪ কূপে ওয়ার্কওভার সম্পন্ন করে দৈনিক ২০ থেকে ২৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। ফেঞ্চুগঞ্জ-৪ কূপে ওয়ার্কওভার সম্পন্ন করে দৈনিক ১০ থেকে ১২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। তিতাস-৭ কূপে ওয়ার্কওভার কাজ সম্পন্ন করে দৈনিক ২০ থেকে ২২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। শ্রীকাইল ইস্ট-১ কূপ থেকে গ্যাস গ্যাদারিং পাইপলাইনের মাধ্যমে দৈনিক ১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া সীতাকুণ্ড ভূগঠনে ৯০ লাইন কিলোমিটার ভূতাত্ত্বিক জরিপ কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। রূপকল্প-৯ ২ডি সাইসমিক (নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও টাঙ্গাইল জেলা) ৩৫০০ লাইন কিলোমিটার উপাত্ত সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ ও বিশ্লেষণ সম্পন্ন করে নতুন কূপ খননের স্থান চিহ্নিতকরণ এবং গ্যাসের মজুদ নির্ধারণ করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে গত এক বছরে অনুসন্ধান কূপ, উন্নয়ন কূপ এবং ওয়ার্কওভার কার্যক্রমের মাধ্যমে দৈনিক ১০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস উৎপাদন নিশ্চিত করা হয়েছে। তার মধ্যে দৈনিক ৯০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, বাপেক্স স্থলভাগে কাজ করতে পুরোপুরি সক্ষম। বাপেক্স নিজেদের কাজগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রের কাজগুলোও চুক্তিভিত্তিক করছে। ২ডি, ৩ডি সাইসমিক, কূপ খনন ও ওয়ার্কওভার এবং অনুসন্ধান কূপ খনন করতে সক্ষম বাপেক্স। তিনি আরো বলেন, বর্তমান সরকার বাপেক্সকে সক্ষম করে তুলেছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর নতুন চারটি রিগ কিনে দিয়েছে। আগে বাপেক্সের রিগ ছিল মাত্র দুটি।
বাপেক্সের এমডি বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে প্রতি সাতটিতে একটি, আমেরিকা ও কানাডায় প্রতি ১১টিতে একটি কূপ খননে গ্যাস পাওয়া গেলে সফলতা ধরা হয়। সেখানে বাপেক্স প্রতি তিনটি কূপ খননে একটিতে সফলতা পেয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চেয়ে অনেক ভালো। বিদেশি প্রতিষ্ঠান দেশে কূপ খননের সময় বেশ কিছু জায়গায় দুর্ঘটনাও ঘটেছে, কিন্তু বাপেক্সের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনার রেকর্ড নেই। বাপেক্স জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে খুবই সতর্কতার সঙ্গে এবং দেশপ্রেমিক হিসেবে কাজ করে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে বাপেক্সের স্থলভাগে কূপ খনন, অনুসন্ধান কূপ, ওয়ার্কওভার, ২ডি ও ৩ডি সাইসমিকসহ সব ধরনের সক্ষমতা আছে। তাই বাপেক্সকে বসিয়ে না রেখে এর সক্ষমতার মধ্যে যতগুলো কাজ করানো যায় সরকারের উচিত তাদের দেওয়া। কূপ খননে কিছু রিস্ক রয়েছে, গ্যাস না পেলে অনেকেই বলে ফাও ফাও সরকারের টাকা গেল। গ্যাস না পাওয়াও কিন্তু অনুসন্ধানের একটি অংশ। যতগুলো কূপ খনন করবে, সব কটিতেই গ্যাস পাওয়া যাবে এমন কোনো কথা নেই। এখন পর্যন্ত কূপ খননের সফলতার মাত্রা আমাদের দেশে অনেক ভালো।’