নিউজ ডেস্ক:
কথিত অভ্যুত্থানের অভিযোগে ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর সামরিক বাহিনীতে কর্মরতদের ফাঁসি, সাজা ও চাকরিচ্যুত করায় সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার দাবি করেছেন সেনা ও বিমান বাহিনীর ক্ষতিগ্রস্ত সদস্য ও তাদের পরিবার। একই সঙ্গে তৎকালীন ঘটনার রহস্য উন্মোচন করতে তদন্ত কমিশন গঠন, যাদের অন্যায়ভাবে ফাঁসি, সাজা ও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে তাদের তালিকা প্রকাশ ও ক্ষতিগ্রস্ত সদস্যদের পুনর্বাসন করার লক্ষ্যে তাদের পোষ্যদের যোগ্যতা অনুসারে সরকারী চাকরিতে নিয়োগ প্রদানের দাবি জানিয়েছেন তারা। জিয়াউর রহমানের দেয়া নির্মম ফাঁসি ও কারাদন্ডের শিকার সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্য এবং পরিবারবর্গ শুক্রবার সকালে রাজধানীর নাজিম উদ্দিন রোডের পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে অস্থায়ী বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে গিয়ে এসব দাবি তোলেন। তিনদিনের কর্মসূচীর মধ্যে আজ শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আলোচনা সভা এবং রবিবার স্মারকলিপি পেশ করবে অভ্যুত্থানের অভিযোগে চাকরিচ্যুত, সাজাপ্রাপ্ত এবং ফাঁসি কার্যকর হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা।
ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত সার্জেন্ট আবুল হোসেন মজুমদারের ছেলে মামুনুর রশিদ মজুমদার বলেন, তার বাবা বিমান বাহিনীতে চাকরি করতেন। তিনি ভলিবল খেলায় পারদর্শী ছিলেন। ২ অক্টোবর ভলিবল খেলতে কুমিল্লায় যান। সেখান থেকে সন্ধ্যায় বিমান বাহিনীর গেটে আসলে তার পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। তিনি বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট পরিচয় দিতেই তাকে গুলি করতে উদ্যত হন কতিপয় কর্মকর্তা। পরে তাকে আটক করে কুমিল্লা কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ফাঁসি দিয়ে টিক্কারচরে কবর দেয়া হয়। এসব আমরা পরে জানতে পেরেছি। মামুনুর রশিদ বলেন, মানবতার স্বার্থে তদন্ত কমিশন গঠন করে আমার বাবাসহ যাদের হত্যা করা হয়েছে, তারা দোষী ছিল না কি নির্দোষ ছিল তা জানিয়ে দেয়া হোক। সাতাত্তরের ওই ঘটনার সঙ্গে জিয়াউর রহমান ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা জড়িত ছিলেন বলে দাবি করে তিনি বলেন, এসব হত্যাযজ্ঞের খলনায়ক জিয়াসহ তাদের মরণোত্তর বিচার চাই।
সাজাপ্রাপ্ত কর্পোরাল মোঃ রুহুল আমিনের ছেলে রোমেল কায়েস বলেন, তার বাবাকে ৪ বছর সাজা শেষে চাকরিচ্যুত করা হয়। ওই দিন যাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে, শাস্তি দেয়া হয়েছে, তারা নির্দোষ ছিলেন। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। তাদের কাছে একটাই দাবি, আমার বাবা ও তার সহকর্মীরা যে নির্দোষ ছিলেন, সেটি প্রমাণ করে দিন। বাবা কিছুদিন আগে মারা গেছেন। ওই ঘটনার বিচার হলে বাবার আত্মা শান্তি পাবে। আমার বাবার চরিত্রে কালিমা লেপন করা হয়েছে। তা থেকে মুক্তি চাই।
সাজাপ্রাপ্ত বিমান বাহিনীর কর্পোরাল রেজাউর রহমান খান বলেন, কোন কারণ ছাড়া তাকেও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। কারণ হিসেবে লেখা ছিল ‘প্রয়োজন নেই।’ এবং কোন ধরনের সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। রেজাউর রহমান খানের কাছেও আজ অবধি তাকে চাকরিচ্যুত করার কারণ অজানাই রয়ে গেল।
১০ বছরের সাজা হয়েছিল সার্জেন্ট এনামুল হকের। পরে চার বছর সাজা ভোগ করার পর সাজা মওকুফ হয়। তাকে সাজা দেয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া। অথচ এ রকম কিছুর সঙ্গেই তিনি জড়িত ছিলেন না।
পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে আসা সেনা ও বিমান বাহিনীর ক্ষতিগ্রস্ত সদস্যরা বলেন, সাতাত্তরের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে জাপান রেড আর্মির সদস্যরা জাপান এয়ার লাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করে ঢাকার পুরাতন বিমানবন্দরে অবতরণ করেছিল। ১ অক্টোবর যখন বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনার অবসান ঘটল সেই রাতেই জিয়ার অনুগত বাহিনী সেনা ও বিমান বাহিনীর ছাউনিতে এলোপাতাড়ি গুলি করতে করতে শত শত ঘুমন্ত সৈনিককে জোর করে ব্যারাক থেকে অস্ত্রের মুখে বের করে নিয়ে আসে এবং পরবর্তীতে তাদেরকেই অভ্যুত্থানের অভিযোগে ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে গুলি করে হত্যা করে। ফায়ারিং স্কোয়াড ও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে প্রায় ১৪শ’ সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যকে রহমান অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে অসহায় সৈনিকদের উলঙ্গ করে হাত, পা ও চোখ বেঁধে দিনের পর দিন ফেলে রেখেছে। কারও কারও কাছ থেকে অজানা কারণে স্বাক্ষর নিয়েছিল। আগে ফাঁসি পরে প্রহসনের বিচারের রায় হয়েছে। জিয়ার ঘোষিত মার্শাল ল ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রহসনের সময় এক একজন সৈনিকের জীবন মরণের সিদ্ধান্ত নিতে গড়ে এক মিনিটেরও কম সময় নিয়েছিলেন তৎকালীন ট্রাইব্যুনাল প্রধানরা। ছুটিতে থাকা অবস্থায় অনেককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তারা এক রাতে কতজনকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছে তা তারাও জানে না। কারাগারের ড্রেনগুলো সৈনিকদের রক্তে ভরপুর হয়ে যেত। এদের অত্যাচারে পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতাকেও হার মানিয়েছিল। অথচ ১৯৭৭-এর অক্টোবরের সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগের শিকার পরিবারকে আজ অবধি কোন প্রকার সাহায্য দেয়া হয়নি।
চাকরিচ্যুত ও কারাদন্ডপ্রাপ্ত সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যরা তাদের সঙ্গে ৪৪ বছর আগে অন্যায় করা হয়েছে বলে কারাগারের সামনে ফেস্টুন হাতে দাঁড়িয়ে বিচার চাইলেন। আর এসবের সঙ্গে জড়িত জিয়াউর রহমানেরও মরণোত্তর বিচার দাবি করেছেন তারা। ফাঁসিতে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত সদস্যদের স্ত্রী, সন্তানও ছুটে এসেছেন অন্যায়ভাবে স্বজনকে হত্যার বিচার চাইতে। তারা বলছেন, জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান থাকাকালীন যারা অনুগত ছিল না, মূলত তাদের সরিয়ে দিতেই বিমান ছিনতাই ও অভ্যুত্থানের নাটক সাজিয়েছেন। জিয়া সেনাপ্রধান থাকাকালীনও অনেকবার অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছিল। মূলত ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে জিয়া নিজেই এসব অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন।
চাকরিচ্যুত ও কারাদন্ডপ্রাপ্তদের পক্ষে ২০ বছর কারাদ-প্রাপ্ত বিমান বাহিনীর কর্পোরাল গাজী গোলাম মাওলা হিরু ও ফাঁসিতে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্তদের পক্ষে সার্জেট সাইদুর রহমানের ছেলে মোঃ কামরুজ্জামান মিঞা লেনিন সাত দফা দাবি উত্থাপন করেন। দাবিগুলো হলো- ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্য যারা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন তাদের নির্দোষ ঘোষণা করা; ওই দিন যারা সামরিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ফাঁসি-কারাদন্ড ও চাকরিচ্যুত হয়েছেন তাদের প্রত্যেককে স্ব-স্ব পদে সর্বোচ্চ র্যাঙ্কে পদোন্নতি দেখিয়ে বর্তমান স্কেলে বেতন-ভাতা ও পেনশনসহ সরকারী সব ধরনের সুযোগ সুবিধা প্রদান করা; ষড়যন্ত্রের শিকার সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের পুনর্বাসিত করার লক্ষ্যে তাদের পোষ্যদের যোগ্যতা অনুসারে সরকারী চাকরিতে নিয়োগ; ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে যেসব মুক্তিযোদ্ধার ফাঁসি হয়েছে তাদের কবর চিহ্নিত করে কবরস্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ; ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্য যাদের ফাঁসি-কারাদন্ড ও চাকরিচ্যুত হয়েছেন তাদের তালিকা প্রকাশ করা; মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু পাকিস্তানী সামরিক জান্তা তাদের পাকিস্তানী বিভিন্ন বন্দীশিবিরে আটকে রেখে নির্যাতন করেছে তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করা এবং জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার।