নিউজ ডেস্ক:
বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের ধকল কাটিয়ে স্বাভাবিক উৎপাদনে ফিরছে পোশাকশিল্প; রপ্তানিও বাড়ছে দিন দিন। এখন নতুন বাজারের সন্ধ্যানে পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে পণ্যের বহুমুখীকরণেও উদ্যোগ নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে নতুন উদ্যমে কাজে যোগ দিয়েছেন শ্রমিকরা। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত পোশাকশিল্পে আবারও প্রাণ ফিরছে। এমনকি বছরের প্রথম সাত মাসে পোশাক রপ্তানিতে প্রধান প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামকে ছাড়িয়ে ফের দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ।
উদ্যোক্তারা বলছেন, ক্রেতা-দেশগুলো ভ্যাকসিন নিশ্চিত করায় জনজীবন স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। মার্কেট, শপিংমলগুলো খুলছে। ক্রেতারা ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন। ফলে পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। বড় ব্র্যান্ডের ক্রেতারাও আগের তুলনায় অর্ডার বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এভাবে ক্রেতারা ঝুঁকলে আগের অবস্থানে ফিরে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না বলেও মনে করছেন তারা। প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের তুলনায় ২০২০-২০২১ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি ৩ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে; স্থানীয় মুদ্রায় যা ২৯ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার (২ লাখ ৬৭ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা)। আগের বছরে (২০১৯-২০ অর্থবছর) রপ্তানি হয়েছে ২৮ বিলিয়ন ডলার, (২ লাখ ৩৮ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা)।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ
আজিম আমাদের সময়কে বলেন, মহামারী করোনা ভাইরাসের মধ্যেও গত অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরেও সেই ধারা অব্যাহত আছে। আমরা প্রচুর অর্ডার পাচ্ছি।
তিনি বলেন, কৃত্রিম ফাইবারে যেতে পারলে ভ্যালু অ্যাড বর্তমানের তুলনায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়ে যাবে। রপ্তানি বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন বাজার ধরতে হলে ফাইবারের পণ্য তৈরি করতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশের পোশাক খাত হুমকির মধ্যে পড়ে। ব্যাপকভাবে রপ্তানি কমতে থাকে। করোনার ধাক্কায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে পোশাক রপ্তানি হয় মাত্র ২৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। এর আগে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ৩৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। করোনায় পোশাক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসায় রপ্তানি কমে যায় ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ। তবে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হতে পারে বলে আশা করছে বিজিএমইএ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপির) তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানিতে আয় ছিল ৩ হাজার ৬১ কোটি ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ দশমিক ২০টাকা ধরে), ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় ২ লাখ ৯০ হাজার ৮১৩ দশমিক ১৬ কোটি টাকা। তবে দেশ করোনা মহামারীতে আক্রান্ত হলে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ কমে হয় ২ হাজার ৭৯৪ কোটি ডলারে (২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৮ দশমিক ৮ কোটি টাকা)। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ৬৭ লাখ ডলার (২ লাখ ৬৮ হাজার ১১ কোটি টাকা) আয় হয়, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি।
চলতি বছরের আগস্ট মাসে নিটওয়্যার ও ওভেন খাতের মধ্যে ওভেন খাত থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ১১৫ কোটি ২৯ লাখ ৪ হাজার টাকা। আর নিটওয়্যার খাত থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ১৬০ কোটি ৪ লাখ ৪ হাজার টাকা। ২০২০ সালের আগস্ট মাসে ওভেন খাত থেকে রপ্তানি আয় হয়েছিল ১১০ কোটি ৩৫ লাখ ২ হাজার টাকা। আর নিটওয়্যার খাত থেকে আয় হয়েছিল ১৩৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
এদিকে চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) পোশাক খাতে ভিয়েতনামের চেয়ে ১ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করেছে বাংলাদেশ। ফলে দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে বাংলাদেশ নিজের অবস্থান ফিরে পেয়েছে- এমনটাই দাবি করেছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।
সংগঠনটি বলছে, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ভিয়েতনাম পোশাক রপ্তানি করেছে ১৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ১৮ দশমিক ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ভিয়েতনামের সাধারণ পরিসংখ্যান কার্যালয়ের (জিএসও) মতে, দেশটি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে টেক্সটাইল ও পোশাক রপ্তানি থেকে ১৮ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল আমাদের সময়কে বলেন, বিশ্বের প্রায় ১৬৩টি দেশে পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। যদিও ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র আমাদের জন্য প্রধান দুটি বাজার। তবে করোনার প্রথম বছরেই আমরা ৬ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হারিয়েছি। এর থেকে উত্তোরণের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পোশাক রপ্তানি খাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এই খাত স্বাভাবিক পর্যায়ে আসার ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে। তবে কারখানাগুলোতে গ্যাসের চাপ অনিয়মিত হওয়ায় উদ্যোক্তারা বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। ফলে উৎপাদন কার্যক্রমও ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিজিএমইএ বলছে, বিগত এক দশকে বিদুতের সংকট অনেকটা কেটে গেছে, তবে ভোল্টেজ ফ্লাকচুয়েশন আছে এবং ঢাকার বাইরে লোডশেডিং হয়। এতে কর্মঘণ্টায় বিঘœ ঘটে।
বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান পণ্যের বহুমুখীকরণ প্রসঙ্গে বলেন, আগে আমরা শুধু কটনের পণ্য উৎপাদন করতাম। এখন নন-কটন উৎপাদনে প্রস্তুতি নিচ্ছি। মেশিনারিজ ও অন্যান্য খাতে আমরা বেশ বিনিয়োগ করছি। এখন দেশের প্রায় প্রতিটি কারখানাতেই নন-কটনের পোশাক উৎপাদন সম্ভব। বিশ্ব বাজার নন-কটনের দখলে। আমাদেরও নন-কটনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। বাজার ধরতে হলে নন-কটনের দিকে ঝুঁকতে হবে।
পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানান- এইচঅ্যান্ডএম, ওয়ালমার্ট, জারা, প্রাইমার্ক, গ্যাপ, নাইকি, জার্মানির অ্যাডিডাস, পুমা, মডার্ন, এস অলিভার, চিবো, স্পিরিট, লিডল, অলডি নর্থ ও সাউথ, বেলোটেক্স, ডেলটেক্স, জলো ফ্যাশন, চিক্যা, আরনস্টিংস ফ্যামিলি, ব্র্যান্ডস ফ্যাশন, জুরি ট্রেক্স, হরিজোনটিসহ অনেক বিখ্যাত ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের কারখানা থেকে পোশাক কিনে থাকে।
বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী মাত্র চার দশক আগে যাত্রা শুরু করে এই শিল্পে এখন তৈরি পোশাকের মোট কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ৩০০টি প্রায়। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য ১ হাজার ৮৭৪টি কারখানা। এ ছাড়াও ১৩৫টি পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে, যার শীর্ষ ১০টির মধ্যে ৭টিই বাংলাদেশের। আরও প্রায় ৫০০টি সবুজ কারখানা যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের কাছে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছে।
আশিরর দশকে চট্টগ্রামের নুরুল কাদের খানের হাত ধরে পোশাকশিল্পের যাত্রা শুরু। ১৩০ প্রশিক্ষণার্থী নিয়ে তার পথ চলা শুরু হয়। ৪০ বছরে এ পোশাকশিল্পে শ্রমিকের সংখ্যা অর্ধ কোটির কাছাকাছি।
বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে পোশাক কারখানায় শ্রমিক ছিল ৪ লাখের মতো। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ লাখ। একইভাবে ২০০২-০৩ থেকে ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ২০ লাখ এবং ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এই শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ লাখে। আর বর্তমানে এই খাতটিতে নারী-পুরুষ মিলিয়ে প্রায় ৪৪ লাখ শ্রমিক কর্মরত। এর মধ্যে বেশির ভাগই (প্রায় ৭০ শতাংশ) নারী শ্রমিক। ৪৪ লাখ শ্রমিকের সঙ্গে তাদের পরিবারের সদস্যও জড়িয়ে গেছে।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসে পড়ে ভবনের পাঁচ পোশাক কারখানার ১ হাজার ১৩৬ শ্রমিক প্রাণ হারান; আহত হন দুই হাজারের বেশি শ্রমিক। এ দুর্ঘটনাকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শিল্পদুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দুর্ঘটনার পর দেশি-বিদেশি ব্যাপক চাপের মুখে পড়ে পোশাক খাত।
কিছুদিনের মধ্যেই প্রধান দুই বাজার ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের দুই জোট অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্স ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে জাতীয় কর্মপরিকল্পনার (এনপিটি) কঠোর নজরদারিতে আসে ছোট-বড় প্রায় সাত হাজার পোশাক কারখানা। শুরু হয় ব্যাপক সংস্কার অভিযান। সব কারখানা ভবনের কাঠামো, অগ্নি ও বৈদ্যুতিক ত্রুটি শনাক্ত করা হয়। সংশোধনের অযোগ্য ত্রুটি থাকা এবং ব্যয়বহুল ব্যাপক সংস্কার কাজে তাল মেলাতে না পারায় অন্তত দুই হাজার কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ক্রেতাদের দুই জোট, সরকার, জাপান সরকারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) কয়েকটি দাতা সংস্থা এবং পোশাক খাতের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর অংশগ্রহণ এবং তত্ত্বাবধানে শুরু হওয়া সংস্কার কার্যক্রম শেষ হয়। দুই জোটের পাঁচ বছরের চুক্তি শেষে আজীবন সংস্কারের ধারাবাহিকতা রক্ষায় সরকার রেমিডিয়েশন কো-অর্ডিনেশন সেল (আরসিসি) গঠন করেছে। অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স, সুশীল সমাজ, মালিক ও শ্রমিক- সবপক্ষের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে আরসিসি গঠন করা হয়েছে। দীর্ঘ ধারাবাহিক এ সংস্কারের ফলে বাংলাদেশ এখন নিরাপদ পোশাক কারখানার বিশ্ব মডেল হিসেবে সম্মান পাচ্ছে। অনেক দেশ এখন বাংলাদেশের সংস্কার মডেল অনুসরণ করতে চায়।