নিউজ ডেস্ক:
আগামী বছরেই তিন স্বপ্নের প্রকল্পের সুফল পাচ্ছে জনগণ। তিন মেগা প্রকল্পেই বদলে যাচ্ছে দেশের চেহারা। বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসছে আমূল পরিবর্তন। পদ্মা সেতু চালু হলে রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুুষের দূরত্ব কমছে। বাড়ছে অর্থনৈতিক যোগাযোগ। মেট্রোরেল চালুতে বাচছে রাজধানীর মানুষের কর্মঘণ্টা। কমছে যানজট। এছাড়া বঙ্গবন্ধু টানেলে চট্টগ্রামের মানুষের জীবনেও আসছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। মূলত পুরো দেশই অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের আধুনিকতার স্পর্শে বদলে যাচ্ছে। সহজ হচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আগামী ২০২২ সালের জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে দেশে চলমান তিনটি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ করে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে। কাদের বলেন, আমি আশা করছি, আগামী বছর ইনশাআল্লাহ তিনটি মেগা প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করতে পারবেন। এর মধ্যে আগামী বছরের জুনে পদ্মা সেতু, এরপর কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল এবং ডিসেম্বরে এমআরটি-৬ প্রকল্পের উদ্বোধন করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
পদ্মা সেতু ॥ আগামী বছরের জুন মাসে চালু হচ্ছে পদ্মা সেতু। ইতোমধ্যে কাজ শেষ হয়েছে ৯৪.২৫ শতাংশ। গত ২৩ আগস্ট সেতুটির সব রোডওয়ে স্ল্যাব বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। মূল সেতুর মোট ২ হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্ল্যাবের সর্বশেষটি বসানো হয়। এখন পিচঢালাই হয়ে গেলেই ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুর সড়কপথ যান চলাচলের উপযোগী হয়ে যাবে। এছাড়া রেল সেতু চালু হলে পদ্মা সেতুর বুক চিরে চলে যাবে ট্রেন। সেজন্য আলাদাভাবে তৈরি করা হচ্ছে পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প। এই সেতু চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমের মানুষের রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে। সেতু চালু হলে ওই এলাকার কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য বদল ঘটবে। এছাড়া দেশের জিডিপির পরিমাণ বাড়বে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। মোংলা বন্দর ও বেনাপোল বন্দরের সঙ্গে রাজধানী ও চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এক কথায় বদলে যাবে গোটা দেশ। বঙ্গবন্ধু সেতু যেভাবে উত্তরের মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলেছে ঠিক একইভাবে পদ্মা সেতুও দক্ষিণ ও পশ্চিমের মানুষকে প্রভাবিত করবে।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকেরা পদ্মা সেতুর অপেক্ষায় রয়েছেন। তাঁরা সেতু চালু হলে সহজে শস্য, সবজি ও মাছ ঢাকায় পাঠাতে পারবেন। উদ্যোক্তারা অপেক্ষায় পুঁজি নিয়ে, কাঁচামাল ও পণ্য আনা-নেয়া সহজ হলে তাঁরা কারখানা করবেন। তরুণরা অপেক্ষায়, তাঁরা চান কাজের খোঁজ। পরিবহন ব্যবসায়ীরা আরও বেশি বাস নামাতে চান। তাঁদের আশা, যোগাযোগ সহজ হলে মানুষের চলাচল বাড়বে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান জানান, সেতু বিভাগের জন্য ২০১০ সালে পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে একটি সমীক্ষা করা হয়। ওই সমীক্ষায় উঠে এসেছিল যে সেতুটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়াবে। এ সমীক্ষায় রেল সংযোগের বিষয়টি ছিল না। পরে যেহেতু রেল যুক্ত হয়েছে, সেহেতু সেতুটি আরও বেশি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কীভাবে সেতুটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তার ব্যাখ্যাও দেন সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, ঢাকা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার। এই বাজারের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াবে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতু তৈরিতে যে ৩১ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হচ্ছে, রেল সংযোগে যে ৩৯ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয় হবে, সেটাও জিডিপিতে প্রভাব ফেলবে। কারণ প্রকল্পের ব্যয়ের টাকা জিডিপিতে যোগ হবে। পরোক্ষভাবে চাহিদা বাড়াবে পণ্য ও সেবার। সেতুটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়াবে।
যমুনার ওপর দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারের এই সেতু উত্তরের জেলাগুলোর সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ সহজ করে। ফলে বগুড়া বা রংপুরের কৃষক সকালে খেত থেকে যে ফুলকপি তোলেন, মধ্যরাতে তা ঢাকায় এসে যায়। রাজশাহীর খামারিদের তাজা রুই মাছ রাজধানীর বাজারে বাজারে বিক্রি হয়।
পদ্মা সেতু চালু হলে উত্তরের মতো ফসলের বাড়তি দাম পাওয়া যাবে বলে মনে করেন দক্ষিণের কৃষকরা। তাঁদের এই আশার দিকটি উঠে এসেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) মাসের এক সমীক্ষায়। এতে মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার ৭৫০ জনের সাক্ষাতকার নেয় আইএমইডি, যাঁদের ৯৫ শতাংশ বলেছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে কৃষিপণ্যের পরিবহন সহজ হবে।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে চালু হচ্ছে মেট্রোরেল ॥ বহুল প্রত্যাশিত মেট্রোরেলের গতি করোনার কারণে কমলেও শনিবার মেট্রোরেলের পরীক্ষামূলক চলাচল শুরু হয়েছে। তবে যাত্রী পরিবহন শুরু করবে আগামী বছরের ডিসেম্বর মাসে। ইতোমধ্যে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ রেল পরিচালনার জন্য জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছে। পরীক্ষামূলক চলাচল শুরু হলেও প্রকল্পটি চালু হতে কিছুটা সময় নেবে। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ৪৩ শতাংশ কাজ হয়েছে। জাপানের সহায়তায় মেট্রোরেল প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে ২০১২ সালের জুলাইয়ে।
আগামীতে মেট্রোরেল চালু হলে রাজধানীর মানুষের দীর্ঘদিনে ভোগান্তির যানজট থেকে রেহাই মিলবে। দ্রুত সময়ে মানুষ নিজের কর্মস্থলে পৌঁছতে পারবে। মানুষের কর্মঘণ্টা বাড়বে। মেট্রোরেলের কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হলে রাজধানীর বাইরে থেকে অফিস আদালতে মানুষের সংখ্যাও বাড়বে। এতে রাজধানীর ওপর চাপ কমবে। পাবলিক গণপরিবহনের নৌরাজ্য কমে আসবে। অর্থাৎ মেট্রোরেল রাজধানীর মানুষের জীবনযাত্রাকে আমূল পাল্টে দেবে।
রফিকুল ইসলাম নামের মিরপুরের এক ব্যাংকার বলেন, দীর্ঘদিন থেকেই মেট্রোরেলের জন্য প্রত্যাশা করে আছি। কারণ বাসে করে মিরপুর থেকে মতিঝিল যেতে সকালে আড়াই ঘণ্টার বেশি সময় লাগছে। অফিসে আসতে সকাল বেলাতেই বাসা থেকে বের হয়ে আসতে হয়। মেট্রোরেল চালু হলে সহজেই মিরপুর থেকে মতিঝিল আসতে পারব। এতে সময় ও অর্থ দুটোই বাঁচবে। আবু তাহের নামের ঢাকা স্টক একচেঞ্জের এক অনুমোদিত প্রতিনিধি জানান, বর্তমানে গোপীবাগ এলাকায় অতিরিক্ত বাসা ভাড়া দিয়ে থাকছি। মেট্রোরেল চালু হলেু দূরে অল্প ভাড়াতে এর চাইতে ভাল বাসায় থাকতে পারব। এটি চালু হলে ঢাকার জীবন আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়ে যাবে।
বঙ্গবন্ধু টানেলের ৭১ ভাগ নির্মাণ কাজ শেষ ॥ সরকারের জন্য অনেক বেশি গর্ব করার মতো প্রকল্প হচ্ছে কর্ণফুলী নদীর নিচের সুড়ঙ্গপথ বঙ্গবন্ধু টানেল। এ ধরনের পথ দেশের ইতিহাসে প্রথম। ইতোমধ্যে টানেলটির কাজ ৭১ শতাংশ শেষ হয়েছে।
পানির তলার সুড়ঙ্গপথটি কক্সবাজারের সঙ্গে চট্টগ্রামের দূরত্ব কমাবে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের পরই এটি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। এই বঙ্গবন্ধু টানেল কক্সবাজারের সঙ্গে চট্টগ্রামের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে। কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের গাড়ি চট্টগ্রাম শহরকে এড়িয়ে সুড়ঙ্গপথ দিয়েই রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে চলাচল করতে পারবে। তাহলে চট্টগ্রাম নগরীর যানজটও অনেকাংশে কমে যাবে। এটি ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মাধ্যমে মাতারবাড়ি পাওয়ার হাব, মহেশখালী গভীর সমুদ্র বন্দর ও টেকনাফ স্থলবন্দরের সঙ্গে যুক্ত হবে। কর্ণফুলী টানেল হয়ে যে সড়ক কক্সবাজার যাবে তা কোন এক সময় মিয়ানমার হয়ে প্রসারিত হবে চীনের কুনমিং সিটি পর্যন্ত।
এদিকে টানেল উদ্বোধনের আগেই এটিকে কেন্দ্র করে ইকোনমিক জোন, কেইপিজেড, কাফকো, সিইউএফএল, বন্দর কার্যক্রম সম্প্রসারণসহ বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ চলছে দক্ষিণ চট্টগ্রামে। ফলে এই টানেলকে ঘিরে বদলে যাচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা। একইসঙ্গে টানেলের সংযোগমুখে নির্মিত হচ্ছে চার লেনদেনের সড়ক। এই সড়কটিরও আশপাশের এলাকার মানুষের জীবনের উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। নওগাঁ দর্পন