নিউজ ডেস্ক:
গত বছর হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর তাকে হত্যার অভিযোগ আনার সমালোচনা করে নুর তার ফেসবুক পেজে লেখেন, সবার মৃত্যু নির্ধারিত। তার মৃত্যুতে অভিযোগ আনা কি শিরক নয়? অথচ এবার সংগঠনের আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যুর জন্য সরকারকে দায়ী করলেন তিনি। পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে প্রথমে তিনি আগের স্ট্যাটাস দেয়ার কথা অস্বীকার করেন, পরে দায় দেন পেজের মডারেটরদের ওপর।
হেফাজতে ইসলামের দুই শীর্ষ নেতার মৃত্যুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
গত সেপ্টেম্বরে শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর তার অনুরাসীরা হত্যার যে অভিযোগ এনেছিলেন, তখন কারও স্বাভাবিক মৃত্যুর পর এ ধরনের অভিযোগ আনা ‘শিরক’ তথা ‘সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার’ শামিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শফীর জীবদ্দশায় হেফাজত সরকারের সঙ্গে দূরত্ব ঘুচিয়ে এনেছিলেন এবং এর অংশ হিসেবে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি দাওরায়ে হাদিস ইসলামিক স্টাডিজের মাস্টার্সের সমমান বলে স্বীকৃতি আসে।
শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতের আমির হন তার একসময়ের ডেপুটি জুনায়েদ বাবুনগরী। গত নভেম্বরে তিনি নেতৃত্ব নেয়ার পর হেফাজত আবার সরকারবিরোধী অবস্থানে ফিরে যায়। দেশ চালাতে হলে তাদের কথামতো চলতে হবে- এমন বক্তব্যও আসে সংগঠনের পক্ষ থেকে। সরকারকে টেনে ফেলে দেয়ার হুমকিও দেয়া হতে থাকে।
বৃহস্পতিবার অকস্মাৎ বাবুনগরীর মৃত্যুর খবর আসে। তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে মারা যান।
আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর দেয়া বক্তব্য থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে নুর এবার অভিযোগ করলেন, বাবুনগরীর মৃত্যুর জন্য দায়ী সরকার।
আল্লামা শফী ও বাবুনগরীর মৃত্যুর পর পরস্পরবিরোধী স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট এরই মধ্যে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। নুরের অবস্থান বদল, তার নিজের মতো করে ধর্মকে ব্যাখ্যা করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা বলে সমালোচনা করছেন তার বিরোধীরা।
নিউজবাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে নুর প্রথমে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেয়ার কথা অস্বীকার করেন। পরে তার পুরোনো স্ট্যাটাস দেখে বলেন, ‘আসলে আমি ওইভাবে এই ফেসবুক পেজ চালাই না।’
আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর নুরের স্ট্যাটাস
চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় গত বছরের ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বরের হাঙ্গামার পরদিন ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান আল্লামা শফী।
মাদ্রাসায় বাবুনগরীর অনুসারীরা দুই দিন হেফাজতের আমিরের কক্ষে ভাঙচুর চালিয়ে তাকে নানা হুমকি-ধমকি দিয়েছিলেন বলে তার স্বজনরা অভিযোগ করেছেন।
তার এক নাতনির লেখা পুস্তিকায় বলা হয়েছে, আল্লামা শফীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা ছাড়াও তাকে চিকিৎসায় বাধা দেয়া হয়েছে। অক্সিজেনের নল কেটে ফেলা হয়েছে। এমনকি অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে দেয়া হয়নি। আর এ কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।
এই মৃত্যুর পর বাবুনগরীর অনুসারীদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়েছে। আর পুলিশের তদন্ত সংস্থা পিবিআই তদন্ত করে ‘অপরাধজনিত নরহত্যার’ অভিযোগ এনে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এখনও এই মামলার বিচার শুরু হয়নি।
আল্লামা শফীর স্বজন ও অনুসারীরা এই ঘটনায় বাবুনগরী ও তার অনুসারীদের দায়ী করে আসছেন। কিন্তু সে সময় এই অভিযোগ আনায় ব্যাপক সমালোচনা করেন নুর।
গত ২০ সেপ্টেম্বর নুর তার ফেসবুক পেজে লেখেন, “যেখানে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে বলেছেন,
‘প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’
-সুরা আল-ইমরান, আয়াত: ১৮৫।
সেখানে আল্লামা শাহ আহমদ শফী হজুরের মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করা কি শিরক নয়?
অথচ সরকারের একদল দালাল তাই করে যাচ্ছে।
মহান আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন,
আলেমে দ্বীন আল্লামা শাহ আহমদ শফী হুজুরকে বেহেশত নসিব করুন।’
বাবুনগরীর মৃত্যুতে পাল্টে গেল বক্তব্য
বৃহস্পতিবার সকালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন বাবুনগরী। নেয়া হয় হাসপাতালে। দুপুরে তার মৃত্যু হয়। চিকিৎসকের ধারণা, তার মৃত্যু হয়েছে স্ট্রোকের কারণে।
শফীর মৃত্যুতে হত্যার অভিযোগ আনাকে ‘শিরক’ আখ্যা দেয়া নুর এবার নিজেই আনলেন একই ধরনের অভিযোগ।
এবার তিনি লেখলেন, ‘বাবুনগরী হুজুরের মৃত্যুর দায় সরকার এড়াতে পারে না।
‘মোদিবিরোধী আন্দোলনে গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনায় ছাত্রলীগ, যুবলীগের তাণ্ডবের দায় চাপিয়ে হেফাজতের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার, সরকার কর্তৃক অব্যাহত অমানবিক চাপ ও গোয়েন্দা সংস্থার হুমকি-ধমকিতে মানসিক চাপে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন।
‘শেষ পর্যন্ত দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।’
(নিউজবাংলার বানান রীতি ও বানানের ভুল সংশোধন করা হয়েছে)
প্রথমে নুরের অস্বীকার, পরে স্বীকার
আল্লামা শফী ও বাবুনগরীর মৃত্যুতে দুই ধরনের বক্তব্য দেয়ার বিষয়ে জানতে নুরের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিউজবাংলা। প্রথমে অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমার নামে অনেকগুলো ফেসবুক পেজ আছে। বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিয়ে আমার নামে চালিয়ে দেয়া হয়। শফী হুজুরের স্ট্যাটাসটি এক বছর আগের কথা তো, ওইটা আমি বলতে পারছি না। ওগুলো এডিট হতে পারে। আমার নামে অনেকগুলো ফেসবুক পেইজ আছে। এ জন্য আমি শাহবাগ থানায় জিডিও করছি।
‘সেই নামে অনেক ভুয়া পেজ থাকতে পারে। এগুলো এডিট করা হতে পারে বলেই আমার ধারণা। এক বছর আগের ঘটনা, এগুলো নিয়ে এখন আমাদের সমালোচনা করা ঠিক হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘শফী হুজুরকে নিয়ে ওইটা আমার বক্তব্য না। তবে বাবুনগরীকে আমি যে বক্তব্য দিয়েছি এটা আপনাকে আমি শিওর করলাম। আপনি সেই ফেসবুক পেজের লিংকটা পাঠান।‘
পরে নিজের সেই পেজের লিংকটি পাঠালে পাল্টে যায় নুরের বক্তব্য। বলেন, ‘এই ফেসবুক পেজটা আমি ওইভাবে চালাই না।’
ওইভাবে বলতে কোনভাবে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমার আরেকটা পেজ আছে।’
ওইভাবে না চালালেও এই পেজে গত ২৪ ঘণ্টায় পোস্ট দেখা গেছে পাঁচটি। এর মধ্যে একটি পোস্ট দেয়া হয় গত রাতে ১০টার দিকে। দ্বিতীয় পোস্টটি দেয়া হয় বেলা সাড়ে ৩টার দিকে।
তৃতীয় ও চতুর্থ পোস্টটি দেয়া হয় বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে দেয়া হয় আরও একটি পোস্ট।
এই পর্যায়ে এসে নুর দোষ চাপান তার পেজের মডারেটর ও এডিটরদের ওপর। বলেন, ‘ওইটা বোধহয় (আল্লামা শফীকে নিয়ে) আমার স্ট্যাটাস না। আর আমার পেজে অনেক এডিটর থাকে। কেউ কখনও দিয়েছে কি না, এটাও আমি শিওর না। এমন স্ট্যাটাস দেয়ার কথা না।’