নিউজ ডেস্ক:
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে বিচ্ছিন্ন (ব্রেক্সিট কার্যকর) হয়েছে গত ১ জানুয়ারি। ইইউতে যুক্ত থাকার সময় দেশটির বাজারে ৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানিতে এভরিথিং বাট আর্মস (ইভিএ) সুবিধা পেত বাংলাদেশ। বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর এই বাজারে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধার ভবিষ্যৎ কী হবে, সেগুলো বহাল থাকবে, না নতুন কোনো উপায়ে যুক্তরাজ্য কোনো জিএসপি স্কিম চালু করবে, তা নিয়ে বাংলাদেশের ছিল নানা জল্পনা-কল্পনা।
অবশেষে এর অবসান হয়েছে। গত জুলাই মাসে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশকেও চিঠি দিয়ে যুক্তরাজ্য জানিয়েছে, তারাও ইইউর মতো জিএসপি স্কিম চালু করতে যাচ্ছে। শর্ত পূরণের চাহিদাপত্র দিয়ে সক্ষমতা জানাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে পাঠানো হয়েছে এ চিঠি। ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য অগ্রাধিকারমূলক এ সুবিধা কার্যকর করবে যুক্তরাজ্য।
তবে যুক্তরাজ্যের এই জিএসপি স্কিমের কাঠামো হবে ইইউ থেকে কিছুটা ভিন্ন। তারা ব্রেক্সিট-পরবর্তী নিজস্ব জিএসপি স্কিম প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। তিন ক্যাটাগরিতে জিএসপি স্কিম চালু করবে যুক্তরাজ্য। এগুলো হলো লিস্ট ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রি ফ্রেমওয়ার্ক, জেনারেল ফ্রেমওয়ার্ক ও ইনহেন্সড ফ্রেমওয়ার্ক।
লিস্ট ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রি ফ্রেমওয়ার্ক ক্যাটাগরির আওতায় থাকা দেশগুলোর জন্য ইভিএর মতো অস্ত্র বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার সুযোগ থাকবে।
জেনারেল ফ্রেমওয়ার্ক ক্যাটাগরির আওতায় থাকবে নিম্ন আয়ের এবং নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশগুলো, যারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের ২৭ শর্ত পূরণের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই ক্যাটাগরিকে স্ট্যান্ডার্ড জিএসপির সঙ্গে তুলনা করা হবে।
জিএসপি প্লাসের সুবিধা দিয়ে চালু করা হবে ইনহেন্সড ফ্রেমওয়ার্ক স্কিম। এ ক্যাটাগরির আওতায় যেসব দেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের অপেক্ষায় রয়েছে, তারা তাদের প্রোডাক্ট লাইনের তিন ভাগের দুই ভাগ পাবে শুল্কমুক্ত সুবিধায়।
অবশ্য এই সুবিধা পেতে থাকছে বাধ্যবাধকতা। কারণ, ইনহেন্সড ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় কোনো পণ্য নির্দিষ্ট হারের অতিরিক্ত রপ্তানি করলে শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল করে ‘প্রোডাক্ট গ্রেজুয়েশন’-এর বিধান রাখতে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য।
যদি কোনো দেশ মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার লঙ্ঘন করে, অ্যান্টি টেররিজম ও মানি লন্ডারিং বিষয়ে আন্তর্জাতিক কনভেনশন লঙ্ঘন করে এবং ইউএন সিঙ্গেল কনভেনশন অন নেরোটিক ড্রাগস ভায়লেশন ও ইলিসিট ট্রেড প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেই দেশ যুক্তরাজ্যের এ সুবিধা আর পাবে না। পুনরায় এ পেতে হলে এসব শর্ত পূরণ করতে হবে।
এ পরিস্থিতিতে ইউকে জিএসপির সুযোগ পেতে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে সেটি এখনও স্পষ্ট নয়। তবে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ পর্যায়ে থাকার কারণে বাংলাদেশ ইনহেন্সড ফ্রেমওয়ার্ক ক্যাটাগরিতেই পড়বে।
অবশ্য এই ক্যাটাগরিতে পড়লেও ইউকের যেসব শর্ত আছে বাংলাদেশের জন্য সেসব সঠিকভাবে মেনে চলা খুব কঠিন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পরের তিন বছর জিএসপি সুবিধা বহাল রাখার বিষয়ে মৌখিকভাবে ঢাকাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে লন্ডন। ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনারও এ বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়েছেন। এখন সেটাই একমাত্র আশা ও দর-কষাকষির সুযোগ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
জানা গেছে, যুক্তরাজ্যের পাঠানো এ চিঠির ভিত্তিতে ইতোমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের অবস্থানপত্র তৈরির কাজ শুরু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত সোমবার মন্ত্রণালয়ে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে আন্তমন্ত্রণালয় সভা হয়। অবশ্য সভা থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি বাংলাদেশ। আরেকটি সভা করে তৈরি করা হবে বাংলাদেশের অবস্থানপত্র, যা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই চিঠি দিয়ে জানানো হবে যুক্তরাজ্যকে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. হাফিজুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই অবস্থানপত্র পাঠাবে। সেখানে কিছু বিষয় শিথিল করতে যুক্তরাজ্যকে অনুরোধ জানানো হবে।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার। আমাদের উচিত হবে ইউকে জিএসপি ফ্রেমওয়ার্কের সুযোগ নেয়া। কিন্তু এ সুযোগ পেতে হলে তাদের যে রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন আছে, তা অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে। সেটি মানতে হলে আমাদের সক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া উপায় থাকবে না।’
বাংলাদেশের এই মুহূর্তে করণীয় কী, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাজ্য যদি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) রুলস-রেগুলেশনের বাইরে অতিরিক্ত কিছু চাপিয়ে দেয়, তাহলে দর-কষাকষির সুযোগ থাকবে। বাংলাদেশের উচিত দর-কষাকষি করে তা কিছুটা শিথিলের চেষ্টা করা।
‘কিন্তু মনে রাখা দরকার, শুধু ইউকে জিএসপি নয়, ভবিষ্যতে ইইউ জিএসপিও রিফর্ম হবে। সেখানেও জিএসপি প্লাসের ক্লাবে ঢুকতে হবে বাংলাদেশকে। অর্থাৎ যেখানেই যাক না কেন, বাণিজ্য করতে হলে তাদের চাহিদাপত্র অনুযায়ী সক্ষমতা বাড়াতেই হবে।’
ইউকে জিএসপি স্কিমের পাবলিক ডকুমেন্ট প্রোডাক্ট বা গুডস গ্র্যাজুয়েশন বিষয়ে বলা হয়েছে, সরকার প্রতি তিন বছর পর গ্র্যাজুয়েশন পণ্যের তালিকা পর্যালোচনা করবে।
এ ক্ষেত্রে আমদানির অনুপাত ৪৭.২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেলে টেক্সটাইল, পোশাক এবং পোশাকসামগ্রীর জন্য গ্র্যাজুয়েশন প্রযোজ্য। অন্যান্য সব পণ্যের ক্ষেত্রে গ্র্যাজুয়েশনের সাধারণ সীমা ৫৭ শতাংশ পর্যন্ত প্রযোজ্য। জীবিত উদ্ভিদ এবং কৃষিকাজের পণ্য, উদ্ভিজ্জ পণ্য, প্রাণী বা উদ্ভিজ্জ তেল, চর্বি ও মোম এবং খনিজদ্রব্যে গ্র্যাজুয়েশন প্রযোজ্য হবে যখন আমদানি অনুপাত ১৭.৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।
পণ্য গ্র্যাজুয়েশন মূল্যায়ন করার পরে নির্দিষ্ট আমদানিতে শুল্কের অগ্রাধিকার হার স্থগিত করা হবে। এ আমদানি পণ্যগুলো অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক বলে মনে করা হবে, যা যুক্তরাজ্যের বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আর প্রযোজ্য হবে না।