নিউজ ডেস্ক:
২০২০-২১ অর্থবছর শেষে বিনিয়োগ বাড়ার আরও দুটি উপাদান শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে যথাক্রমে ২১ দশমিক ১৩ এবং ২০ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও দেশে বিনিয়োগ বাড়ার একটা ইঙ্গিত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত অর্থবছরের শেষ দিকে এসে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়ছে। ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা কলকারখানা স্থাপনে আগের চেয়ে বেশি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলছেন।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধির একটা সুষ্পষ্ট আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কারখানা সম্প্রসারণ হোক অথবা নতুন কারখানা স্থাপন হোক, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বৃদ্ধির এটাই হলো ইঙ্গিত।
সবমিলিয়ে দেশে বিনিয়োগ বাড়ার একটি ‘সুবাতাস’ বইতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরে (২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন) বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান উপাদান মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানির জন্য ৫৭০ কোটি ২৬ লাখ (৫.৭০ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। এই অঙ্ক আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি।
অথচ অর্থবছরের ১০ মাস পর্যন্ত (জুলাই-এপ্রিল) মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ কম ছিল।
মে মাসেই সে চিত্র পাল্টে গিয়ে ১৬ দশমিক ৭২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। অর্থবছর শেষ হয় ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে।
তথ্যে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য ৬ হাজার ৭০৩ কোটি ৭৪ লাখ (৬৭.০৩ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খোলা হয়েছে; যা ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে ১৯ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই পণ্য আমদানির জন্য এক অর্থবছরে এতো বেশি বিদেশি মুদ্রার এলসি খোলা হয়নি।
মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ৫ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের যে এলসি খোলা হয়েছে, সেটাও রেকর্ড। ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির জন্য আগের কোনো বছরেরই এতো ডলারের এলসি খোলেননি বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা।
২০১৯-২০ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ কমেছিল ২০ শতাংশের মতো।
২০২০-২১ অর্থবছর শেষে বিনিয়োগ বাড়ার আরও দুটি উপাদান শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে যথাক্রমে ২১ দশমিক ১৩ এবং ২০ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
তবে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি খুব একটা বাড়েনি; সেটা হয়েছে ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। তার আগের বছরে (২০১৮-১৯) ছিল আরও বেশি ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ।
মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ২০০৭-০৮ মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক হচ্ছে ক্যাপিটাল মেশিনারি। গত দেড় বছর ধরে দেশে করোনা মহামারি চলছে। এই মহামারির সবাই জীবন বাঁচাতেই বেশি ব্যস্ত ছিল। নতুন বিনিয়োগ-ব্যবসা বাণিজ্য-উৎপাদন নিয়ে খুব একটা ভাবেননি শিল্পোদ্যোক্তারা।
‘কেননা, শুধু বাংলাদেশ নয়; গোটা বিশ্বই মহামারির কবলে তছতছ হয়ে গিয়েছিল। এখন অবশ্য, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সে সব দেশের মানুষ আগের মতো পণ্য কেনা শুরু করেছে। সে সব পণ্যের চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখেই বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগের ছক আঁকছেন। আর সে কারণেই ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি বাড়িয়ে দিয়েছেন।’
‘এটা আমাদের অর্থনীতির জন্য খুবই ভালো’ মন্তব্য করে আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘দেরিতে হলেও বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও টিকাদানে গতি এসেছে। সবার মধ্যে ধীরে ধীরে সাহস সঞ্চার হচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন, একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষকে টিকায় আওতায় আনা গেলে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
‘সবকিছু হিসাব-নিকাশ করে ছোট-বড় সব উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছেন। আর এ সব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা এখন যে উদীয়মান অর্থনীতিতে আছি, তাতে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে জিডিপির কমপক্ষে ৩৬-৩৭ শতাংশ বিনিয়োগ পেতে হবে। বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের বিনিয়োগ একই জায়গায় আটকে ছিল; ৩১-৩২ শতাংশ। কোভিডের কারণে তা ৩০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। যে করেই হোক বিনিয়োগ আমাদের বাড়াতেই হবে।’
মির্জ্জা আজিজ বলেন, বিনিয়োগের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বেশ কয়েক বছল ধরে দেশে সেই স্থিতিশীলতা আছে। মহামারি সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। এখন বিনিয়োগ বাড়াতে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে সরকার ও উদ্যোক্তাদের কাজ করতে হবে।
‘একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, সংকটের সময় অনেক সম্ভাবনাও উঁকি দেয়। এখন এই পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে কোনো পণ্যের চাহিদা বেশি, নতুন কোনো পণ্যের বাজার সৃষ্টি হয়েছে, এসব বিষয় ভালোভাবে দেখেশুনে বিনিয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। দেশি বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না, এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই সরকার ও উদ্যোক্তাদের একযোগে কাজ করতে হবে।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করে উদ্যোক্তারা সাধারণত নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন বা কারখানার সম্প্রসারণ করে থাকেন। অর্থাৎ শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়ে। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসে।
তিনি বলেন, ‘সার্বিক আমদানি বৃদ্ধির সঙ্গে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়া সত্যিই ভালো দিক। এটা যদি অব্যাহত থাকে, মহামারির ধকল দ্রুত কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে।’
‘অর্থনীতি পড়ে আমরা জেনেছি, আমদানি বাড়া মানে বিনিয়োগ বাড়া। আর বিনিয়োগ বাড়া মানে কর্মসংস্থান বাড়া; অর্থনীতির গতি সঞ্চার হওয়া। প্রত্যাশা করছি, সেটাই যাতে হয়।’
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো থেকে এখন আমরা প্রচুর অর্ডার পাচ্ছি। প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। আগামী দিনগুলাতে আমাদের জন্য সুদিন মনে হচ্ছে। যে সব উদ্যোক্তা এতোদিন অপেক্ষা করছিলেন, কি হবে, কি হবে…? তারা এখন নতুন ছক কষে, নতুন উদ্যোগে মাঠে নেমেছেন। সে কারণেই অন্য সব পণ্যের সঙ্গে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানিও বাড়ছে।’
‘আমরা যদি দেশে করোনাটাকে দ্রুততর সময়ের মধ্যে মোকাবিলা করে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে পারি, তাহলে মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে পারব।’
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ নিউজবাংলাকে বলেন, সরকার এক লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল, তার বেশিরভাগ বড় উদ্যোক্তারা পেয়েছে। যারা করোনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেই ছোট-মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তারা কিন্তু বঞ্চিত হয়েছে। এখন নতুন করে তাদের সহায়তা দিতে হবে।
‘মনে রাখতে হবে, ছোট-মাঝারি শিল্পগুলো ঘুরে না দাঁড়ালে বড় বড় শিল্পগুলোও ধাক্কা সামলে উঠতে পারবে না। তাই এখন ছোটরা যাতে ধাক্কা সামলে উঠে দাঁড়াতে পারে, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই বিনিয়োগ করতে হবে।
‘পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থতির কারণে চায়না ও ভিয়েতনামের তৈরি পোশাকের অর্ডার এখন বাংলাদেশে আসছে। সে সুযোগগুলো ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে আমাদের রপ্তানি আয় আরও বাড়বে। এই দুই দেশ থেকে অন্য কোনো পণ্যের বাজার বাংলাদেশে নিয়ে আসা যায় কি না, সেটাও বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগ পরিকল্পনা সাজাতে হবে।’