নিউজ ডেস্ক:
মার্কিন মুলুকের নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে ঢুকলে যে কারও মনে হতে পারে বাংলাদেশে এসেছে। সারি সারি বাংলা সাইনবোর্ড চোখে পড়বে। কান পাতলেই শোনা যাবে বাংলায় কথাবার্তা। এখানে পুরোপুরি বাংলা ভাষায় করা যাবে সব কাজ। কেনাকাটা থেকে শুরু করে চিকিৎসা- সবই করা যাবে বাংলা ভাষায়। একবারও ভিন্ন কোনো ভাষায় কথা বলার প্রয়োজন হবে না। এখানে বেশ কয়েকটি সড়ক পুরোপুরিই বাংলাদেশিদের দখলে। এখানকার ভবন, স্থাপনা, দোকানপাটের অনেকগুলোই বাংলাদেশিদের তত্ত্বাবধানে চলে। জ্যাকসন হাইটসকে অনেকে নিউইয়র্কের গুলিস্তানও বলে। ছুটির দিনে রাস্তায় হাঁটলে যার সঙ্গেই ধাক্কা লাগবে, সে-ই কথা বলবে বাংলায়।
শুধু নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস নয়, এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় লস অ্যাঞ্জেলেসের থার্ড স্ট্রিট ও আলেকজান্দ্রিয়া এভিনিউয়ের মাঝামাঝি এলাকাটিতে গেলেও চোখে পড়ে বাংলা ভাষার বাংলাবাজার, স্বদেশ, দেশি, আলাদিন নানা নামের সাইনবোর্ড। প্রায় এক দশক আগে এই জায়গাটির নাম ‘লিটল বাংলাদেশ’ নামে স্বীকৃতি দিয়েছে লস অ্যাঞ্জেলেস শহর কর্তৃপক্ষ। লিটল বাংলাদেশকে লস অ্যাঞ্জেলেসের বুকে এক টুকরো বাংলাদেশ বললে অত্যুক্তি মনে হবে না কারও। কানাডার টরেন্টোর ডানফোর্ড এভিনিউতেও দেখা মেলে বাংলা সাইনবোর্ডের। এখানকার বাংলাদেশ সেন্টারও বাংলা চর্চার অন্যতম ক্ষেত্র। ‘এসো হে বৈশাখ’ গানে গানে বর্ষবরণ থেকে শুরু করে স্বাধীনতা-বিজয় দিবসের সব বাংলার অনুষ্ঠান হয় এখানে। শিঙাড়া, সন্দেশ, ঝালমুড়ি, চটপটি সবই থাকে এখানে।
যুক্তরাজ্যের পূর্ব লন্ডনের ব্রিক লেন এবং আশপাশের এলাকা বেশ কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশি অভিবাসী অধ্যুষিত। অনেক দিন ধরেই এলাকাটির আনুষ্ঠানিক নাম বাংলাটাউন। এখানকার সড়কগুলোর নামও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় লেখা। ধীরে ধীরে কমতে থাকলেও এখনো বাংলাভাষীদের দোকানপাট এখানে যথেষ্ট। অবশ্য লন্ডনের তিনটি ডিস্ট্রিক- ক্যামডেন, নিউহ্যাম এবং টাওয়ার হ্যামলেটসে বাংলা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবহৃত ভাষা। সিঙ্গাপুরের মোস্তফা সেন্টারের কাছে রয়েছে মিনি বাংলাদেশ। এখানে পান-বিড়ি, ফ্ল্যাক্সিলোড, ইন্টারনেট, সেলুন, বিকাশ- কী লেখা নেই রাস্তার পাশের দোকানের বাংলা সাইনবোর্ডে। রয়েছে ঢাকা রেস্টুরেন্ট, হিরাঝিল রেস্টুরেন্ট এবং কম খরচে থাকা-খাওয়ার নানান ধরনের বাংলা ভাষার সাইনবোর্ড।
শুধু এসব শহরেই নয়, একই রকম এলাকা আছে সৌদি আরবের জেদ্দা শহরের মুছনা, গুলিল, পবিত্র মক্কা-মদিনা, দুবাই, বাহরাইন, ওমান, কাতার, ইতালির রোম, স্পেনের মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, জার্মানির বার্লিন, গ্রিসের এথেন্স, জাপানের টোকিও, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন, জোহানেসবার্গ, থাইল্যান্ডের ব্যাংককের সুকুমভিতসহ বিভিন্ন দেশে। এসব বড় বড় শহরের এক বা একাধিক এলাকায় বাঙালিপাড়া, বাঙালিবাজার বা বাঙালিদের মিলন ক্ষেত্র গড়ে তুলতে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন।
নিউইয়র্ক, সিডনি, লন্ডন, প্যারিসসহ বিভিন্ন শহরে এখন বেশ কয়েকটি বাংলা কাগজ বের হয়, বাংলা বইয়ের দোকানও আছে এসব শহরে। নিউইয়র্কে আধা ডজন বাংলা কমিউনিটি টেলিভিশনও চালু হয়েছে। এই শহরগুলোসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ শহর, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপসহ প্রবাসে ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানো সম্ভব শুধু বাংলায় কথা বলে। বিশ্বের বিভিন্ন কোনায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি বাংলা ভাষার বিষয়ে বিশ্বব্যাপী আগ্রহ তৈরির সোপান হিসেবে কাজ করছেন। তাদের আগ্রহেই বিভিন্ন শহরে তৈরি হয়েছে ভাষা শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনারও। গবেষকরা বলছেন, মূলত ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তিলাভ করেছে বেশি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পন্ডিত-গবেষকদের মাঝে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে নতুন আগ্রহ দেখা দিয়েছে। ফলে বিশ্বের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু হয়েছে বা হতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ সবচেয়ে পুরনো। এ ছাড়া শিকাগো, ইন্ডিয়ানা, মেলবোর্ন, হাইডেলবার্গ, প্যারিস, টরেন্টো, অটোয়া, এডিনবার্গ, সরবোর্ন, মস্কো, প্যাট্রিস লুলুম্বা, করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষা দেওয়ার জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে। পিকিং, প্রাগ, ওয়ারশ, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ কার্যক্রম শুরু করেছে।
জানা যায়, এক দশক ধরে বাংলাদেশে ও বিদেশে থাকা বাংলাদেশিদের মধ্যে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করার জোরালো দাবি আছে। ইংরেজি, চাইনিজ মান্দারিন, রুশ, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ ও আরবির পর বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করার উদ্যোগও শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থানও বেশ পাকাপাকি। কিন্তু জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হিসেবে যুক্ত হলে অন্য ভাষায় অনুবাদের সমুদয় অর্থ দিতে হবে বাংলাদেশকে। এ কারণে এ বিষয়ে ধীরে চলো নীতিতে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু প্রবাসী বাংলাদেশি ও বাংলাদেশি বংশো™ভূতদের বদৌলতে এই বিশ্বে বাংলার মর্যাদা বাড়ছে দিন দিন।