নিউজ ডেস্ক:
গৃহহীন মানুষদের বাড়ি উপহারের মতো মুজিববর্ষে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য আরও একটি বড় উপহার দিতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে লাখো মুসল্লির জন্য উদ্বোধন করবেন মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। প্রতি উপজেলায় একটি করে মডেল মসজিদ নির্মাণ চলছে যার মধ্যে এ বছরই ১৭০টি উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। একসঙ্গে এত মসজিদ নির্মাণের ঘটনা দেশে এই প্রথম। ধর্ম মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা ও ইসলামি চিন্তাবিদরা মনে করছেন, এসব মসজিদে প্রতিদিন কয়েক লাখ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন এবং এতে ইসলাম নিয়ে বিভ্রান্তি ও ধর্মের অপব্যাখ্যা দূর হওয়ার পাশাপাশি প্রকৃত ইসলামী মূল্যবোধের প্রসার ও শক্তিশালী ইসলামী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে উঠবে।
জানা গেছে, সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয়ের আট হাজার ৭২২ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন’ কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। মুজিববর্ষে আগামী এপ্রিল মাসের পর যে কোন দিন মডেল মসজিদগুলো উদ্বেধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একাধিক তথ্যে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতি জেলা ও উপজেলায় একটি করে উন্নত মসজিদ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ছিল। সেই প্রতিশ্রুতির আলোকে সরকারী অর্থায়নে মসজিদগুলো নির্মিত হচ্ছে। সম্প্রতি সরজমিনে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় দেখা গেছে প্রায় শতভাগ কাজ শেষ পর্যায়ে। যা একটু বাকি আছে চলতি মাস বা মার্চের মধ্যে শেষ হবে বলেও জানা যায়। রংপুর জেলা শহরে নির্মাণাধীন মডেল মসজিদে দেখা যায় কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এক মাসের মধ্যে বাকি কাজ শেষ হবে বলেও আশা করা হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ সদরে নির্মাণাধীন মডেল মসজিদের কাজ এ মাসের মধ্যেই শেষ হচ্ছে বলে জানান নির্বাহী প্রকৌশলী এবিএম হুমায়ুন কবীর।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, স্বাধীনতার পর দেশে একসঙ্গে এত মসজিদ নির্মাণের ঘটনা এটিই প্রথম। এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি সাহসী পদক্ষেপ ও ধর্মের প্রতি ভালবাসার প্রমাণ। প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোঃ নজিবর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, মুজিববর্ষে আমরা ১৭০টি মসজিদ উদ্বোধন করতে পারব। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সময় সাপেক্ষে ৩০ এপ্রিলের পর যে কোন দিন প্রথম পর্যায়ে ৫০টি উদ্বোধন করবেন। বাকি ১২০টি চলতি বছরেই উদ্বোধন হবে। এছাড়াও এরপর যেগুলো থাকবে সেসব মসজিদের কাজও দ্রুত এগিয়ে চলছে। প্রকল্প পরিচালক বলেন, পদ্মা সেতুর পর এই প্রকল্পটির ব্যয় ৮৭২২ কোটি টাকা যা সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। প্রধানমন্ত্রীর সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে বাস্তবায়নের পথে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পে ভৌত অগ্রগতি ৩২ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ১২ শতাংশ।
সরজমিনে রংপুর সদরে দেখা গেছে, মসজিদের ভেতরের কাজ শেষ। বাইরের কাজ চলছে। এরপর রঙের কাজ হবে। নির্মাণাধীন মসজিদ দেখতেই প্রতিনিয়ত ভিড় করেন শহরের বিভিন্ন মুসল্লি। অপেক্ষার প্রহর গুনছেন এমন দৃষ্টিনন্দন মসজিদে কবে দু-রাকাত নামাজা আদায় করবেন। শহরের মুসল্লি ইমরুল কায়েস বলেন, আমার শহরেই বাসা। প্রতিদিন একবার করে আসি, কাজ চলছে দেখি। অপেক্ষা করছি আল্লাহ হায়াত রাখলে এমন সুন্দর মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারব ইনশাল্লাহ। ইসলামিক ফাউন্ডেশন রংপুর কার্যালয়ের মাস্টার ট্রেনার মাওলানা দেলোয়ার হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, শুধু নামাজ আদায়ই নয় এখানে ইসলামের নানা গবেষণা হবে। ইসলাম নিয়ে বিভ্রান্তি দূর হবে, অপব্যাখ্যা দূর হবে। রংপুর মেডিক্যাল মোড় জামে মসজিদের খতিব হাফেজ মাও. আনোয়ারুল হক শাহ জনকণ্ঠকে বলেন, এতটুকু আশা আমরাও করিনি। প্রধানমন্ত্রীর এমন উদ্যোগে চমকে উঠেছি। মহান আল্লাহ উনাকে (প্রধানমন্ত্রী) আরও ভাল ভাল কাজ করার তৌফিক দিন। মসজিদের ওই খতিব আরও বলেন, ইসলাম প্রচার প্রসারে এই মসজিদগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও মানুষ হজ বিষয়ক প্রশিক্ষণ পাবে। এছাড়াও সিরাজগঞ্জ সদরে অবস্থিত মসজিদটি নিয়ে জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহমেদ বলেন, একটি আধুনিক ইসলামী সেন্টারে যা থাকে সবই থাকছে এসব মডেল মসজিদে। নামাজ আদায়, প্রশিক্ষণ, ডরমেটরি সবই থাকবে এসব মসজিদে।
রংপুর বিভাগের দিনাজপুরের খানসামা ও বিরল, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, পঞ্চগড় সদর ও দেবীগঞ্জ, রংপুরের জেলা ও উপজেলা সদর, মিঠাপুকুর, পীরগঞ্জ ও বদরগঞ্জ এবং ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার মডেল মসজিদের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। দেশের অন্য মসজিদের কাজও চলছে দ্রুত।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সুখী, সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতি জেলা ও উপজেলায় একটি করে উন্নত মসজিদ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রতি জেলা ও উপজেলায় একটি করে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সংস্কৃতি কেন্দ্র স্থাপন (১ম সংশোধিত) প্রকল্প ৮ হাজার ৭২২ কেটি টাকা ব্যয়ে অনুমোদন দেয়া হয়।
২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে বাস্তবায়নে অনুমোদিত হলেও সৌদি অর্থায়ন নিয়ে নানা জটিলতার কারণে ২০১৮ সালে সরকারী অর্থায়নে সংশোধিত প্রকল্পটি শুরু হয় যা চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মেয়াদ রয়েছে। তবে প্রকল্পে পরিচালক জানিয়েছেন ইতোমধ্যেই সময় বাড়ানোর আবেদন ধর্ম মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয়েছে সেখান থেকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সংশোধিত অনুমোদিত প্রকল্পের নক্সা অনুযায়ী মডেল মসজিদের জন্য ৪০ শতাংশ জায়গার প্রয়োজন। জেলা পর্যায়ে ৪ তলা ও উপজেলার জন্য ৩ তলা এবং উপকূলীয় এলাকায় ৪ তলা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মাণের চলছে। চারতলা মসজিদে একসঙ্গে এক হাজার দুই শ’ এবং উপজেলা পর্যায়ে তিনতলা মসজিদে একসঙ্গে নয় শ’ মুসল্লির নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা থাকবে। নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা ছাড়াও ইসলামী লাইব্রেরি, ইমাম ট্রেনিং সেন্টার, ইসলামী গবেষণা, হেফজখানা, মরদেহ গোসল, হজ নিবন্ধন, অটিজম কর্ণার, শিশু ও গণশিক্ষা, ইমাম- মুয়াজ্জিনের আবাসন, অতিথিশালাসহ ১৪ ধরনের সুবিধা থাকবে পূর্ণাঙ্গ এই মসজিদসহ ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এসব মসজিদে প্রায় পাঁচ লাখ পুরুষ ও ৩২ হাজার নারী একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন। লাইব্রেরিতে ৩৪ হাজার পাঠক একসঙ্গে কোরান ও ইসলামিক বই পড়ার পাশাপাশি প্রায় সাত হাজার জনের জন্য থাকবে ইসলামিক গবেষণার সুযোগ। মসজিদগুলোতে প্রতি বছর ১৪ হাজার হাফেজ তৈরির ব্যবস্থা থাকবে। প্রাথমিক শিক্ষা পাবে পৌনে দুই লাখ শিশু। সর্বোপরি ইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে ইসলামী মূল্যবোধ বিনির্মাণে এক একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে উঠবে এসব মসজিদ। ইমাম-মুয়াজ্জিনের আবাসনসহ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অফিসের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
তিন ক্যাটাগরিতে মসজিদগুলো নির্মিত হচ্ছে। ‘এ’ ক্যাটাগরিতে ৭৯টি চারতলা বিশিষ্ট মডেল মসজিদ নির্মিত হচ্ছে। এগুলো নির্মাণ হবে ৬৪ জেলা শহরে এবং চারটি সিটি কর্পোরেশন এলাকায়। এগুলোর আয়তন হবে দুই লাখ ৮১ হাজার ৫৮৪ বর্গমিটার। এক লাখ ৬৪ হাজার ৭৪২ বর্গমিটার আয়তনের ‘বি’ ক্যাটারির মসজিদ হবে ৪৭৬টি। আর ৬১ হাজার ২৫ বর্গমিটার আয়তনের ‘সি’ ক্যাটাগরির মসজিদ হবে ১৬টি। উপকূলীয় এলাকার মসজিদগুলোতে নিচ তলা ফাঁকা থাকবে। যা সাইক্লোন সেল্টার হিসেবেও ব্যবহার হবে।
সর্বোপরি ইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে ইসলামী মূল্যবোধ বিনির্মাণে এক একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে উঠবে এসব মসজিদ। আশা করা হচ্ছে ইসলাম নিয়ে বিভ্রান্তি দূর হওয়ার পাশাপাশি শক্তিশালী ইসলামী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে উঠবে।