নিউজ ডেস্ক:
শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের অন্যতম কর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন শেখ মুজিব। তিনি একজন ফুলটাইম রাজনীতিবিদ ও কর্মী। অন্য রাজনীতিবিদরা যেখানে যে যার ব্যক্তি স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত, শেখ মুজিব তখন সার্বক্ষণিক একজন আওয়ামী লীগ কর্মী।
তৃণমূল থেকে আওয়ামী লীগকে গড়ে তুলেছেন শেখ মুজিব এবং দেশের আনাচে-কানাচে এর শাখা ছড়িয়ে দিয়েছেন সফলভাবে। মুসলিম লীগ যখন ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে ইসলামের স্লোগানের ওপর নির্ভরশীল এবং কৃষক শ্রমিক পার্টি গড়ে উঠেছে ফজলুল হকের ব্যক্তিত্বকে ঘিরে, আওয়ামী লীগ তখন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক মুক্তির দাবিতে দাঁড়িয়ে গেছে। এটি এমন একটি দল, যার রয়েছে জন-আবেদন এবং এটি নেতৃত্বের উচ্চ স্বর নিয়ে নিম্নবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
এ হলো প্রকৃতির উৎপাদন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একটি দল, যা গড়ে উঠেছে গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও প্রাদেশিক দাবির সমন্বয়ে। দ্ব্যর্থবোধক ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের ভান অথবা অসাধারণ কোনো নেতার ব্যক্তিত্বের গৌরব নিয়ে গড়ে ওঠা দল এটি নয়। অপ্রত্যাশিত কোন পরিস্থিতি অথবা দুর্ঘটনায় আওয়ামী লীগ টলে যাবে না, কারণ এর ভিত্তি প্রোথিত জনমানুষের বুকের গভীরে। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের জন্য এ দলটির সমর্থন ও সহানুভূতি রয়েছে। ছাত্র ও তরুণ বুদ্ধিজীবীরাও দলটির প্রতি আকৃষ্ট হয়।
মহান ও ডাইনামিক নেতা সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পরেও টিকে থেকেছে আওয়ামী লীগ। এর কারণ দলটির নিরেট ও পরিব্যাপক ভিত্তি। দলে নানা ভাব ও ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা অসংখ্য কর্মী আছেন। এদের নিয়েই নীরবে এবং ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন সেক্রেটারি শেখ মুজিব।
দলের সূচনা করেন শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী, শামসুল হক এবং আতাউর রহমান ১৯৪৯ সালে। কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতৃত্বের জনবিচ্ছিন্ন নীতির পরিণাম এ দলটির সৃষ্টি। মুসলিম লীগ সরকারকে সমর্থন করেছে এবং সবার জন্য তাদের দোর খোলা ছিল না।
ইস্ট বেঙ্গল মুসলিম লীগের সভাপতি আকরম খাঁ বলেন, ‘মুসলিম লীগ পার্টিতে আমার সবাইকে গ্রহণ করতে পারি না। আমরা আগে তার ব্যাকগ্রাউন্ড জানব তারপর তাকে নির্বাচন করব।’
৪ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত ঢাকা থেকে মাত্র ১৪০০ সদস্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সদস্যদের রিক্রুটমেন্টের জন্য মাত্র ২৮টি রসিদ বই সরবরাহ করা হয়। ১৯৪৩ সালে শেখ মুজিব কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ইন্টারমিডিয়েট আর্টসে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন ছিলেন বেঙ্গল মুসলিম লীগের কাউন্সিলর।
শেখ মুজিব যখন উপলব্ধি করলেন ব্যক্তিস্বার্থের বেড়াজালে বন্দি হয়ে পড়েছে মুসলিম লীগ, তিনি তখন, ১৯৪৮ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগ কাউন্সিল আহ্বান করেন। তবে পাকিস্তান মুসলিম লীগ প্রধান চৌধুরী খালিকুজ্জামানের বিষয়টি মনঃপূত হয়নি । মুজিব অন্যদের নিয়ে নারায়ণগঞ্জে একটি কনফারেন্সের ব্যবস্থা করেন এবং এরই চূড়ান্ত ফল হিসেবে গোলাপবাগে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়। পরে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। শুধু থাকে ‘আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের গঠন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও খাজা নাজিমুদ্দীনের ভ্রু কুঞ্চিত করে তোলে। ১৯৫১ সালে লিয়াকত আলী খান ঢাকা সফর করেন এবং করাচি ফেরার পথে বিমানবন্দরে বসে তিনি সন্দেহের সুরে প্রশ্ন করেন, আওয়ামী লীগ? কোথায় সেটা? আমি তো পূর্ব বাংলায় কোন আওয়ামী লীগ দেখতে পাচ্ছি না। অথচ আওয়ামী লীগ তখন দেশের তৃণমূল পর্যায়ে পৌছে গেছে।
আওয়ামী লীগের প্রথম সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী; সেক্রেটারি ছিলেন শামসুল হক এবং শেখ মুজিব ছিলেন জয়েন্ট সেক্রেটারি। জয়েন্ট সেক্রেটারি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার সময় তিনি জেলে ছিলেন। ১৯৫৩ সালে শামসুল হক মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে শেখ মুজিব সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এই সময় শেখ মুজিব তার কঠোর পরিশ্রম, উদ্দীপনা ও অনুরাগ দিয়ে আওয়ামী লীগের বার্তা মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌছে দেন এবং ইউনিয়ন থেকে জেলা লেভেল পর্যন্ত সব স্তরে দলের নানান ইউনিট গড়ে তোলেন।
এভাবে আওয়ামী লীগ একটি তেজস্বী ও জনপ্রিয় দলে পরিণত হয় পাকিস্তান মুসলিম লীগকে ঝেটিয়ে বিদায় করার জন্য। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এটি শক্তিশালী বিরোধী দলে পরিণত হয়। এটি শেখ মুজিবের অবিস্মরণীয় কৃতিত্ব।
সোহরাওয়ার্দী এর আগে পাকিস্তান থেকে কলকাতা এসে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এর আহবায়ক হিসেবে এবং আওয়ামী লীগকে সর্বাত্মক পাকিস্তানি ভাবমূর্তিতে সাজানোর চেষ্টা করেন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেব শেখ মুজিব তার সমস্ত শক্তি নিয়ে নির্বাচনে ঝাপিয়ে পড়েন। ফজলুল হক, ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর পরে শেখ মুজিবই একমাত্র নেতা, যার ওজন বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিল যুক্তফ্রন্ট। তিনি দিন-রাত কাজ করেছেন। কখনো সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে, কখনো-বা একা গ্রামগঞ্জে ঘুরে বেরিয়েছেন। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা ইশতেহারের সাফল্য অসাধারণ ছিল।
নির্বাচনের পরে শেখ মুজিব ইস্ট বেঙ্গল অ্যাসেম্বলিতে যান। সোহরাওয়ার্দী চেয়েছিলেন, মুজিবের কিছু প্রশাসনিক ও সংসদীয় অভিজ্ঞতা হোক। সোহরাওয়ার্দী চেয়েছিলেন মুজিব প্রখ্যাত সংসদ নেতা এ কে ফজলুল হকের কাছ থেকে সংসদীয় জ্ঞান অর্জন করবেন। তবে ঘটনাপ্রবাহে দেখা যায়, ফজলুল হক একজন বিশেষ ব্যক্তিকে মন্ত্রী বানাতে চান। এটি মর্মাহত করে তালে সোহরাওয়ার্দীকে। তিনি ফজলুল হকের পছন্দের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করতেই মন্ত্রী হিসেবে মুজিবের নাম প্রস্তাব করেন। তবে শেষতক সমঝোতা হয়নি। ফজলুল নিজের পছন্দের মানুষদের বেছে নিয়ে চারজন মন্ত্রীকে নিয়ে গঠন করেন কেবিনেট- আশরাফউদ্দিন চৌধুরী, আবু হোসেন সরকার, সৈয়দ আজিজুল হক এবং নিজে মুখ্যমন্ত্রীর পদ বেছে নেন।
কলকাতায় বিচারবুদ্ধিহীন বক্তৃতা দেয়ার পরে ফজলুল হক যখন আবিষ্কার করেন তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে, তখন, ১৯৫৪ সালের ১৫ মে আওয়ামী লীগ থেকে আরো ১০ জন মন্ত্রী নিয়ে তিনি তাঁর সরকারের মন্ত্রিসভাকে প্রশস্ত করে তোলেন। এই বর্ধিত মন্ত্রণালয়ে শেখ মুজিবকে কৃষিঋণ বিভাগের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়।
মাস দুই পরে ১৯৩ ধারাটির (গভর্নরের সরাসরি আইন) আদেশে যুক্তফ্রন্টের। সরকার ভেঙে যায়। মন্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয় তাও মন্ত্রীর বাড়ি থেকে, রাতের প্রথম প্রহরে। জনগণের প্রতিনিধির প্রতি এহেন আচরণ ছিল খুবই অপমানজনক ও নজিরবিহীন। কারণ শেখ মুজিব ছিলেন জনতার নির্বাচিত প্রতিনিধি।
১৯৩ ধারার এ সময়কালে ভেঙে যেতে থাকে যুক্তফ্রন্ট। মৈত্রীর ভেতরকার অন্তসারশূন্যতা এবং নেতাদের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি উন্মুক্ত হয়ে যায়, যুক্তফ্রন্টে ফাটল ধরে, যদিও কৃষক শ্রমিক পার্টি এবং আওয়ামী লীগ ২১ দফার ইশতেহারের প্রতি দায়বদ্ধ ছিল।
ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দী দুই মেরুতে অবস্থান নিতে থাকেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের মতদ্বৈধতা পরিস্ফুটিত হতে থাকে।
শেখ মুজিব দেখেন, যুক্তফ্রন্ট একটি কৃত্রিম ও নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার দল, যারা যে যার স্বার্থ রক্ষার জন্য নির্বাচনে জয়ী হতে একত্রিত হয়েছিল এবং ২১ দফা ইশতেহার বাস্তবায়নের মতো সাম্যাবস্থায় তা নেই।
বগুড়া মোহম্মদ আলী ছিলেন গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহম্মদের ভাঁড়। পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের ভরাডুবির পরে ক্ষমতায় টিকে থাকতে তিনি ফজলুল হকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে যুক্তফ্রন্টে একটি ফাটল সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন। কলকাতার বক্তৃতার কারণে ফজলুল হক করাচিতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কেজো লোকে পরিণত হন। ব্যর্থ যুক্তফ্রন্ট থেকে আওয়ামী লীগকে বিযুক্ত করেন শেখ মুজিব। তার লক্ষ্য ছিল ২১ দফার ইশতেহারের বাস্তবায়ন, যাতে পাওয়ার পলিটিকসের কোন ক্ষতি করতে না পারে।
শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে যোগাযাগ করানোর ব্যাপারে তাঁকে সম্মত করতে সোহরাওয়ার্দীকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। নানান অমীমাংসিত বিষয়ের কারণে পাকিস্তানের সংবিধানের কাঠামো এখনো দাঁড় করানো যায়নি। জনসংখ্যাভিত্তিক সমতায় রাজি ছিল না পশ্চিম পাকিস্তান কারণ তারা ভয় পেয়েছিল, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর ছড়ি ঘোরাবে। প্রতিনিধি নির্বাচনের সমস্যাটি অচলাবস্থায় থেকে যায়।
সমতার এই প্রস্তাবের প্রতি আস্থা ছিল সোহরাওয়ার্দীর। তিনি বলেন, ‘সমতার প্রকার গ্রহণ না করা হলে অচলাবস্থা কাটবে না এবং সংবিধানও দাঁড়া করানো যাবে না।
জাতীয় অ্যাসেম্বলির সেশনে murree মিশনে এই ইস্যুটি সামনে চলে আসে। সোহরাওয়ানীর ও তার দলের লোকদের সম্মানে এক নৈশভোজের আয়োজন শেষে মুশতাক আহমেদ গুরমানি এই আলোচনার সূত্রপাত করেন। আলোচনা চলে কয়েক দিন পর্যন্ত।
মুজিব শুরু থেকেই সমতার প্রস্তাবের এক পক্ষে। সোহরাওয়ার্দী যখন নিশ্চিত করেন, এটি সাময়িক একটি প্রস্তাব মাত্র এবং অন্যান্য বিষয়গুলোও সমতার সঙ্গে বর্ধিত হবে, যেমন- ১, কেন্দ্রীয় সিভিল ও প্রতিরক্ষা দফতর। ২, পর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন। ৩, যুগ্ম ভোটাধিকার ৪, রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে বাংলা ও উর্দুকে প্রতিষ্ঠা, একমাত্র তখনই শেখ মুজিব সমতার প্রস্তাবে ট্রায়াল হিসেবে সম্মতি জ্ঞাপনে রাজি হন।
শেখ মুজিবের জন্য পরবর্তী বছরগুলো ছিল নিতান্তই হতাশার। এ ছিল চুক্তির বরখেলাপের ইতিহাস। সম্প্রতি শেখ মুজিব সমতার প্রস্তাবে প্রতিনিধিত্বকে নিন্দা করেছেন। তিনি করাচি, ঢাকাসহ অন্যান্য জায়গায় প্রায়ই বলেছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান সমতার প্রস্তাবে রাজি হয়েছিল এই শর্তে যে সকল স্তরে সমতার বিস্তৃতি ঘটবে। কিন্তু আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা বলছে, আমরা শুধু প্রতিনিধিত্বই দেখতে পাচ্ছি, খুঁতখুঁতে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমতাকে অনুসরণ করা হচ্ছে। তিনি সমতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের দাবি করেন।
সেই সময় থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত, যখন সামরিক শাসক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, শেখ মুজিব ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক। তাঁর কঠোর পরিশ্রম, উদ্দীপনা ও আগ্রাসী প্রাণশক্তি আওয়ামী লীগকে জনপ্রিয় করে তোলে।
১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দী ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট এনডিএফ (NDF)গড়ে তুললে শেখ মুজিব সর্বক্ষণ তাঁর সঙ্গেই ছিলেন। ১৯৬৩-র ডিসেম্বরে সোহবাওয়ার্দীর আকস্মিক মৃত্যুতে এনডিএফ ক্রমে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক নিচ্রিয়তা এড়াতে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তিনি পরিশ্রম ও অনুরাগ দিয়ে আওয়ামী লীগের মাঝে নতুন প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন এবং দলটিকে অপ্রতিরোধ্য অবস্থানে নিয়ে যান। ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ শেখ মুজিবকে আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক বানানো হয়।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধ এবং তাসখন্দ বিপর্যয়ের পরে, ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে আইয়ুব খান একটি কনভেনশনের আয়োজন করেন। শেখ মুজিব এই কনফারেন্সে যোগ দিয়ে ছয় দফা দাবি উপস্থাপন করেন। এই দাবি যেন পশ্চিম পাকিস্তানিদের চোখ খুলে দেয়। এর আগে তারা পূর্ব পাকিস্তানের দুঃখ-দুর্দশার বিষয়ে তেমন সচেতন ছিল না।
ছয় দফা দাবি প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেই নাড়া দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের হতাশা ও ক্ষোভের বিস্ফোরক প্রকাশ ছিল এটি। ছয় দফা দাবির অর্থ বুঝে নিতে প্রেসের বিন্দুমাত্র সময় লাগেনি। শেখ মুজিবকে উপস্থাপন করা হয় একজন ক্রুদ্ধ যুবক এবং নেতা হিসেবে, যিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছ থেকে নতুন একটি বার্তা বহন করে এনেছেন- তাদের বেঁচে থাকার আবিষ্কারের বার্তা।
যখন সম্মিলিত বিরোধী দল আইয়ুবের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য গঠিত হয়, এই বিরোধিতার পেছনে বেগবান শক্তিটি ছিলেন শেখ মুজিব। সম্মিলিত বিরোধী দলের পক্ষে মিস জিন্নাহর প্রতি তাঁর শুরু থেকেই সমর্থন ছিল। মিস জিন্নাহর নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর জন্য গঠিত স্টিয়ারিং কমিটির একজন সদস্য ছিলেন শেখ মুজিব।
খাজা নাজিমুদ্দীন, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, মওলানা ভাসানী ও নবাবজাদা নসরুল্লাহর সঙ্গে শেখ মুজিব মিস জিন্নাহর কাছে যান এবং তাঁদের প্রার্থী হিসেবে তাঁকে নির্বাচনে দাঁড়াতে অনুরোধ করেন। নাজিমুদ্দীন আগে ভেবেছিলেন, তিনি নিজেই সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হবেন। তবে এর কিছুদিন পরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সম্মিলিত বিরোধী দল বা cop (combined opposition party)- TRICK হাসাহাসি করতেন আইয়ুব খান এবং ঠাট্টা করে বলতেন ‘cult of power মিস জিন্নাহর দেশ জুড়ে নির্বাচনী সফরের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ও উপদেষ্টা ছিলেন শেখ মুজিব। মিস জিন্নাহর অকপট ও প্রবল ব্যক্তিত্বকে নিয়ে কাজ করা মুখের কথা নয়। তবে শেখ মুজিব সমস্ত চাপ সয়ে হাসিমুখে কাজ করেছেন। ‘ভাব, আন্তরিকতা, কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠাকে মিস জিন্নাহ খুব পছন্দ করতেন।
রাজনীতিতে সাধারণত ডানপন্থিরা বামপন্থিদের দেখতে পারে না আর নরমসম। দলগুলো পড়ে যায় চাপের মুখে। পাকিস্তানে ইসলামিক ও বামপন্থি দলগুলো আওয়ামী লীগের বিপক্ষে স্থান নিয়েছিল। যদিও শেখ মুজিব বলেছেন, ‘আমি ডানপন্থি বা বামপন্থি কোনটাই নই।
আওয়ামী লীগ দলটি উঠে এসেছে একদম তলদেশ থেকে, বলা উচিত পূর্ব পাকিস্তানের হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশ থেকে। কর্তৃপক্ষ দেশটির বার্তা বুঝতে যদি ব্যর্থ হয় কিংবা অগ্রাহ্য করে, তাহলে তা এক ভয়ানক ভবিতব্যের দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে পারে। আওয়ামী লীগ স্রেফ একটি সাধারণ রাজনৈতিক দল নয়। এটি পূর্ব পাকিস্তানের সত্তা এবং অর্থনৈতিকভাবে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্য গণমানুষের কণ্ঠ ||
ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও দর্পের জন্য যারা সমঝোতা করে তাদের মতো লোকের কোন জায়গা নেই আওয়ামী লীগে। সোহরাওয়ার্দীর সময়ে যেসব দোদুল্যমান, অক্ষম বর্ষীয়ান নেতা রাজনীতি করতেন, তারা একে একে খসে গেছেন আওয়ামী লীগ থেকে, গেছে তরুণ, প্রতিভাবান এবং সংকল্পবদ্ধ মানুষের নেতৃত্বের কাছে।
ইতিহাসে এমনটি সব সময়ই ঘটে যে যদি কোন রাজনৈতিক দল প্রচলিত নীরস রাজনৈতিক কর্মসূচি এড়িয়ে নতুন ও প্রগতিবাদী আদর্শ দ্বারা উদ্দীপ্ত হয়, তাহলে তা অসহিষ্ণু ও অসহনশীল হয়ে ওঠে। তবে এটাই মানবিক পথ এবং একমাত্র সঠিক রাস্তা।
অর্থ, পণ্য এবং বৈদেশিক মুদ্রা শোষণে গত ২২ বছরের সময়কালকে বিষাদক্লিষ্ট একটি কাল বলা যায়। লোকে হতাশ হয়ে দেখেছে কেন্দ্রীয় সরকারগুলোর হঠকারী রাজনীতির কারণে পূর্ব পাকিস্তান কীভাবে হীনবীর্য হয়ে পড়েছে এবং বৈষম্য দেশটিকে কীভাবে দ্বিতীয় শ্রেণির প্রদেশে পরিণত করেছে। লাখো জনতা অধ্যুষিত এটি এমন একটি প্রদেশ, যেখানে জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। পূর্ব বাংলার বঞ্চিত প্রদেশে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না হলে দুটি অংশের ক্ষীণ সম্পর্কের সুতোটা যে-কোন সময় ছিড়ে যেতে পারে।
বয়সি, সুনামহানি হওয়া নেতারা জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বুঝে উঠতে পারেননি। জনতা এগিয়ে গেছে সামনে আর এরা পড়ে রয়েছেন পেছনে। তবে ঘটনা ঘটা উচিত অন্যভাবে। নেতাদের উচিত, জনগণের চিন্তা ও মেজাজ-মর্জির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন নেতার সন্ধান করা।
নেতারা আমাদের রাজনীতিতে ভুল যুগে, ভুল সময়ের ভুল মানুষ। গত ২০ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ রাজনীতিতে ইসলাম নিয়ে ঢের স্লোগান দিয়েছে। এখন তারা ধৈর্যহীন। তারা ইসলামসহ আরো অনেক কিছুই চায়। তারা বাঁচার অধিকার চায়। আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবি তাদের সেই অধিকার দিয়েছে। এই দাবি এখন আর ব্যক্তিবিশেষের দাবি নয়, সবার দাবি। স্বয়ং নেতাও এ আন্দোলন পরিত্যাগ করতে পারবেন না। জনগণের মননে ও মস্তিষ্কে ঢুকে গেছে ছয় দফা দাবি। এবং তারা বর্তমানে ক্রুদ্ধ ও অধৈর্য।
আওয়ামী লীগ আশা করছে না যে কেন্দ্র-ঘেঁষা সংবিধান বৈষম্য দূর করবে, কারণ এটি প্রায় অসম্ভব। এতে যতই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকুক না কেন, কেন্দ্র সরকার বৈষম্যের অবসান ঘটাবে, এমনটি আশা করা ভুল। একটি উপায় অবশ্য আছে, তবে সেটি খুব একটা সুবিধাজনক নয় এবং এর বাস্তবায়নও ঠিক হবে না। সেটি হলো পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন বন্ধ করে দেয়া। এখন এটি দৃশ্যমান যে বৈষম্য বেড়েই চলবে এবং পরিসংখ্যানের মারপ্যাচ দিয়ে একে চেপে রাখা যাবে না।
আওয়ামী লীগের দাবি কার্যসিদ্ধ ও সরল। কেন্দ্রীয় সরকারের কর আরোপের ক্ষমতা রদ, বাণিজ্য সম্প্রসারণে সাহায্য, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং একসঙ্গে দুই প্রদেশে সমানভাবে অর্থ বণ্টন- এভাবেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেকার বৈষম্যের জীবাণু জন্মের সময়েই হত্যা করা সম্ভব।
দলের কর্মীদের নিয়ে আবেগের সঙ্গে কথা বলেন শেখ মুজিব। কথা বলার সময় তাদের প্রতি তাঁর স্নেহ ও ভালোবাসা ফুটে ওঠে চোখে। তিনি স্মরণ করেন অনুগত ও নিজেদেরকে উৎসর্গ করা নবীন কর্মীদের, যারা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর নীরবে এবং ধৈর্য নিয়ে কাজ করে চলেছে, কখনো পাবলিসিটি নিয়ে ভাবেনি, কখনো কোনো পুরস্কারের আশা করেনি। তিনি বলেন, ‘ওরাই হলো প্রকৃত দেশপ্রেমিক তারপর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে যোগ করেন, আমি ওদের মাঝ থেকেই উঠে এসেছি এবং এখন হয়েছি তথাকথিত নেতা। মুজিব মনে করেন, যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসের সঙ্গে লড়াই করা সৈনিকদের চেয়ে এই কর্মীরা কোন অংশে কম দেশপ্রেমিক নয়।
শেখ মুজিব তার ব্যক্তিগত আয়ের অনেকটাই এই কর্মীদের দান করে দেন। তিনি বলেন, ‘ওরা বেঁচে থাকলে আমিও বেঁচে থাকব। এরা তাঁর জীবন এবং ব্যক্তিত্বের অদৃশ্য অংশ। কর্মীদের জন্য এরকম ভালোবাসা আরো একজন মানুষের মধ্যে ছিল, তিনি মুজিবের নেতা সোহরাওয়ার্দী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বলছে, আওয়ামী লীগের শক্তিশালী ও অপ্রতিরোধ্য কণ্ঠস্বর এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। পূর্ব পাকিস্তান যেভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। তা নিয়ে মুজিবের চিন্তাগুলো এখন অন্যান্য রাজনৈতিক দলেরও প্রতিধ্বনি তুলছে।
মুজিবই প্রথম জনসংখ্যার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলেন, যা দেশের ভবিষ্যৎ সংবিধানের প্রথম ফলক হয়ে উঠবে।যেসব দল দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে ।তারা এই থিম বা ভাবনাটি তার কাছ থেকেই ধার করেছে। তবে স্বায়ত্তশাসনের যে দাবি তুলেছেন তা অতিবাস্তব, যার কথা ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের প্রতিফলন ছয় দফায় বলা হয়েছে।
লাহোর প্রস্তাব হলো পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি। এটি বড়জোর প্রদেশগুলোর সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসনসহ একটি ফেডারেল সরকারের ছবি তৈরি করে এবং কেন্দ্রের জন্য দুটি স্বায়ত্তশাসিত ইউনিটের দুর্বল বন্ধনের আহ্বান জানায় অথবা দুটি আলাদা স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের কথা বলে।
ফেডারেল সরকারের জন্য এটি পরিকল্পিত হলেও এতে কোন ভুল নেই যে কেন্দ্রের চেয়ে প্রাদেশিক প্রতিরক্ষাই এখানে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। ছয় দফা দাবি লাহোর প্রস্তাবের মতো বিভ্রান্তিকর এবং কঠিন নয়। সব সম্মিলিত শক্তির চেয়ে প্রতিরক্ষাই কেন্দ্রে বেশি শক্তি জোগায়।
একবার দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আমাকে লাহোর প্রস্তাবটি আরেকবার পড়তে বলেছিলেন। তারপর তিনি নিজেই জোরে জোরে লাহার প্রস্তাবের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো পড়ে শুনিয়ে বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘আমাদের দাবি সামান্যই। ছয় দফা দাবি লাহোর প্রস্তাবের মতো তীব্র নয়।
লাহোর প্রস্তাব এখানে মৃত নয়। এটি লোকের মনে বেঁচে রয়েছে। এর প্রতিধ্বনি পরিলক্ষিত হয় ছয় দফা দাবির মধ্যে যদিও সময় এবং ঘটনার পরম্পরায় এর অনেক কিছুই বদলে গেছে রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থান কিংবা একীভূত হওয়াটাকে বেশ কৌতুকের চোখে দেখছেন শেখ মুজিব। এদের মধ্যে একটি বিষয়ে বেশ মিল রয়েছে আর তা হলো এদের আড়ম্বরপূর্ণ নাম। এক দলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ দলে অনুসারীদের চেয়ে নেতার সংখ্যা বেশি। এ হলো নেতাদের পার্টি। আরেকটি দল সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেন, ‘আজকাল নেতা হওয়া খুব সহজ। কোন আত্মত্যাগের প্রয়োজন নেই। একটা দল শুরু করে বিবৃতি দিলেই হলো,আপনি নেতা হয়ে যাবেন। তিনি মনে করেন আগামী নির্বাচনে এরা সবাই ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে। সে পর্যন্ত ওরা একটু পাবলিসিটি এবং খ্যাতির রোদে গা পুইয়ে নিক।