নিজস্ব প্রতিবেদক:
করোনা টিকা নিয়ে গুজব ছড়িয়ে কোনো কুচক্রী মহল যাতে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে না পারে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। বিশেষ করে ইউটিউব, ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ইমো, ভাইবার, ম্যাসেঞ্জার ও ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাতে এ টিকার নেতিবাচক দিক নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিটি সাইবার ইউনিটকে প্রস্তুত রাখা হচ্ছে। অনলাইনে টিকা নিয়ে গুজব ছড়িয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো হলে ডিজিটাল অপরাধে মামলা করা হবে বলেও সরকারের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি জানানো হচ্ছে।
সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে দেশের কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্রের ফাঁদ তৈরির আশঙ্কা প্রকাশ করে সরকারকে সতর্ক করেছে। তারা জানিয়েছে, সদ্য আবিষ্কৃত এ টিকা নিয়ে আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও নানা গুজব ছড়িয়েছে। এতে সেখানকার অনেক মানুষের মধ্যে টিকা গ্রহণের ব্যাপারে কিছুটা অনীহা দেখা যাচ্ছে। এসব বিষয় মাথায় রেখেই সরকারকে আগাম সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে। এরই মধ্যে অনলাইনে টিকা নিয়ে নেতিবাচক কিছু প্রচারণা তাদের দৃষ্টি গোচর হয়েছে, যা অনেকাংশেই মিথ্যা।
সরকারের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, প্রথম দফায় যেসব চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীকে টিকা দেওয়ার কথা রয়েছে তাদের মধ্যেও টিকা নিয়ে কিছু প্রশ্ন, কিছু সংশয় রয়েছে। প্রশ্ন আছে সাধারণ নাগরিকদের একাংশের মনেও। তাই এ নিয়ে যাতে কোনো গুজব বা অপপ্রচার না ছড়ায় বা সাধারণ নাগরিকরা যাতে এই গুজবে প্রভাবিত না হন, সে জন্য বেশকিছু সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
এত দিন মোবাইল ফোনে কল করলেই করোনাভাইরাস নিয়ে সতর্কীকরণ এবং মাস্ক-শারীরিক দূরত্ববিধি নিয়ে সচেতন করতে কলার টিউন বেজেছে। এবার তা বদলে ভ্যাকসিন সংক্রান্ত সচেতনতার বার্তা শোনানো হবে। তাতে বলা হবে, কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিনের মাধ্যমে নতুন আশার দেখা দিয়েছে। দেশে যে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে তা সম্পূর্ণ নিরাপদ ও ফলদায়ক। ভ্যাকসিনের ওপর ভরসা রাখুন, গুজবে বিশ্বাস করবেন না। কোভিডের বিরুদ্ধে শুধু বাংলাদেশই নয়, গোটা বিশ্ব লড়ছে।
এছাড়া টিকা গ্রহণ-পরবর্তী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে যাতে গুজব না ছড়ায় এ জন্য প্রতিটি ভ্যাকসিন সেন্টারে ‘রিউমার রেজিস্টার’-এর ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে। ভ্যাকসিন নেওয়ার পর পর্যবেক্ষণ কক্ষের বাইরে একটি রেজিস্টারে প্রত্যেক প্রাপককে তার অভিজ্ঞতার কথা লিখতে হবে। তবে টিকা নেওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যে শারীরিক বা মানসিক অস্বস্তি কিংবা কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা না দিলে এই রেজিস্টারে মন্তব্য লেখা বাধ্যতামূলক হবে না।
এদিকে করোনা ভ্যাকসিন সংক্রান্ত গুজব ঠেকাতে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াতেও প্রচার-প্রচারণা চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। পাশাপাশি টিকা নিয়ে নেতিবাচক সংবাদের সত্যতা যাচাই-বাছাই করে পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে তা প্রচার-প্রকাশনার ব্যাপারে সতর্ক থাকার জন্য গণমাধ্যম কর্মীদের প্রতি খুব শিগগিরই আহ্বান জানানো হবে।
অন্যদিকে ভ্যাকসিন সংক্রান্ত গুজবে যাতে সাধারণ মানুষ কান না দেয় এবং এসব গুজব ছড়ানোর ক্ষেত্রে যাতে কোনো ভূমিকা গ্রহণ না করে এ ব্যাপারে বেশকিছু দিকনির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো বন্ধ করতে সাধারণ মানুষের ভূমিকা কী হবে এ সংক্রান্ত ছকে বলা হয়েছে, করোনা টিকার নেতিবাচক কোনো তথ্য পেলে তা তাৎক্ষণিক বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বা সহকর্মীদের ইমেইল, হোয়াটস অ্যাপ, ফেসবুক বা টুইটারে পাঠিয়ে না দিয়ে এর সত্যতা জানার চেষ্টা করতে হবে। একই সঙ্গে তথ্যের উৎস যাচাই এবং এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা জরুরি। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা সব সময় শতভাগ সঠিক তথ্য দিতে না পারলেও তারা নিঃসন্দেহে কারও আত্মীয় বা হোয়াটস অ্যাপের চেয়ে নির্ভরযোগ্য হবে। এছাড়া তথ্যের উৎস যদি হয় ‘এক বন্ধু’, ‘বন্ধুর আত্মীয়’, ‘আত্মীয়ের সহকর্মী’ অথবা ‘সহকর্মীর আত্মীয়’র মতো কেউ, তাহলে অবশ্যই সেই তথ্য শেয়ার করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
কোনো তথ্য শেয়ার করার আগে তা দায়িত্বশীল কারও ভেরিফাইড অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া হয়েছে কি না তা যাচাই করা জরুরি। কেননা দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষের কারও আনুষ্ঠানিক অ্যাকাউন্ট বা যেকোনো প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমের নাম ব্যবহার করে পোস্ট দেওয়া খুবই সহজ। সেসব পোস্ট দেখে মনে হতে পারে যে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকেই তথ্যগুলো এসেছে। অথচ স্ক্রিনশট পরিবর্তন করে যেকোনো তথ্য এমনভাবে প্রকাশ করা যায়, যা দেখে মনে হয় যে তথ্য বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকেই এসেছে।
এ রকম ক্ষেত্রে পরিচিত এবং ভেরিফাইড অ্যাকাউন্ট ও ওয়েবসাইটের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা উচিত। সেসব জায়গায় যদি সহজে তথ্যগুলো খুঁজে পাওয়া না যায়, তাহলে ধরে নিতে হবে এটি ভুয়া। অনেক সময় গুজব রটনাকারীরা বেশকিছু সঠিক তথ্যের সঙ্গে ভুল তথ্য যোগ করে ছড়িয়ে দেয়। এতে মানুষ সহজেই বিভ্রান্ত হয়। পাশাপাশি যেসব পোস্ট মানুষকে আতঙ্কিত, চিন্তিত অথবা উৎফুলস্ন করে এ ধরনের আবেগী পোস্ট সাধারণত ভাইরাল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই এসব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, করোনা ভ্যাকসিন তৈরির পর বিশ্বের অনেক দেশেই বিভিন্ন মাধ্যমে নানা ভুল তথ্য ও কুসংস্কার মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ‘করোনার টিকা ডিএনএ বদলে দেবে’ এ রকম উদ্ভট তত্ত্ব ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কোনো প্রমাণ ছাড়াই আরও দাবি করা হয়েছে, ভ্যাকসিন মানুষকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি ইন্টারফেসের সঙ্গে যুক্ত করে দেবে। এসব গুজবে সাড়া দিয়ে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রাথমিক পর্যায়ে টিকা নিতে রাজি হননি।
তবে পরে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা প্রমাণ করে দিয়েছেন, টিকার কাজ শরীরকে ভাইরাস চিনিয়ে দেওয়া এবং তার সঙ্গে লড়াই করতে দেহের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে জাগিয়ে তোলা। এর মধ্যে এমন কোনো উপাদান বা প্রযুক্তি থাকে না, যা মানুষের ডিএনএ বদলে দিতে পারে বা তাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ইন্টারফেসের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে পারে। তবে এরপরও করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে ফেসবুকে কিছু গ্রম্নপের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক চলছে।