নিজস্ব প্রতিবেদক:
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে দেশ-বিদেশের ৩০ লাখ মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিশিষ্টজন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে নাগরিক আন্দোলনের তিন দশক’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারে গতকাল মঙ্গলবার এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
নির্মূল কমিটির ৩০ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে গতকাল এ আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার হয়। এতে সংগঠনের প্রস্তাবনায় বলা হয়, ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালন এবং বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের উদ্যোগ নিতে ২০১৭ সালের মার্চে জাতীয় সংসদে সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। যদিও সরকারিভাবে এ পর্যন্ত কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে যৌথভাবে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এ উদ্যোগকে সফল করতে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে নির্মূল কমিটি আগামী এক বছরে দেশ-বিদেশের ৩০ লাখ নাগরিকের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে জাতিসংঘসহ সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সরকারের কাছে পাঠাবে।
নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। সূচনা বক্তব্যে শাহরিয়ার কবির নির্মূল কমিটির ৩০ বছরের আন্দোলনের দীর্ঘ পদযাত্রায় বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত ও সাফল্যের সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরেন। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় পৃথক কর্মসূচি পালিত হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে রাজধানীতে মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সকালে নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক শহীদজননী জাহানারা ইমামের সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ এবং শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ৩০তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানসূচি শুরু করে সংগঠনটি।
শাহরিয়ার কবির বলেন, পাকিস্তান ও পাকিস্তানপন্থিরা প্রথম থেকেই একাত্তরের গণহত্যার দায় শুধু অস্বীকারই করছে না; বরং মুক্তিযুদ্ধকালে তথাকথিত পাকিস্তানিদের হত্যার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে দায়ী করছে। নির্মূল কমিটি দীর্ঘকাল পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে একাত্তরের নৃশংসতম গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে গণহত্যাকারীদের বিচারের পক্ষে দেশে-বিদেশে জনমত সৃষ্টির কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। তবে সরকার সক্রিয় উদ্যোগ না নিলে বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে গণহত্যাকারী পাকিস্তানের মিথ্যা বয়ান অনেককে বিভ্রান্ত করবে।
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, নির্মূল কমিটি না হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি গণমানুষের কাছে পৌঁছাত না। গণমানুষ আন্দোলিত হয়েছিল বলেই আমাদের দল এবং সরকার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নিতে পেরেছে। গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়ে নির্মূল কমিটির প্রস্তাবের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে তিনি বলেন, দ্রুতই মন্ত্রিপরিষদে তিনি এই দাবি নিয়ে কথা বলবেন।
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, অন্য কোনো সংগঠন একটানা ৩০ বছর একটি আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারেনি। নির্মূল কমিটির আন্দোলন এমন একটি আন্দোলন যেখানে সব সময় দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ যুক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে নির্মূল কমিটি গর্ব করতেই পারে।
অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, বিএনপি জোট সরকারের আমলে প্রতিহিংসার কারণে শাহরিয়ার কবির জেল খেটেছেন। এই দেশকে ভালোবাসার জন্য একজন মানুষকে কত কষ্ট করতে হয়, নিজের চোখে দেখেছি। যুদ্ধাপরাধী শর্ষিনার পীরকে (জিয়াউর রহমানের আমলে) স্বাধীনতা পদক দিয়ে এই দেশকে অনেক বড় অপমান করা হয়েছে।
সংগঠনের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল। তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মৌলবাদী অপশক্তির ‘সাইবার জেহাদ’ মোকাবিলার জন্য নির্মূল কমিটি একটি সাইবার বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। দেশে-বিদেশে নির্মূল কমিটির সদস্য সংখ্যা বর্তমানে প্রায় এক লাখ। আগামী সম্মেলনের আগে এই সংখ্যা ১০ লাখে উন্নীত করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
আলোচনায় আরও অংশ নেন শহীদজায়া শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী, অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব, শহীদসন্তান আসিফ মুনীর তন্ময়, সঙ্গীতশিল্পী জান্নাতুল ফেরদৌসী লাকী, সর্বইউরোপীয় নির্মূল কমিটির সভাপতি তরুণ কান্তি চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আনসার আহমেদ উল্যাহ, ইন্দো-বাংলাদেশ ফোরাম ফর সেক্যুলার হিউম্যানিজমের সাধারণ সম্পাদক বিদ্যুৎ দেবনাথ, সাংবাদিক শওকত বাঙালী, আইনজীবী আসাদুজ্জামান বাবু প্রমুখ।