দেশে গত চার দশকের অর্জিত ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান খাদ্যের চাহিদা পূরণ, অর্থনীতির ঘাত তরঙ্গ স্থিতিকরণে নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকা পালনকারী অঞ্চল উত্তরের জনপদ। রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে দুর্বল প্রতিনিধিত্বশীল এই জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন থেকেছে দৃষ্টির আড়ালে। উত্তরের বরেন্দ্র জনপদ দেখাচ্ছে নতুন আশার আলো।
বরেন্দ্র এলাকার মাটি, বৈশিষ্ট্য, ভূমির ঢাল একেবারেই স্বতন্ত্র। এ অঞ্চলে এরই মধ্যে ব্যাপক হারে আম উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে কয়েক মৌসুম ধরে আমের দামে ভাটা চলছে। আম সংরক্ষণ, সঠিক পরিবহন ও প্রক্রিয়াকরণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুরনো আমশিল্প নষ্ট হতে বসেছে।
এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে, এমনকি পাহাড়ি অঞ্চলেও প্রচুর পরিমাণে আম চাষ হয়। সেসব আম আগে পাকে, আর চাঁপাইয়ের আম পরে পাঁকে; ফলে ঢাকার বাজার ধরতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চাঁপাইয়ের আমকে। তবে নতুন জাতের আম চাষ ব্যাপকহারে বেড়েছে বরেন্দ্র জনপদে।
আম সংরক্ষণ বা প্রক্রিয়াজাতকরণে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। বেসরকারিভাবে কয়েকটি কম্পানি কিছু আম কেনে; পাল্প তৈরি করে জুসসহ অন্যান্য পণ্য তৈরির জন্য। ফিলিপাইনসহ এশিয়ার অনেক দেশে আম প্রক্রিয়াজাত করে আমসত্ত্ব, জুস, স্লাইসসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে। কিন্তু আমাদের দেশে এসব পণ্য খুব কম।
কৃষিতে এখন চরম শ্রমিক সংকট। কৃষিকাজে যে হারে মজুরি বেড়েছে, অন্য কাজে তার চেয়ে অনেক বেশি মজুরি বেড়েছে। ফলে কৃষিকাজে এখন আর শ্রমিক পাওয়া যায় না। অন্যদিকে মজুরি বেড়ে যাওয়ায় ও ধানের দাম কমায় বর্গাচাষ ব্যবস্থায় আর লাভ হচ্ছে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভূমি মালিকরা ফলবাগানে ঝুঁকছেন।
বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষিতে যে রূপান্তর ঘটছে, তা পুষ্টি চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখছে। তবে সরকারকে চাহিদা-জোগান নিরূপণ করতে হবে। এমন নীতিমালা করতে হবে যাতে শস্যটাও যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, আবার উৎপাদিত ফলও যাতে অপচয় না হয়। এ জন্য বড় আকারে গবেষণা ও নিরীক্ষা চালিয়ে সরকারকে নির্ধারণ করতে হবে যে কোন কোন জমিতে শস্য উৎপাদন হবে এবং কোন জমিতে ফল উৎপাদন হবে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।
কৃষিতে রূপান্তর মানেই খারাপ নয়, তবে এই রূপান্তরটা ‘স্বাস্থ্যকর’ হতে হবে। বরেন্দ্র অঞ্চলে রূপান্তরটা হচ্ছে বাধ্য হয়ে। এখানে কার্যকর সেচব্যবস্থা নেই, ব্যয় বেড়ে গেছে, লাভ হচ্ছে না—এই পরিস্থিতিতে ধান চাষ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক। রূপান্তরের পর আবার যাতে চাষি ক্ষতিগ্রস্ত না হন, তার জন্য সরকারকে এখনই মনোযোগী হতে হবে।
বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচ নিশ্চিত করা গেলে উৎপাদন দ্বিগুণ হবে। এ জন্য সরকারের বড় ধরনের বিনিয়োগ দরকার। বর্তমানে ভূগর্ভস্থ যে সেচব্যবস্থা আছে, তা অনেকখানি অকার্যকর। বৃষ্টির পানি ধারণের ব্যবস্থা করা গেলে কৃষিতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে। ফলে কর্মসংস্থান বাড়বে, দারিদ্র্য বিমোচন হবে। কার্যকর সেচব্যবস্থা গড়ে উঠলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।