নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশের স্বপ্নের দিগন্ত এখন প্রসারিত হয়েছে। ফলে ৬ শতাংশের বৃত্ত ভেঙ্গে উচ্চ প্রবৃদ্ধির সোপানে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের লক্ষ্য এখন দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি অর্জন।
এক সময় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে অভিহিত বাংলাদেশ যে বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে উঠেছে, এই পরিবর্তনের সূচনা ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতা আসার পর থেকে।
মোট দেশজ উৎপাদন- জিডিপি, মাথাপিছু আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, রাজস্ব আদায়, খাদ্যশস্য উৎপাদন, মূল্যস্ফীতি, আমদানি-রপ্তানিসহ অর্থনৈতিক প্রায় সব সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল দেশের জনগণের মধ্যে সুষমভাবে বণ্টিত হওয়ায় দরিদ্র জনগণের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো দ্রুত কমেছে। মানব উন্নয়ন সূচকেও অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ।
আর্থসামাজিক খাতেও অগ্রগতি চোখের পড়ার মতো। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার প্রায় শতভাগ। শিক্ষার সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সুযোগের সমতা সৃষ্টি হয়েছে।
টিকাদান কর্মসূচি, নিরাপদ পানি সরবরাহ এবং স্যানিটেশনের সুযোগের আওতায় দেশের প্রায় সব জনগণকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
গত এক দশক ধরে দেশের প্রবৃদ্ধির হার ছয় শতাংশের বেশি। অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন, সরকারের কৃতিত্ব হলো একদিকে প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে, অন্যদিকে কমেছে দারিদ্র্যের হার।
তাদের মতে, বাংলাদেশের স্বপ্নের দিগন্ত এখন প্রসারিত হয়েছে। ফলে ৬ শতাংশের বৃত্ত ভেঙ্গে উচ্চ প্রবৃদ্ধির সোপানে পৌঁছেছে বাংলাদেশ।
সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের লক্ষ্য এখন দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি অর্জন। মাথাপিছু আয়ের ধারাবাহিক উত্তরণ ঘটিয়ে ২০২৪ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে যাবে এ দেশ। এরই মধ্যে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশের কাতারে সামিল হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি আমরা।
গত এক যুগে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝে অর্জিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রশংসার দাবি রাখে।
সরকারের দক্ষ সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ফলে রাজস্ব আহরণে ঊর্ধ্বগতি এবং ঋণ গ্রহণে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি, মূল্যস্ফীতিও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অভূতপূর্ব সাফল্য বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে।
বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৭০ কোটি ডলার (১১.৭ বিলিয়ন)। বর্তমানে রিজার্ভ নতুন উচ্চতায় পৌঁছে ৪ হাজার ৩০০ কোটি (৪৩ বিলিয়ন) ডলার ছাড়িয়েছে।
২০০৯ সালে ১১০০ কোটি ডলার (১১ বিলিয়ন) রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে প্রবাসীরা। বিদায়ী বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৭৪ কোটি (২১.২৪ বিলিয়ন) ডলার।
দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ব্যাপক প্রসার হয়েছে গত এক যুগে। এই সময়ে রপ্তানি বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি, আমদানি বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয় হয়েছিল ১ হাজার ৬২০ কোটি (১৬.২ বিলিয়ন) ডলার। গত অর্থবছরে রপ্তানি বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৩০০ কোটি (৩৩ বিলিয়ন) ডলার।
অপরদিকে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে আমদানি হয় ২ হাজার ৩৭০ কোটি (২৩.৭ বিলিয়ন) ডলার। গত অর্থবছরে আমদানি হয় ৫ হাজার একশ কোটি (৫১ বিলিয়ন) ডলার।
নানা সীমাবদ্ধতা থাকার পরও অভ্যন্তরীণ সম্পদ তথা রাজস্ব আহরণ বেড়েছে বহুগুণ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড- এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আয় হয় ৬২ হাজার ৪২ কোটি টাকা। করোনা মহামারির অভিঘাত সামলে গত অর্থবছরে আদায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা।
তবে দেশের অর্থনীতির যে আকার, যে হারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তার সঙ্গে সামাঞ্জস্য নেই রাজস্ব আদায়ে। প্রতিবছর আদায়যোগ্য রাজস্বের তুলনায় এক থেকে দেড় লাখ কোটি টাকা কম আদায় হয় বলে অর্থনীতিবিদ ও রাজস্ব বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
রাজস্ব আদায় বাড়ায় প্রতিবছর বাজেটের আকারও বাড়ছে। গত এক যুগে বাজেটের আকার বেড়েছে পাঁচ গুণের বেশি।
২০০৯-১০ অর্থবছরে ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। চলতি অর্থবছরে বাজেট দেয়া হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার– প্রায় ছয় গুণ।
সঠিক মুদ্রানীতি ও অর্থ সরবরাহ দক্ষতার সঙ্গে অর্থনীতি পরিচালনার চেষ্টা করেছে বর্তমান সরকার। যে কারণে শুরু থেকেই মূল্যস্ফীতির চাপ সহনীয় রয়েছে।
২০০৯-১০ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যমতে, মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ।
ব্যাংক খাতে নানা অনিয়ম ও ঋণ বিতরণে কেলঙ্কারির মধ্যেও আমানত ও ঋণ বিতরণ বেড়েছে। ফলে গতিশীল হয়েছে বেসরকারি খাত।
২০০৯ সালে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা।
২০০৯-১০ অর্থবছরে ব্যাংক আমানতের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকায়।
উৎপাদন অব্যাহতভাবে বাড়ায় বর্তমানে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে তিন কোটি ২৮ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়। গত অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৭০ লাখ টনে।
দারিদ্র্য বিমোচনে ঈষর্ণীয় সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এ অগ্রগতির ফলে বিশ্বের অনেক দেশের জন্য বাংলাদেশ এখন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বর্তমান সরকার যখন প্রথম মেয়াদে ক্ষমতা নেয় তখন দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩৮ শতাংশ। বিবিএসের সর্বশেষ হিসাবে, দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশের কাছাকাছি।
২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশের অর্থনীতির আকার তথা জিডিপি ছিল চলতি মূল্যে ৭ লাখ ৯৭ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকার। গত অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকায়।
২০০৯-১০ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ০৭ শতাংশ। করোনার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ।
তবে করোনার প্রাদুর্ভাবে গত অর্থবছরের বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। গত অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয় ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ।
করোনার মধ্যেও এই অর্জনকে চমৎকার বলে মন্তব্য করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বহুজাতিক উন্নয়ন সহযোগীরা।
বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০০৯-১০ অর্থবছরে মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল ৮৪৩ ইউএস ডলার। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, এখন মাথা পিছু আয় ২ হাজার ৬৪ ডলার, যা প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের মধ্যে ৩৯তম এবং ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) ২৯তম, যা দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়। বর্তমানে এ দেশে বিশ্বের সপ্তম দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতি।
বিশ্বের শীর্ষ স্বল্পোন্নত দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিদায়ী বছরের ২৮ আগস্ট দ্য স্পেক্টেটর ইনডেক্স একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, গত এক যুগে সারা বিশ্বের জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশের অবস্থান এক নম্বরে।
এই সময়ে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ১৮৮ শতাংশ। একই সময়ে বিশ্বের প্রথম সারির অন্যান্য দেশ যেমন ভারতের ১১৭ শতাংশ, ব্রাজিলের ৯৭ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়ার ৯০ শতাংশ।
এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক অতি সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে, যা হবে এশিয়া মহাদেশের সব দেশের ওপরে।
বিশ্বব্যাংকের একটি তথ্য-উপাত্তের ওপরে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকনোমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ গত অক্টোবের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ৪১তম অর্থনীতির দেশ থেকে ২০২৩ সালে ৩৬তম অবস্থান যাবে। আর ২০২৮ সালে অবস্থান হবে ২৭তম এবং ২০৩৩ সালে হবে ২৪তম। সেই সময় বাংলাদেশে জিডিপির আকার হবে ১ ট্রিলিয়ন ডলার।
অর্থনীতিতে এ সাফল্যের পেছেনে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সরকারের নীতি-সহায়তা সহায়ক ভূমিকা হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক ঊর্ধ্বতন পরিচালক ড. জায়েদ বখত।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দীর্ঘ সময় ধরে দেশে রাজনীতি শান্ত থাকায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
এটাকে বর্তমান সরকারের কৃতিত্ব হিসেবে দেখছেন ড. জায়েদ বখত।
তার মতে, পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে করা হচ্ছে। এই বার্তা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা অনেক বাড়িয়েছে। এ ছাড়া আরও মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এগুলোর কাজ শেষ হলে অর্থনীতি আরও এগিয়ে যাবে।