পদ্মা সেতু মেট্রোরেল এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্ণফুলী টানেল উদ্বোধনের ক্ষণ গণনা শুরু হবে এ বছরের শেষে, নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলছে অনেক প্রকল্পে
নিজস্ব প্রতিবেদক:
চলমান অনেক উন্নয়ন প্রকল্প দৃশ্যমান হবে নতুন বছরে। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো মেগা প্রকল্পের কাজ সমাপ্তের পথে এগিয়ে যাবে ২০২১ সালের মধ্যে। এ ছাড়া স্বপ্নের পদ্মা সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেলের একাংশ, কর্ণফুলী টানেলসহ কয়েকটি মেগা প্রকল্প উদ্বোধনের ক্ষণ গণনা শুরু হবে নতুন বছরের শেষে। ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টর্মিনালের কাজে আসবে দৃশমান অগ্রগতি। মেট্রোরেল লাইন-৬-এর পাশাপাশি অন্য লাইনগুলোর কাজও শুরু হবে। যমুনা নদীর ওপর শুরু হওয়া বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর কাজে হবে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরে প্রথম জাহাজ এসে ভিড়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বে-টার্মিনাল নির্মাণকাজে দৃশ্যমান অগ্রগতি হবে এই সময়ে।
পাশাপাশি দেশজুড়ে যে ১০০ ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠা করছে বেজা, তাতে আসবে সাফল্য। বিশেষ করে মিরসরাইয়ে দেশের সর্ববৃহৎ বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের কাজ প্রায় শেষ হয়ে যাবে। সেখানে স্থাপিত বহু শিল্পগোষ্ঠীর কারখানা চলে যাবে উৎপাদনে। ফলে বাড়বে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি আয়। সব মিলিয়ে উন্নয়নের দৃশ্যমান বছর হবে ২০২১। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চলতি বছরের প্রথম দিকে বিশ্বব্যাপী করোনার আঘাত শুরু হওয়ায় সামগ্রিক কাজকর্মে কিছুটা ছেদ পড়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজও বন্ধ ছিল মার্চ-মে সময়ে। ফলে আগামী বছর যেসব প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা সেগুলো সমাপ্ত করতে গতি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আবার এদিকে চলছে করোনার দ্বিতীয় দফা সংক্রমণ। এর পরও যেহেতু আগের মতো আতঙ্ক নেই, তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনেই প্রকল্পগুলোর কাজে গতি আনতে হবে বলে মনে করেন তিনি। এ লক্ষ্য সামনে রেখে উন্নয়ন প্রকল্পের প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান ঠিক রাখতে অর্থায়নের বিকল্প পথের কথাও ভাবছে সরকার। আসছে নতুন বাজেটে থাকবে নির্দেশনা। এনবিআরের রাজস্ব বাড়ানোর গুচ্ছ পরিকল্পনাও থাকবে বাজেটে। এ ছাড়া বৈদেশিক সহায়তা বাড়ানোর বিষয়ে পদক্ষেপ থাকবে। কেননা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে গেলে এমনিতেই একটা ধাক্কা খাবে বৈদেশিক সহায়তা। যদিও নিয়ম অনুযায়ী এলডিসির সব সুযোগ-সুবিধা ২০২৪ পর্যন্ত ভোগ করতে চায় বাংলাদেশ। এদিকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে শিফটিং পদ্ধতিতে অবিরাম ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলছে অনেক প্রকল্পে। মার্চ-জুনে করোনার ধাক্কায় পিছিয়ে যাওয়া প্রকল্পগুলোর কাজে গতি এনে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চায় সরকার। এসব প্রকল্পের সামগ্রিক কাজের মনিটরিংও জোরদার করা হয়েছে। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে নিয়োজিত কর্মীদের প্রকল্প এলাকার বাইরে যাতায়াত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ছুটিতে যাওয়া বিদেশি শ্রমিক, টেকনিশিয়ানসহ প্রকৌশলীর প্রায় সবাই আবার কাজে ফিরে এসেছেন বিশেষ ব্যবস্থায়। সব ধরনের পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয়ের আওতায় সব ধরনের যানবাহন কেনা আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। তবে প্রকল্পের কাজের গতি যেন না কমে সেদিকে তীক্ষè দৃৃষ্টি রাখা হচ্ছে বলে অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেট্রোরেল লাইন-৬-এর প্রকল্প পরিচালক মো. আফতাবউদ্দিন তালুকদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি নির্ধারিত সময়ে কীভাবে কাজটা শেষ করা যায়। একই সঙ্গে মার্চ-জুনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতেও আমরা অবিরাম কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। করোনার ঝুঁকি রয়েছে এ জন্য সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কাজ করছেন সংশ্লিষ্টরা।’ ইতিমধ্যে বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজে স্বাভাবিক গতি ফিরেছে। এ প্রকল্পের সব স্প্যান বসানো সম্পন্ন করেছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। নভেম্বর পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৮২ শতাংশ। আশা করা হচ্ছে ২০২২ সালের জুনের আগেই এ প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হবে। নভেম্বর পর্যন্ত পদ্মা সেতুতে রেললিঙ্ক প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ২৮ শতাংশ। একইভাবে চলছে মেট্রোরেল লাইন-৬-এর কাজ। আশা করা হচ্ছে আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এ প্রকল্পের প্রথম অংশ দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সম্পন্ন হবে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজও এগিয়ে চলেছে। বাস র্যাপিড ট্রানজিটের (বিআরটি) কাজেও গতি ফিরেছে। ইতিমধ্যে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। মার্চে খুলে দেওয়া হয়েছে ৫৫ কিলোমিটারের এক্সপ্রেসওয়েটির মূল অংশ। এ প্রকল্পের দ্বিতীয় অংশ তেঘরিয়া থেকে বাবুবাজার ব্রিজ পর্যন্ত ৩ কিলোমিটারের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ অংশের আড়াই কিলোমিটারই এলিভেটেড এবং বাকি অংশ সমতলভূমিতে নির্মিত। এর ফলে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা এগিয়ে যাবে আরেক ধাপ। ঝিলমিলবাসীও এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতে পারবেন তেঘরিয়া থেকে। এ প্রকল্পের কাজও শেষ হবে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে এমনটাই আশা করা হচ্ছে। এদিকে পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ প্রকল্পের কাজেও গতি ফিরেছে। যদিও এ প্রকল্পের কাজের সময়সীমা কিছুটা দীর্ঘায়িত হবে। আগে পরিকল্পনা ছিল একই দিন যান ও রেল চলাচলের জন্য প্রস্তুত করা হবে পদ্মা সেতু প্রকল্প। এখনো বলা হচ্ছে সেতুর ওপর নির্মিত রেললাইনের কাজ নির্ধারিত সময়েই শেষ হবে। তবে দুই পাশের সংযোগ লাইনের কাজে অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন হবে। জানা গেছে, যোগাযোগের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণ করা হচ্ছে প্রায় ৪ কিলোমিটারের সুড়ঙ্গপথ, যার নাম দেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু টানেল। গত বছর নভেম্বর পর্যন্ত এ প্রকল্পের কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৬১ শতাংশ। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হওয়ার কথা থাকলেও ২০২১ সালের মধ্যেই কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। সে লক্ষ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো অবিরাম কাজ করছে। ঢাকা শহরের চারদিকে সাবওয়ে নির্মাণকাজের সমীক্ষা প্রায় শেষ করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে এ প্রকল্পের মূল কাজ শুরু হবে নতুন বছরের প্রথম প্রান্তিকে। এ প্রকল্পের কাজের তেমন কোনো দৃশ্য এখনো চোখে পড়ে না। মূল কাজ শুরুর মাধ্যমে এটি দৃশ্যমান হবে বলে মনে করে সরকার। এদিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্মাণাধীন তৃতীয় টার্মিনালের কাজেও গতি ফিরেছে। করোনা মহামারীর কারণে লকডাউনকালে যেসব শ্রমিক ও টেকনিশিয়ান নিজ দেশে গিয়ে আটকা পড়েন, তার অধিকাংশই ফিরে এসে কাজে যোগ দিয়েছেন। জানা গেছে, বিশ্বের অত্যাধুনিক, দৃষ্টিনন্দন বিমানবন্দরগুলোর সমতুল্য হবে তৃতীয় টার্মিনাল, যেখানে থাকবে ইংল্যান্ডের হিথ্রো, সিঙ্গাপুরের চেঙ্গি কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরের মতো আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা। উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশ যে আর্থসামাজিকভাবে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, এর একটা ইতিবাচক বার্তা দেবে এ টার্মিনাল। বিমানবন্দরে নেমেই বিদেশি বিনিয়োগকারী, পর্যটকসহ বিদেশ থেকে আগতদের মধ্যে সৃষ্টি করবে এক ধরনের ইতিবাচক মনোভাব। সূত্র জানান, নির্মাণাধীন এই তৃতীয় টার্মিনালের সংযোগ সড়ক সুড়ঙ্গপথে সরাসরি যুক্ত হবে মেট্রোরেল লাইন-১-এর সঙ্গে। মেট্রোরেল লাইন-১ মূলত বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল থেকে শুরু হয়ে খিলক্ষেত, যমুনা ফিউচার পার্ক, নতুনবাজার, বাড্ডা, রামপুরা, হাতির ঝিল, মালিবাগ, রাজারবাগ হয়ে কমলাপুরে শেষ হবে। ফলে বিমানবন্দরে নেমেই মেট্রো ধরে যাত্রীরা সরসারি রেলস্টেশনে যেতে পারবেন। শুধু তাই নয়, তৃতীয় টার্মিনালের সঙ্গে যুক্ত প্রস্তাবিত সাবওয়ে ও নির্মাণাধীন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। টার্মিনালটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আসছে জাপানি কোম্পানি। ইতিমধ্যে জাপানের একাধিক কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে টার্মিনালটি রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা করতে চায় সরকার। আশা করা হচ্ছে জাপানি কোম্পানি শিগগিরই এ কাজের সঙ্গে যুক্ত হবে। অবশ্য টার্মিনালটি নির্মাণের কাজেও নিয়োজিত রয়েছে জাপানি কোম্পানি।এদিকে গত কয়েক বছরে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ, নবীনগর ডিইপিজেড-চন্দ্রা-যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ, মিরপুর ফ্লাইওভার, হাতির ঝিল, হানিফ ফ্লাইওভার, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার, কুড়িল ফ্লাইওভার, বনানী ফ্লাইওভারসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে। চলমান এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে সড়কপথে চাপ কমবে। এর মাধ্যমে যেমন যানজট কমবে, তেমনি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণে জ্বালানি ও সময় উভয়ই সাশ্রয় হবে। কমে আসবে পণ্য পরিবহন ব্যয়। এদিকে বহুল প্রত্যাশিত ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে হাইস্পিড রেল স্থাপন প্রকল্পের কাজ খুব দ্রুতই শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।