নিজস্ব প্রতিবেদক:
গত ১০ বছরে ৭৫০ কোটি মার্কিন ডলার (৬০ হাজার কোটি টাকা) ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত। কিন্তু এ পর্যন্ত ছাড় করা হয়েছে ১০ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা (১২৬ কোটি ডলার)। আবার ছাড় করা অর্থে বাস্তবায়িত প্রকল্পের গতিও কম।
এমন পরিস্থিতিতে ভারতীয় ঋণ প্রকল্পের কার্যক্রম মনিটরিং করতে গঠন করা হয়েছে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে অর্থ মন্ত্রণালয় এ কমিটি গঠন করেছে।
আট সদস্যের কমিটির প্রধান হচ্ছেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
সূত্র মতে, ভারতীয় ঋণ ও ঋণের আওতায় চলমান প্রকল্পের কার্যক্রম করতে এখন থেকে এই কমিটি ‘লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) প্রকল্প বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
এছাড়া ভারতীয় নমনীয় ঋণের পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংশোধনসহ অন্যান্য নীতিনির্ধারণী সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। পাশাপাশি কমিটি চলমান প্রকল্পে কার্যক্রমের অগ্রগতি নিয়ে বছরে একবার বা প্রয়োজনে একাধিকবার বৈঠক করবে।
সূত্র আরও জানায়, এলওসি ও জয়েন্ট মিটিং টিম যেসব দিকনির্দেশনা চাইবে এ কমিটি তা উপস্থাপন করবে। এছাড়া ভারতীয় অনুদান সংক্রান্ত নীতিগত সিদ্ধান্ত এ কমিটির মাধ্যমে অনুমোদন করানো হবে।
প্রয়োজন মনে করলে কমিটি আরও সদস্য বাড়াতে পারবে। কমিটির বাকি সদস্য হলেন ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য, পররাষ্ট্র, অর্থ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদা কর্মকর্তা ও প্রধানমন্ত্রীর কার্র্যালয়ের মহাপরিচালক।
কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন অর্থনীতি সম্পর্ক বিভাগের এশীয় অনুবিভাগের প্রধান। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, মূলত ভারতীয় ঋণে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের গতি বাড়াতে সরকারপ্রধান এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কারণ প্রকল্পে কার্যক্রম এবং ঋণের অর্থ ছাড়ে অনেক ধীরগতি রয়েছে। জানতে চাইলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এশিয়া উইংয়ের প্রধান শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী শনিবার যুগান্তরকে বলেন, সরকারের গঠিত কমিটি প্রকল্পের কার্যক্রমের গতি নিয়ে শিগগির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করছি।
তবে এলওসি’র প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ধীরগতি হচ্ছে এটি বলা যায় না। কেননা অধিকাংশ প্রকল্পই রয়েছে কেনাকাটা পর্যায়ে। মাটির কাজ, ইউটিলিটি স্থানান্তরসহ অন্য কাজগুলো অনেক প্রকল্পের এখনও শেষ হয়নি। ফলে অর্থছাড় কম মনে হচ্ছে।
কেনাকাটার স্তর থেকে বের হলেই অর্থছাড় অনেক বেড়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, তৃতীয় এলওসি’র প্রায় সব প্রকল্পেরই ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) তৈরির কাজ চলছে। এসব প্রকল্প যখন বাস্তবায়ন পর্যায়ে আসবে। এতেও অর্থছাড় বেড়ে যাবে।
ভারতীয় ঋণে এ পর্যন্ত ৪৬টি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। কিন্তু এরই মধ্যে কাজ শেষ হয়েছে ১৪টির।
আর ৮টির কাজ চলমান এবং ১১টি প্রকল্পের দরপত্র (প্রকিউরমেন্ট) প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া চলমান এবং ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) সংশোধন বা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে ১৩টি প্রকল্পের।
ইআরডির সূত্র জানায়, প্রথম লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় ভারত ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে ঋণ ৮০ কোটি ডলার এবং অনুদান ২০ কোটি ডালার।
গত অক্টোবর পর্যন্ত প্রথম এলওসি ঋণের মধ্যে ছাড় হয়েছে মাত্র ৬১ কোটি ৮৯ লাখ ডলার (৫ হাজার ২৫০ কোটি টাকা)। এর আওতায় ১৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা।
কিন্তু সর্বশেষ তথ্য মতে, ১২টি প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ হয়েছে, চলমান আছে আরও ৩টির কাজ। ২০১০ সালে প্রথম লাইন অব ক্রেডিট হিসেবে এর চুক্তি হয়েছিল।
২০১৫ সালের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় দ্বিতীয় এলওসির আওতায় ২০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার বিষয়ে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়।
দ্বিতীয় এলওসির আওতায় এই ক্রেডিট স্কিমের মধ্যে নভেম্বর পর্যন্ত ছাড় হয়েছে ৯ কোটি ২৫ লাখ ডলার (৭৮৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা)। এ ঋণের আওতায় ১৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে।
এর মধ্যে দুটি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। আর চারটির কাজ চলছে। আরও চারটি প্রকল্পের দরপত্র কার্যক্রম চলছে এবং পাঁচটি প্রকল্পের ডিপিপি তৈরি বা সংশোধনের কাজ চলমান আছে।
আর তৃতীয় এলওসির আওতায় প্রতিশ্রুত ৪৫০ কোটি ডলারের মধ্যে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত ছাড় হয়েছে ৫৪ লাখ টাকা।
২০১৭ সালের অক্টোবরে ঢাকায় তৎকালীন ভারতীয় অর্থমন্ত্রী অরুন জেটলি এবং বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উপস্থিতিতে ৪৫০ কোটি ডলারের তৃতীয় এলওসি’র ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
এর আওতায় ১৬টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা। সর্বশেষ তথ্য মতে, একটি প্রকল্পের (রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র) কাজ চলমান। সাতটি প্রকল্পের দরপত্র সংক্রান্ত কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন এবং ৮টি প্রকল্পের ডিপিপি তৈরির কাজ চলছে।
তৃতীয় এলওসির আওতায় নেয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বুড়িগঙ্গা রিভার রেস্টরেশন, চট্টগ্রাম বন্দরে মাল্টিপারপাস কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপন, পায়রা বন্দরের টার্মিনাল নির্মাণ, বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ, সৈয়দপুর বিমানবন্দর উন্নীত, ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত, চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের বারইয়ারহাট থেকে খাগড়াছড়ির রামগড় পর্যন্ত সড়ক চার লেনে উন্নীত, মীরসরাই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে এক লাখ এলইডি বাল্ব সরবরাহ, ঈশ্বরদীতে রেল ও সড়কপথের জন্য আইসিডি নির্মাণ, মোংলা ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তরল বর্জ্য শোধনাগারের যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর হয়ে সরাইল পর্যন্ত চার লেন সড়ক নির্মাণ প্রকল্প। প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রস্তাবে প্রাথমিক সম্মতি, পরামর্শক নিয়োগ ও নির্মাণ কাজের দরপত্র দলিলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেতে সময় প্রয়োজনীয়তার কারণে বাস্তবায়ন কাজ শুরু করতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। এছাড়া ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে গতি কম, এক্সিম ব্যাংক তাদের ইচ্ছামতো অর্থছাড় করাও প্রকল্পের ধীরগতির অন্যতম কারণ।