রবিবার , সেপ্টেম্বর ২৯ ২০২৪
নীড় পাতা / জাতীয় / আল্লামা শফীকে কি মেরে ফেলা হয়েছে

আল্লামা শফীকে কি মেরে ফেলা হয়েছে

নিউজ ডেস্ক:
হেফাজতের প্রয়াত আমিরের পরিবার থেকে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে গত ১৬ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাটহাজারী মাদ্রাসা এবং হাসপাতালে ঘটা ঘটনাবলী বিবৃত করা হয়েছে। এতে দাবি করা হয়েছে, শফীকে চাপ দিয়ে, হত্যার হুমকি দিয়ে অসুস্থ করা হয়েছে। তাকে চিকিৎসা করাতে বাধা দেয়া হয়েছে। এমনকি অক্সিজেনের নল খুলে দেয়া হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সে উঠতে বাধা দেয়া হয়েছে।

হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমেদ শফীর মৃত্যুকে ঘিরে বিতর্ক নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে। তার জীবনের শেষ তিনটি দিনে যা যা হয়েছিল, সেসব ঘটনা উল্লেখ করে ৩২ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রয়াত হেফাজত নেতার নাতি মাওলানা আরশাদ ও আল্লামা শফীর দেখভালের দায়িত্বে থাকা খাদেম হোজাইফা আহমদের জবানবন্দি বিবৃত করা হয়েছে এই পুস্তিকায়।

এই দুই প্রত্যক্ষদর্শী যা বলেছেন, তাতে মনে হচ্ছে, গত ১৬ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর হেফাজতের সদর দফতর চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় যা যা ঘটেছে, তার প্রতিক্রিয়াতেই অসুস্থ হয়েছেন হেফাজতের সে সময়ের আমির।

এই দুই জনের অভিযোগ, আল্লামা শফীকে ওষুধ খেতে দেয়া হয়নি, তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা হয়েছে, তার জিনিসপত্র ভাঙচুর করা হয়েছে, তাকে অ্যাম্বুলেন্সে উঠতে বাধা দেয়া হয়েছে, অক্সিজেনের নল খুলে দেয়া হয়েছে। এক পর্যায়ে নলটি ছিড়ে ফেলা হয় যেন সেটি আর ব্যবহার করা না যায়।

এই দুই জনের অভিযোগ, ‍তিন দিনের হাঙ্গামার পরে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকরা দেরি হয়ে গেছে বলে জানান।

আবনায়ে দারুল উলুম হাটহাজারী প্রকাশনা থেকে ‘হাটহাজারীতে জীবনের শেষ তিন দিন’ নামে পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয়। বইয়ে আল্লামা শফীকে ‘শহীদ শাইখুল ইসলাম’ আখ্যা দেয়া হয়েছে।

যদিও হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমান ফয়েজী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই বই ভুয়া। সব কথা মিথ্যা। শিগগিরই আমরা এই বইয়ের প্রতিক্রিয়া জানাব।’

‘আহমদ শফীর মৃত্যুর দেড় মাস পর এই পুস্তিকা প্রকাশ কেন, আর বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমকে জানাননি কেন?’

জবাবে আল্লামা শফীর নাতি মাওলানা আরশাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ভীত ছিলাম। কারণ দাদার সঙ্গে যা ঘটেছে, আমাদের সঙ্গে যে কোনো কিছু ঘটতে পারে। সে জন্য আমরা পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এই পুস্তিকা করেছি।’

গত ১৫ নভেম্বর সম্মেলন করে জুনাইদ বাবুনগরীকে আমির ঘোষণা করে হেফাজত।

তার আগের দিন এই সম্মেলন না করার দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আহমদ শফীর শ্যালক মঈন উদ্দিন ও গত কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মঈনুদ্দীন রুহী।

রুহী সেদিন মাদ্রাসার ঘটনাবলী উল্লেখ করে বলেন, ‘এতে তিনি (আল্লামা শফী) ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ অবস্থায় হজরতের অক্সিজেন লাইন বারবার খুলে দেওয়ায় তিনি মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং কোমায় চলে যান।

‘অনেক কষ্ট করে চিকিৎসার জন্য বের করা হলেও রাস্তায় পরিকল্পিতভাবে অ্যাম্বুলেন্স আটকিয়ে সময়ক্ষেপণ করে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।’

আহমদ শফীর শ্যালক মঈন উদ্দিন বলেন, ‘আল্লামা শাহ আহমদ শফী হুজুর জামায়াত-শিবিরের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার।’

শফীর জীবনের শেষ দুই দিন যা হয়েছিল হাটহাজারী মাদ্রাসায়

হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে শফীপুত্র আনাস মাদানীকে বহিষ্কার, হেফাজতের বর্তমান আমির জুনাইদ বাবুনগরীসহ অব্যাহতি দেয়া তিন শিক্ষককে ফিরিয়ে আনাসহ ছয় দফা দাবিতে ১৬ সেপ্টেম্বর জোহরের নামাজের পর বিক্ষোভ শুরু হয়।

পুস্তিকায় প্রথমে আন্দোলনের সূত্রপাত নিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে।

সে সময় শাহ আহমদ শফী সুস্থ ও স্বাভাবিক ছিলেন বলে জানানো হয় এতে।

সেদিনের ঘটনা প্রবাহ বর্ণনা করে খাদেম হোজাইফা আহমদ বলেন, ‘সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফীও সুস্থ, স্বাভাবিক ছিলেন। হজরতের ছেলে আনাস মাদানী ঢাকায় ছিলেন।

“দুপুরে হজরত (আল্লামা শফী) জোহর নামাজ পড়লেন। নামাজ পড়ে দারুল হাদিসের ক্লাসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় দাওরার কিছু ছাত্র হুজুরের কামরায় প্রবেশ করে বলল, ‘হুজুর, দুপুরের খাবার খেয়ে নিন।”

হুজুর বললেন, ‘এখন না, আমি দরস শেষ করে এসে খাব।’

হুজুরকে দারুল হাদিসে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। ঠিক ওই মুহূর্তে (জোহরের নামাজের পর) মাঠে হৈ চৈ শুনতে পেয়ে একজন শিক্ষক শফীর কামরায় এসে খবর দেন, ছাত্ররা মাঠে চিৎকার করছে, আনাস মাদানীর বহিষ্কারের দাবি জানাচ্ছে।

এসব শুনে উপস্থিত ছাত্র ও খাদেমরা শাহ আহমদ শফীর নিরাপত্তার জন্য জানালার গ্লাস, দরজা সব বন্ধ করে দেন। সব ঘটনা শুনে হেফাজত আমির বিব্রত বোধ করেন।

কিছুক্ষণের মধ্যে আনাস মাদানীর কক্ষ ভাঙচুর করা হয়। পরে মাদরাসার মুঈনে মহতামিম শেখ আহমদের দরজা ভেঙে তাকে নিয়ে আসা হয়।

শফীর কার্যালয়ে যা হয়

পুস্তিকা অনুযায়ী, “শেখ আহমদ সাহেবের সঙ্গে ‘উগ্রপন্থী নেতা’ হাসানুজ্জামানের নেতৃত্বে পাঁচ জনের একটি দল আল্লামা শফীর কার্যালয়ে যান। খাদেম হোজাইফা বলেন, ‘তারা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে এবং তার ছেলে আনাস মাদানীকে বহিষ্কার করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে।’ তখন শফী সাহেব হুজুর বলেন, ‘আনাসের যেসব দোষ রয়েছে, তা লিখিত আকারে অভিযোগ করে জানাও, আমি দস্তখত দিব।

“কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ উপস্থাপন করতে না পারায় আল্লামা শফী সাহেব চুপ করে থাকেন। আর শফী বারবার বলছিলেন, ‘অভিযোগ লিখিত আকারে উপস্থাপন করো, আমি দস্তখত করব। কিন্তু বাবারা তোমরা এইভাবে আমার সাথে দুর্ব্যবহার করো না।”

পুস্তিকায় আরও বলা হয়, “এরপর ‘উগ্রপন্থীদের’ ২০-২৫ জনের আরেকটি দল কার্যালয়ের সামনে উপস্থিত হয়। তারাও কক্ষে ঢুকে অশালীন বাক্য ব্যবহার ও আনাস মাদানীকে বহিষ্কারের জন্য হুমকি-ধামকি দিতে থাকে বলে জানিয়েছেন হোজাইফা।”

পুস্তিকায় উল্লেখ করা হয়, “তাদের বেশ কয়েকজন হজরতের কামরায় প্রবেশ করে চিৎকার চেচামেচি শুরু করে। তুই-তুকারি করে খাদেমদের গালিগালাজ করতে থাকে। হজরতের (আল্লামা শফী) শানে অশালীন বাক্য ব্যবহার করে। এতে হজরত খুব পেরেশান ও অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন। তারা হজরতকে দ্রুত আনাস মাদানীকে বহিষ্কার করতে হুমকি-ধমকি দিতে থাকে। এই সময় মাগরিবের আজান হয়।”

শুরার বৈঠকে চাপ

শফীর খাদেম জানান, মাগরিবের নামাজের পর আন্দোলনকারীরা কয়েকজন শিক্ষককে নিয়ে শুরার বৈঠক করেন। সেখানেও আনাস মাদানীকে বহিষ্কারের চাপ দেয়া হয়। শফী রাজি না হওয়ায় তার কক্ষের গ্লাস, ফুলের টব ভাঙচুর করা হয়।

পুস্তিকায় বলা হয়, “আল্লামা শফীকে চাপ দিতে একটি প্যাডে আনাস মাদানীর বহিষ্কারাদেশ লিখে তাতে সই দিতে তার সবচেয়ে প্রিয় নাতি দেওবন্দপড়ুয়া আসাদের গলায় গ্লাসের টুকরো ধরে বলা হয়, ‘এখন এটা দিয়ে টান মেরে ওর গলা কেটে ফেলব, জলদি দস্তখত কর এখানে। তখন আল্লামা শফীর চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল।

এতেও কাজ না হওয়ায় আল্লামা শফীর ব্যক্তিগত সহকারী (খাদেম) মাওলানা শফিউল আলমকে রড দিয়ে আঘাত করা হয়, চড়-ঘুষি মারা হয়। তখন আল্লামা শফীকে ‘সরকারের দালাল’, ‘মুনাফিক’সহ নোংরা ভাষায় গালাগাল চলছিল।

এক পর্যায়ে জবরদস্তির মাধ্যমে আহমদ শফীর সই আদায় করে মাঠে গিয়ে মাইকে আনাস মাদানীর বহিষ্কারের ঘোষণা দেয়া হয়।”

আহমদ শফীর কার্যালয় ভাঙচুর

দ্বিতীয় দিনের ঘটনার বর্ণনা করেছেন আহমদ শফীর নাতি মাওলানা আরশাদ। তিনি জানান, সকাল ১০টার দিকে মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষক আহমদ শফীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন।

এরপর ছড়ানো হয় গুজব। পাগলা ঘণ্টি বাজিয়ে ছাত্রদের জড়ো করা হয়। বলা হয়, ‘শফী সাহেব মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য মিটিং ডেকেছেন। তিনি গতকালকের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন।’

মাওলানা আরশাদ জানান, আন্দোলনকারীরা শফীর কার্যালয়ে এসে শিক্ষকদের বের করে দেন। সেখানকার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে শুরু হয় ভাঙচুর, লুটতরাজ। আহমদ শফীর সব টেবিলের গ্লাস, এসি, গ্লাসে বাঁধাই করা কাবা শরিফের গিলাফ একাধিক সম্মাননা পদক, কার্যালয়ের দরজা জানলাও ভাঙচুর করা হয়।

তিনি আরও জানান, কার্যালয়ের বাইরে কামরার দুই দিকের গ্লাসের দরজা, নামফলক, বারান্দায় থাকা গ্লাসের সীমানা, প্রায় ১০টি জানালার গ্লাস, ৩০টির মতো ফুলের টব, বারান্দার সোফা, টেবিল, ফ্যানসহ ছোটবড় আরও অনেক আসবাবপত্রও ভাঙা হয়।

শফীর অক্সিজেন সাপোর্ট খুলে ফেলা

পুস্তিকার ভাষ্য অনুযায়ী, আহমদ শফীর সামনে তার খাদেমদের বেধড়ক মারধর করা হয়। এক পর্যায়ে হেফাজত আমিরের অক্সিজেন সাপোর্ট খুলে নেয় আন্দোলনকারীরা।

আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী উল্লেখ করে মাওলানা আরশাদ বলেন, ‘তারা হজরতের অক্সিজেন সাপোর্ট খুলে ফেলে। খাদেম ও নাতিরা হজরতকে অক্সিজেন সাপোর্ট দিতে গেলে তাদের বাধা দেয়া হয়।

‘বিদ্যুতের কারণে এসি বন্ধ এবং অক্সিজেন খুলে ফেলায় হুজুরের শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। সন্ত্রাসীদের কাছে হজরতের নাতি ও খাদেমরা অনেক আকুতি-মিনতির পর বিদ্যুৎ সংযোগ ও অক্সিজেন সাপোর্ট দিতে তারা রাজি হয়। অক্সিজেন ও নেবুলাইজারের মাধ্যমে হজরতকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে আহত খাদেমরা।’

শফীকে সুস্থ বলতে চাপ

পুস্তিকায় বলা হয়, এত সব ঘটনার পরও আল্লামা শফী সুস্থ আছেন বলে ঘোষণা দিতে তার নাতি আশরাদকে চাপ দেয়া হয়। তাকে বলতে বলা হয়, কামরায় কোনো প্রকার হামলা হয়নি। আরশাদকে দিয়ে এই ‘মিথ্যা’ ঘোষণা দেয়ানোর পর তাকে আবার কামরায় নিয়ে আসা হয়।

আসরের নামাজের পর আরশাদকে বলা হয়, আল্লামা শফী সুস্থ আছেন জানিয়ে তাকে ভিডিওবার্তা নিতে হবে। কী বলতে হবে, সেটা লিখেও নিয়ে আসে আন্দোলনকারীরা।

আরশাদ অস্বীকার করলে তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। পরে চাপের মুখে তিনি ভিডিওবার্তা দেন।

এরপর আল্লামা শফীকে মাদ্রাসা প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগের চাপ দেয়া হয়। বলা হয়, ‘আপনি পদত্যাগ করে মাদ্রাসার উপদেষ্টা হিসাবে থাকেন।’

পুস্তিকায় বলা হয়, আন্দোলনকারীরা আল্লামা শফীকে বলেন, ‘যদি আমাদের এই কথা মেনে নেন, তাহলে আপনি আমাদের মাথার উপর থাকবেন। আর যদি না মানেন তাহলে পায়ের নিচে দিতে আমরা দ্বিধা করব না।’

নাতি আসাদকে ‘নির্যাতন’

হাঙ্গামার সঙ্গে জড়িতরা শফীর সামনে ছোট নাতি আসাদকে নির্যাতন করে বলেও পুস্তিকায় উল্লেখ করা হয়।

খাদেম হোজাইফা বলেন, ‘হজরত তখন অসহায়ের মতো তাকিয়ে ছিলেন, আর চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি কোনো কথাই বলতে পারছিলেন না। এভাবে হজরতকে মাগরিব পর্যন্ত অমানবিক ও অমানুষিক নির্যাতন করা হয়।’

শফী যখন সংকটাপন্ন

পুস্তিকায় আরশাদ বলেন, মাগরিবের পর শুরা সদস্যরা হেফাজতের সে সময়ের আমিরের কামরায় আসতে থাকেন। সন্ধ্যা সাতটার পর বৈঠক শুরু হয়। তখন অসুস্থ হয়ে পড়েন আল্লামা শফী।

পুস্তিকায় বলা হয়, “হজরতের শরীর ঠান্ডা ও নিথর হয়ে যায়। হজরতের নাতি আরশাদ ও খাদেম মাওলানা শফিউল আলম শুরা সদস্যদের কাকুতি মিনতি করে অনুরোধ করেন, ‘আপনারা তাড়াতাড়ি মিটিং শেষ করুন, হজরতের অবস্থা ভালো নয়। হজরতকে এখনই ইমার্জেন্সি হাসপাতালে নিতে হবে’।”

বারবার অনুরোধ করার পরও শুরা সদস্যরা বৈঠক চালিয়ে যান। আধা ঘণ্টা পর শফীর শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটে।

বৈঠক শেষে নাতি ও খাদেম শফিউল শুরা সদস্যদের অনুরোধ করেন, শফীকে মাদ্রাসা থেকে বের করার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু শুরা সদস্যরা কেউ এগিয়ে আসেনি।

আন্দোলনকারীরা আবার কামরায় ঢুকে সাদা প্যাড দিয়ে সই করতে চাপ দিয়ে বলে, ‘এই বুড়ো, এখানে দস্তখত কর, না হয় গলা চেপে এখনই মেরে ফেলব।’

মাথার উপর রড ধরে বলে, ‘এখনই কিন্তু বাড়ি দিচ্ছি, দ্রুত দস্তখত কর।’

পুস্তিকায় বলা হয়, ‘সন্ত্রাসীরা হুজুরকে সারা দিন কোনো ওষুধ বা খাবার খাওয়াতে দেয়নি। দুই দিনের মানসিক নির্যাতন, কার্যালয় ভাঙচুর, খাবার ও ওষুধ না পেয়ে হজরত পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি বমি করেন। মুখ দিয়ে অনবরত ফেনা বের হচ্ছিল। একসময় চোখ বন্ধ করে ফেলেন শেষবারের মতো।’

তখন নাতি আরশাদ ও খাদেম শফিউল আলম হামলাকারীদের পায়ে ধরেন হাসপাতালে নিতে। তারা প্রথমে বলে, চিকিৎসা করালে মাদ্রাসাতেই ব্যবস্থা করবে।

দুই নাতি ও খাদেম তখন বলেন, শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে।

এভাবে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা চলে যায়। তখন হামলাকারীরা বলতে থাকে, ‘চিকিৎসার দরকার নেই। হুজুর মারা গেলে এখানেই মারা যাবে।’

মাওলানা নোমান ফয়েজীর কাছে আবেদন

পুস্তিকায় বলা হয়, আহমদ শফীকে হাসপাতালে নেয়ার অনুমতি দিতে হেফাজতের সে সময়ের শুরা সদস্য ও বর্তমানে প্রচার সম্পাদক মাওলানা নোমান ফয়েজীকে অনুরোধ করেন দুই নাতি।

তখন নোমান ফয়েজী বলেন, মাদ্রাসা থেকে পদত্যাগের দস্তখত করতে হবে শফীকে। তারপর যা হবার হবে।

তখন নাতি আরশাদসহ খাদেমরা নোমান ফয়েজীকে বলেন তার পদত্যাগের ঘোষণা দিতে। আর নোমান ফয়েজীরা সে ঘোষণা দেয়।

পুস্তিকায় বলা হয়, ‘আসলে এ ব্যাপারে কিছু বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না (আল্লামা শফী)। কোনো দস্তখত করার তো প্রশ্নই উঠে না। দস্তখত করার আগেই তিনি চোখ বন্ধ করে ফেলেন।’

যদিও নোমান ফয়েজী সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তারা এর জবাব দেবেন।

অ্যাম্বুলেন্সে উঠতে ‘বাধা’

পুস্তিকায় বলা হয়, ‘অ্যাম্বুলেন্সে করে আল্লামা শফীকে হাসপাতালে নেয়ার অনুরোধ করলে হামলাকারীরা বলে, তাদের আমিরের নির্দেশ না আসা পর্যন্ত এখান থেকে বের করার কোনো অনুমতি নেই।

কিছুক্ষণ পর হামলাকারীরা বলে, আমিরের নির্দেশ এসেছে। তবে অ্যাম্বুলেন্স আসার আগে শফী সুস্থ আছেন বলে মিডিয়ায় ভিডিও প্রচার করতে হবে।

‘অ্যাম্বুলেন্স আসার পর আন্দোলনকারীদের একজন এসে বলে, হুজুরের সঙ্গে শুধুমাত্র একজন যেতে পারবে। তখন নাতি ও খাদেম শফিউল বলে, হজরতের সার্বিক দেখভাল একজন দ্বারা সম্ভব নয়। কমপক্ষে তিন জনকে যেতে দিন। আন্দোলনকারীরা বলে, আমরা আমাদের আমিরের সাথে কথা বলে জানাচ্ছি।’

পরে সেই আমিরের সঙ্গে ফোনে কথা বলে শফীর সঙ্গে দুই জনকে যেতে দেন হামলাকারীরা। পরে অবশ্য তিন জনকেই যেতে দেয়া হয়।

এই আমির কে, সেই বিষয়টি এখনও জানেন না মাওলানা আরশাদ।

আবার বাধা

পুস্তিকায় বলা হয়, অ্যাম্বুলেন্সটি মাদরাসার শাহী গেট দিয়ে ঢুকতে বাধা দিয়ে কবরস্থানের গেট সংলগ্ন বাইতুল আতিক মসজিদের সামনে রেখে দেয়া হয়। ফলে আল্লামা শফীকে অ্যাম্বুলেন্সে উঠাতে আরও দেরি হয়।

স্ট্রেচারে নিয়ে যাওয়ার সময় শফীর মুখে অক্সিজেন লাগানো ছিল। সেটি টান দিয়ে বারবার খুলে ফেলা হচ্ছিল। একপর্যায়ে ছিড়ে ফেলা হয়। পরে অক্সিজেন ছাড়াই তাকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়।

অ্যাম্বুলেন্স ছাড়ার সময় শফীর খাদেম হোজাইফাকে টেনেহিঁচড়ে মারধর করে নামিয়ে দেযা হয়। তখন নাতি আরশাদ একাকী রওনা হন। তখন হামলাকারীরা নতুন দাবি নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখে।

তারা বলতে থাকে, স্থানীয় এমপি ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে এসে সই দিতে হবে যে, ভবিষ্যতে আন্দোলনকারীদের কোনো ক্ষতি হবে না। তা না হলে অ্যাম্বুলেন্স যেতে দেয়া হবে না।

পুস্তিকায় বলা হয়, ‘এভাবে আরও ৪৫ মিনিট সময় অতিবাহিত হয়। তখনই অক্সিজেন না পাওয়ায় হুজুর একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়েন। সেখানে দায়িত্ব পালনরত ওসি সাহেবের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের মিটিং হয়। মিটিংয়ের আলোচনা অজানা। মিটিং শেষ হলে হজরতের অ্যাম্বুলেন্স ছেড়ে দিতে মসজিদের মাইকে কয়েকবার ঘোষণা দেয়া হয়। এরপর অ্যাম্বুলেন্স ছেড়ে দেয়া হয়। পুলিশি পাহারায় অ্যাম্বুলেন্স চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছে।’

‘দেরি হয়ে গেছে’

পুস্তিকায় বলা হয়, ‘রাত দেড়টায় আল্লামা শফীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা বলেন দেরি হয়ে গেছে। অক্সিজেন না থাকার কারণে হুজুরের যে ক্ষতি হয়েছে, তা তাদের পক্ষে চিকিৎসা দ্বারা পূরণ করা সম্ভব নয়।

পরদিন শুক্রবার দুপুর ১২টায় ডাক্তাররা বোর্ড মিটিংয়ে বসেন। তারা নাতি আরশাদকে জানান, তাদের চেষ্টা ব্যর্থ।’

পুস্তিকার তথ্য অনুযাযী, বিকেল সোয়া চারটায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে পুরান ঢাকার আসগর আলী হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হন শফীর অনুসারীরা। সন্ধ্যা ৬টার আগেই তাকে হাসপাতালে জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়। কিছুক্ষণ পর তিনি মারা যান।

সূত্র: নিউজ বাংলা ২৪ ডট কম

আরও দেখুন

নাটোরে সিংড়ায় সংখ্যালঘুদের মানববন্ধন

নিজস্ব প্রতিবেদক: নাটোরে সিংড়ায় সংখ্যালঘু নারীকে ধর্ষণ, নির্যাতন চাঁদাবাজি বন্ধের প্রতিবাদে ও ধর্ষককে গ্রেফতারের দাবিতে …