নিজস্ব প্রতিবেদক:
চলতি বছরই উৎপাদন শুরু হচ্ছে মিরসরাই শিল্পাঞ্চলে। প্রাথমিকভাবে সেখানে ১৩ বিলিয়ন ডলারের দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আশা করেছিল বাংলাদেশ। তবে প্রত্যাশা ছাপিয়ে তা ৩০ বিলিয়নে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে জিনুয়ান নামের একটি বিদেশি কেমিক্যাল কারখানা উৎপাদনে যাওয়ার সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেছে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, মিরসরাইয়ের চরাঞ্চলের ৩৫ হাজার একর জমির ওপর প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু শিল্পাঞ্চলের সীমানা ও বিনিয়োগ দুটিই বাড়ছে। ফেনীতেও ১০ হাজার একর জায়গা নতুন করে অধিগ্রহণ করতে হচ্ছে। ফেনী নদীর ওপর দুটি সেতু নির্মাণ করে তা মূল প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। এখানে ১৫ লাখ মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান হবে। ৪০ লাখ মানুষের বসবাসের উপযোগী করে উপশহর হবে। শিল্প অঞ্চলের ভেতরেই থাকবে দুটি পাঁচ তারকা হোটেল। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় এ শিল্পাঞ্চলকে ঘিরে অনেকগুলো প্রকল্প চলমান রয়েছে, যা শেষ হতে ১০ বছর লাগবে।
২০১৫ সালে উন্নয়ন কার্যক্রম শুরুর পর করোনা ভাইরাসের কারণে অগ্রগতি কিছুটা পিছিয়ে পড়ে। এর পরও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা বেজার। গত শনিবার মিরসরাই
শিল্পাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, উপকূলীয় এক চরাঞ্চলকে রাতারাতি বিরাট বেড়িবাঁধ দিয়ে সুরক্ষিত করা হয়েছে। এখনই সেই বেড়িবাঁধের দৈর্ঘ্য ২৩ কিলোমিটার, যা পর চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে যুক্ত হবে। সেই সঙ্গে এটি চার লেনের সড়কে পরিণত হবে। সাগর থেকে বালু তুলে সেটি ভরাটে দিনরাত কাজ চলছে। ১২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ডুয়েল ফুয়েল (দুই ধরনের জ্বালানিবিশিষ্ট) একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের কাজও শেষ হয়েছে। জোরেশোরে চলছে সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ। নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব আনসার বাহিনীর পাশাপাশি পুলিশের ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়েছে। দুই লেনের সড়কের বেশিরভাগ অংশেরই কার্পেটিংয়ের কাজ শেষ। কর্মকর্তারা বলেছেন, আগামী এক বছরেই মূল সড়ক চার লেনে উন্নীত হবে।
শিল্পাঞ্চলের দুপাশে উপকূলীয় বনাঞ্চলে সারি সারি কেওড়া গাছ। সেখানে হরিণসহ বন্যপ্রাণীর এক সময় ব্যাপক বিচরণ থাকলেও এলাকাবাসী জানায়, অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজ শুরুর পর এখন আর আশপাশে হরিণ নেই। সীতাকু- উপকূলীয় এলাকার দিকে চলে গেছে।
মিরসরাই সদর থেকে ১৭ কিলোমিটার পশ্চিতে ইছাখালী ইউনিয়নের চরাঞ্চলে বঙ্গবন্ধু শিল্প অঞ্চলের অবস্থান। বিরাট কর্মযজ্ঞের মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণের টাকা পরিশোধের কাজ যেমন চলছে, তেমনি চলছে শিল্প কারখানা স্থাপনের কাজও। দেশীয় বড় শিল্প গ্রুপের পাশাপাশি ছয়টি দেশের বিনিয়োগ সম্পর্কেও নিশ্চিত হয়েছে বেজা কর্তৃপক্ষ। বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, ইতোমধ্যে চীন, জাপান, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারতের একাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান এখানে জায়গা কিনেছে। বিশ্বব্যাংক সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ ও সাগরের পানি লবণমুক্ত করার প্রকল্পে অর্থ জোগান দিচ্ছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পিএইচপি, বসুন্ধরা, টিকেসহ বড় শিল্পগ্রুপগুলো এখানে বিনিয়োগ শুরু করেছে। বসুন্ধরা ৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের কাজ শুরু করেছে।
এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রকল্পটির কারণে তারা খুশি। এর কারণ হলো- ইছাখালীর ওই চরাঞ্চল ছিল মূল বসতি থেকে অনেক দূরের একটি জায়গা, যেখানে উপকূলীয় বনাঞ্চল ছাড়া কিছু ছিল না। জমিগুলো অনেক নিচু। ফলে সেখানে কিছু দখলদার পুকুর বানিয়ে মাছ চাষ করত, কেউবা ডোবায় জাল দিয়ে মাছ ধরত। শীতকালে একটি বড় এলাকা পরিণত হতো গরু আর মহিষের চারণভূমিতে। সেই নিচু জায়গা এখন সাগর থেকে বালু তুলে ভরাট করা হচ্ছে। প্রতিদিনই দেশি-বিদেশি কোম্পানির লোকজন আসছেন। শিল্প এলাকার বাইরে লোকজন নানা ধরনের ব্যবসা বের করে নিচ্ছে। আশপাশের জমির দামও অতি দ্রুত বেড়ে চলেছে। ধুম পড়েছে নতুন করে জমি বেচাকেনার।
বেজার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জমি অধিগ্রহণের সময় মৌজা দরের চেয়ে তিনগুণ টাকা দেওয়ার পরও প্রকল্প অঞ্চল থেকে উচ্ছেদ হওয়া ৪০০ পরিবারকে বাড়িঘর নির্মাণ করে দেওয়া হবে। প্রকল্পের পাশেই বাড়ি হওয়ায় তারাও সহজেই এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে কাজ করতে পারবেন। উপজেলা ভূমি অফিস সূত্র জানায়, ৩৫ হাজার একর জমিতে বঙ্গবন্ধু শিল্প অঞ্চল গড়ে উঠলেও সরকারকে অধিগ্রহণ করতে হচ্ছে মাত্র আট হাজার একর জমি। বাকি জমি সরকারি খাস খতিয়ানের।
জানা যায়, ইতোপূর্বে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পসহ সরকারের একাধিক অগ্রাধিকার প্রকল্প ঠেকে যায় কেবল ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতায়। কোনো কোনো সরকারি কর্মকর্তারার বিরুদ্ধে দুর্নীতিরও অভিযোগ উঠেছে। কক্সবাজারের সাবেক এক জেলা প্রশাসক বর্তমানে কারাগারেও আছেন। মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে যেন সেই সমস্যা না হয় সে জন্য জেলা প্রশাসন থেকে প্রকল্প এলাকায় ঘরে ঘরে গিয়ে ভূমি অধিগ্রহণের টাকা দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে তিন দফা এলাকায় গিয়ে ভূমির অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৪ অক্টোবর ১৫৫ জন মালিকের মাঝে ২১ কোটি টাকা বিতরণ করেন বেজার চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী ও চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (ভূমি অধিগ্রহণ) আবু হাসান সিদ্দিক।
এ প্রসঙ্গে আবু হাসান সিদ্দিক আমাদের সময়কে বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ ঘিরে দালালচক্র সক্রিয় থাকার অভিযোগ সবখানে দেখা যায়। মিরসরাই শিল্প অঞ্চলের মালিকরা যেন সে ধরনের কোনো হয়রানির শিকার না হন, সে জন্য আমরা তাদের ঘরে গিয়ে অধিগ্রহণ করা ভূমির চেক বিতরণ করছি। কেউ অভিযোগ করতে পারবেন না যে, এ জন্য এক টাকাও কাউকে দিতে হয়েছে।