নিজস্ব প্রতিবেদক:
- প্রবাসীরা সাড়ে তিন মাসে পাঠিয়েছেন ৮ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স
- বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছাড়িয়েছে ৪০ বিলিয়ন ডলার
- তিন মাসে রফতানি আয় ১০ বিলিয়ন ডলার
রহিম শেখ ॥ বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারীর মধ্যেই বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এই মহামারীকালেই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ছে। গত সাড়ে তিন মাসেই প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। বিদেশী মুদ্রার সঞ্চয়ন বা
রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। চলতি অর্থবছরের মাত্র তিন মাসেই ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে রফতানি আয়। বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যে (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) বড় উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবাহের গতিও বাড়ছে। মানুষের আয়-উপার্জন কমে গেলেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। দীর্ঘদিনের মন্দা পুঁজিবাজারে প্রাণ ফিরে আসতে শুরু করেছে। তবে করোনা মহামারীর ধাক্কায় ‘স্বস্তি’র অর্থনীতিতে আমদানি নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। মহামারীর আগে প্রতিমাসে পণ্য আমদানিতে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ হলেও এখন তা তিন বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রেমিট্যান্স, রিজার্ভ, রফতানি আয় বাড়ায় অর্থনীতিতে এক ধরনের ‘স্বস্তি’ বিরাজ করছে। কিন্তু এসব সূচকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমদানি বাড়ছে না, উল্টো অনেক কমছে। কেননা, আমদানির সঙ্গে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান জড়িত। সরকারকে এখন বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকেই বেশি মনোযোগ দিতে হবে।
ইউরোপে করোনার প্রকোপ আবার বাড়ছে। তাই অর্থনীতি বাঁচাতে লকডাউন এড়িয়েই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে আবারও কড়াকড়ি আরোপ করছে কয়েকটি দেশের সরকার। করোনা মহামারী সামলাতে আয়ারল্যান্ড ও ব্রিটেনের ওয়েলসে নতুন করে লকডাউন কার্যকর করেছে। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যে জার্মানির বাভেরিয়া রাজ্যের একটি জেলায় লকডাউন কার্যকর করা হয়েছে। বেলজিয়াম গত সোমবার থেকে এক মাসের জন্য বার ও রেস্তরাঁ বন্ধ করে দিয়েছে। ইতালিও একই পদক্ষেপ নিয়ে মানুষকে যতটা সম্ভব ঘরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে। পোল্যান্ডের প্রায় অর্ধেক অংশ ‘রেড জোন’ ঘোষণা করা হয়েছে। সুইজারল্যান্ডে বদ্ধ জায়গায় মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। গত সপ্তাহ থেকে প্যারিসসহ ফ্রান্সের নয়টি শহরে রাতব্যাপী কার্ফু জারি করা হয়েছে। ফ্রান্সের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ চার সপ্তাহের জন্য প্যারিস এবং আরও আট শহরে রাতেরবেলা কার্ফু জারির ঘোষণা দিয়েছে। স্পেনে হঠাৎ করে আবারও বেড়েছে করোনা সংক্রমণ। সংক্রমণ কমাতে দেশটির মন্ত্রিসভা ১৫ দিনের জরুরী অবস্থা জারির নির্দেশ দিয়েছে। স্লোভাকিয়ায় গত ১৩ অক্টোবর থেকে ছয় জনের বেশি জমায়েত হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। চেক প্রজাতন্ত্র তিন সপ্তাহের আংশিক লকডাউনে যাচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে ক্ষতি হবে, তার আর্থিক জের ১২ ট্রিলিয়ন ডলারে (এক ট্রিলিয়ন=এক লাখ কোটি) গিয়ে দাঁড়াবে বলে আভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ২০২০ সালের প্রবৃদ্ধির বিষয়ে গত জুনে এ পূর্বাভাস দিয়েছে তারা। এর আগে এপ্রিলে সংস্থাটি বলেছিল, ২০২০ সালে বিশ্ব অর্থনীতি ৩ শতাংশ সংকুচিত হবে। এখন তারা তা সংশোধন করে বলছে, মহামারীতে এই অঙ্ক আরও বেড়ে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ হবে। আইএমএফ বলেছে, বিশ্বের ২০১৯ সালের অর্থনৈতিক অবস্থায় ফিরে আসতে আরও দুই বছর সময় লাগবে। বিশ্বের কোন বৃহৎ অর্থনীতিই মহামারী থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিও চলতি বছর ৮ শতাংশ সংকুচিত হবে বলে আভাস দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া শুধু ইউরো ব্যবহার করে, এমন দেশগুলোর সংকোচন হবে ১০ শতাংশের বেশি। যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি সংকুচিত হবে ১০ দশমিক ২ শতাংশ। জাপানের উৎপাদন ৫ দশমিক ৮ শতাংশ কম হবে। চীনের অর্থনীতি ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখতে পারে। আইএমএফ বলছে, আগামী বছর (২০২১) বিশ্ব প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে, যা এপ্রিলে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল। তবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, করোনাভাইরাস মহামারীর ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। আর এ কারণেই চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৬ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়তে পারে। করোনাভাইরাস মহামারীর দ্বিতীয় সংক্রমণের তীব্রতায় বিশ্বের বড় অর্থনীতিগুলোর পাশাপাশি ভারতের মতো দেশের অর্থনীতিও মুখ থুবড়ে পড়েছে। মোট দেশজ উদনের (জিডিপি) প্রায় চার ভাগের একভাগ হারিয়েছে প্রতিবেশী দেশটি। কোভিড-১৯ ধাক্কায় মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতের নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এসেছে বাংলাদেশের নাম। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে এক হাজার ৮৮৮ ডলার, একই সময়ে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে এক হাজার ৮৭৭ ডলার।
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এই তিন মাসে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মহামারীর ছোবলে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) বাংলাদেশের অর্থনীতি যে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল, তা অনেকটাই কেটে গেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে বিস্ময়কর ঘটনাও ঘটতে দেখা যাচ্ছে। আমদানি ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মহামারীর আঁচ এখন আর খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না। মহামারীতে আটকেপড়া প্রবাসী এই কর্মীরা ফের ফিরে যাচ্ছেন সৌদি আরবে, তাদের পাঠানো অর্থ সচল রাখে অর্থনীতিকে। জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জনকণ্ঠকে বলেন, রেমিট্যান্স, রিজার্ভ, রফতানি আয় বাড়ায় অর্থনীতিতে এক ধরনের ‘স্বস্তি’ বিরাজ করছে। কিন্তু এসব সূচকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমদানি বাড়ছে না; উল্টো অনেক কমছে। সে কারণেই সতর্কতার সঙ্গে চলতে হবে এখন সরকারকে। অপ্রয়োজনী খরচ যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। সরকারকে এখন বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকেই বেশি মনোযোগ দিতে হবে।
সাড়ে তিন মাসে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে দেশে ॥ করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে রেমিট্যান্স কমবে বলে ধারণা করা হলেও তা উল্টো বাড়ছেই। চলতি অর্থবছরের সাড়ে তিন মাসে ৭৯৪ কোটি ১০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের পুরো সময়ে আসা রেমিটেন্সের প্রায় অর্ধেক। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অক্টোবর মাসের প্রথম ১৫ দিনে ১২২ কোটি ৭৮ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। ২০১৯ সালের অক্টোবরে ১৫ দিনে ৮০ কোটি ডলার পাঠিয়েছিলেন তারা। আর পুরো অক্টোবর মাসে এসেছিল ১৬৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের সাড়ে তিন মাসে (১ জুলাই থেকে ১৫ অক্টোবর) ৭৯৪ কোটি ১০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। এই অর্থ গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের পুরো সময়ের ৪৩ দশমিক ৬২ শতাংশ। গত অর্থবছরে মোট এক হাজার ৮২০ কোটি ৩০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা। আর একযুগ আগে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৭৯০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স দেশে এসেছিল; এবার সাড়ে তিন মাসেই সেই অঙ্ক ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর মাসে ২১৫ কোটি ১০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এর আগে এই মহামারীর মধ্যেই গত জুলাই মাসে ২৬০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। করোনাভাইরাস মহামারীর আঁচ বিশ্বের অর্থনীতিতে লাগার পর গত এপ্রিল মাসে রেমিট্যান্স কমেছিল। এরপর থেকে রেমিট্যান্স বাড়ছে। ধারণা করা হচ্ছিল, প্রবাসী বাংলাদেশীরা কষ্টের মধ্যেও ঈদের সময় স্বজনদের কাছে বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন, আর অনেকে কাজ হারিয়ে দেশে ফেরার পরিকল্পনা করছেন বলে জমানো অর্থ আগেই পাঠিয়ে দিচ্ছেন বলে রেমিট্যান্স বাড়ছে। কিন্তু আগস্টের শুরুতে কোরবানির ঈদের পরও রেমিট্যান্সের গতি থামেনি।
রিজার্ভ ছাড়িয়েছে ৪০ বিলিয়ন ডলার ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ভেঙ্গে চার হাজার কোটি (৪০ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। দেশের ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ রিজার্ভ। গত পাঁচ মাসে সাতবার রেকর্ড করেছে রিজার্ভ। প্রতিমাসে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে ১০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশী মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান রিজার্ভ সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। রিজার্ভের দিক দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। যা পাকিস্তানের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
ঘুরে দাঁড়িয়েছে পুঁজিবাজার ॥ দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশের পুঁজিবাজার চলছে ফুরফুরে মেজাজে। মূল্যসূচকের পাশাপাশি লেনদেনেও চাঙাভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০১০ সালের ধসের পর নানা উদ্যোগ নেয়ার পরও বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়ায়নি। মাঝেমধ্যে এক/দুই মাসের জন্য বাজারে কিছুটা ইতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা গেলেও পরে আর সেটা স্থায়ী হয়নি। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আরও একটি বড় ধসের মুখে পড়ে পুঁজিবাজার। বেশিরভাগ শেয়ারের দর তলানিতে নেমে আসে। মার্চে দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে লকডাউনের মধ্যে দুই মাসের বেশি সময় বন্ধ থাকে লেনদেন। ৩১ মে থেকে দেশের পুঁজিবাজারে ফের লেনদেন শুরু হয়। মহামারী শুরুর পর গত জুনে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স যেখানে ৪ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে গিয়েছিল, বৃহস্পতিবার সেই সূচক ছিল ৫ হাজার পয়েন্ট। লেনদেন হয়েছে ৯০০ কোটি টাকার মতো। এর আগে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে ডিএসইএক্স ৫ হাজার ১০০ পয়েন্ট ছাড়িয়ে গিয়েছিল। লেনদেন উঠেছিল প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকায়। জানতে চাইলে ঢাকা স্টক একচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের কাছেও অবাক লাগছে। এই মহামারীর মধ্যে পুঁজিবাজারের ইতিবাচক ধারায় ফেরা খুব একটা প্রত্যাশিত ছিল না। আমার বিবেচনায় এখানে দুটি বিষয় কাজ করেছে। প্রথমত, বাজার অনেক পড়ে যাওয়ায় শেয়ারের দামও অনেক কমে গিয়েছিল। বাজারে আসার জন্য এটা ছিল ভাল সময়। সেই সুযোগটাই বিনিয়োগকারীরা নিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, নিয়ন্ত্রক সংস্থা সক্রিয় হওয়ায় সমন্বয়হীনতা কমেছে, তার সুফল পাচ্ছে বাজার। ব্যাংকে সুদের হার কমে আসায় নতুন বিনিয়োগ পাচ্ছে পুঁজিবাজার।’
বৈদেশিক লেনদেনে বড় উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ ॥ মহামারীর মধ্যেও অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যে (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) বড় উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) এই উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩০ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই উদ্বৃত্ত ছিল মাত্র ২০ কোটি ৪০ লাখ ডলার। আর ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হয়েছিল ৪৮৪ কোটি ৯০ লাখ (প্রায় ৫ বিলিয়ন) ডলারের বড় ঘাটতি নিয়ে। তার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল আরও বেশি, ৫১০ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ঘাটতি ছিল ৯৫৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
তিন মাসে রফতানি আয় ১০ বিলিয়ন ডলার ॥ মহামারীতে তলানিতে নেমে যাওয়া রফতানি আয় ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রফতানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ ৯৮৯ কোটি ৬৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার আয় করেছে। এই তিন মাসে লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৯৬৬ কোটি (৯.৬৬ বিলিয়ন) ডলার। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ে এই আয়ের পরিমাণ ছিল ৯৬৪ কোটি ৭৯ লাখ ৯০ হাজার (৯.৬৪ বিলিয়ন) ডলার। এ হিসাবেই জুলাই-আগস্ট সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে রফতানি আয় বেড়েছে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে আয় বেড়েছে ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। করোনাভাইরাস মহামারীতে বিশ্বের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ায় গত এপ্রিলে বাংলাদেশের রফতানি আয় তলানিতে ঠেকেছিল। বিধিনিষেধ শিথিলে কারখানা খোলার পর মে মাসে রফতানি আয় কিছুটা বাড়ে, জুনে তার চেয়ে অনেক বাড়ে।
দুই মাসেই লক্ষ্যমাত্রার ৩৭ শতাংশ সঞ্চয়পত্র বিক্রি ॥ চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ৭ হাজার ৪৫৫ কোটি ৫ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এই অঙ্ক গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ের দ্বিগুণেরও বেশি। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে ৩ হাজার ৭১২ কোটি ৩৬ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৩ হাজার ৫৪৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। আর আগস্টে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৭৪৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা, যা এক মাসের হিসাবে গত দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১৯ সালের মার্চে ৪ হাজার ১৩০ কোটি ৭১ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। আর গত বছরের আগস্টে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪৯৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গত বছরের আগস্টের চেয়ে এবার আগস্টে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়েছে ১৫০ শতাংশ।
প্রণোদনায় বেসরকারী খাতের ঋণ বাড়ছে ॥ তলানিতে নেমে আসার পর ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি। গত আগস্ট মাস শেষে বেসরকারী খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ১ হাজার ৬৭৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যা গত বছরের আগস্টের চেয়ে ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ২০ শতাংশ। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৬১ শতাংশে নেমে এসেছিল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবাহে ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারী খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের মুদ্রানীতিতেও এই একই লক্ষ্য ধরা ছিল, বিপরীতে ঋণ বেড়েছিল ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় সরকার সোয়া লাখ কোটি টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, সেগুলোর বাস্তবায়নে গতি আসায় বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
গতি ফিরেনি আমদানিতে ॥ অন্য সব ক্ষেত্রের মতো গতি আসেনি আমদানিতে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে ৭৪৩ কোটি ২০ লাখ ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ কম। মহামারীর আগে প্রতিমাসে পণ্য আমদানিতে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ হলেও এখন তা তিন বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আর তাতে বিনিয়োগে বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা; যার ফল হবে কর্মসংস্থান কমে যাওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য ৭৩৬ কোটি ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়েছে। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের ওই দুই মাসে ৯৫০ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। এ হিসাবে দুই মাসে এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, খাদ্যপণ্য ছাড়া অন্য সব পণ্যের এলসি খোলার পরিমাণই কমেছে। শিল্প স্থাপনের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে ২৫ শতাংশ। গত বছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ৯৯ কোটি ২৮ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। এই বছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে তা ৭৪ কোটি ৫২ লাখ ডলারে নেমে এসেছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য গত বছর ওই দুই মাসে ৩২০ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। এবার খোলা হয়েছে ২৮৬ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের। শতকরা হিসাবে আমদানি কমেছে ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। একইভাবে শিল্প খাতের মধ্যবর্তী পণ্য আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে ১৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ। জ্বালানি তেল আমদানির এলসি কমেছে ৫৩ দশমিক ১৩ শতাংশ। এছাড়া অন্যান্য পণ্যের কমেছে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-আগস্ট সময়ে এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ১৮ শতাংশ। গত বছরের এই দুই মাসে যেখানে ৮৯৭ কোটি ৪০ লাখ ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছিল, এবছর একই সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ৭৩৬ কোটি ডলারের এলসি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে বিনিয়োগে স্থবিরতা চলছিল; জিডিপির ৩১-৩২ শতাংশে আটকে ছিল। আমদানি কমা মানে বিনিয়োগ কমে যাওয়া। আর বিনিয়োগ কমা মানে কর্মসংস্থান কমে যাওয়া। সে কারণেই সতর্কতার সঙ্গে চলতে হবে এখন সরকারকে। অপ্রয়োজনীয় খরচ যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য এমন কথা ইতোমধ্যে বলেছেনও। সরকারকে এখন বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকেই বেশি মনোযোগ দিতে হবে।